প্রকাশ: ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের উত্তাপ ছড়িয়েছে দেশের শিক্ষাঙ্গনসহ সর্বত্র। ডাকসুর প্রার্থীরা শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে নানা ধরনের আশ্বাস দিচ্ছেন। একাডেমিক ক্যালেন্ডার, আবাসন সংকট নিরসন, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিরাপত্তা, প্রশাসনিক সেবা ডিজিটালাইজেশনকে প্রাধান্য দিয়ে ছাত্রদল, শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ, স্বতন্ত্র ঐক্যজোটসহ অধিকাংশ প্যানেলই তাদের নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছে। তবে শিক্ষর্থীরা বলছেন, তারা ইশতেহারের ফুলঝুরি নয়, বাস্তবায়ন চান। অন্যদিকে প্রার্থীরা বলছেন, যেসব ইশতেহার বাস্তবায়নযোগ্য, সেগুলোয় জোর দিচ্ছেন তারা।
এদিকে ডাকসু নির্বাচনে অপরাজেয় ৭১, অদম্য ২৪ প্যানেলের মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক বিএম ফাহমিদা আলমকে গণধর্ষণের হুমকি দেওয়ার ঘটনায় শিক্ষার্থী আলী হুসেনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৬ মাসের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২০২১ সেশনের ছাত্র। বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তার বহিষ্কারের তথ্য জানানো হয়। এ বিষয়ে গঠিত প্রক্টরিয়াল সত্যানুসন্ধান কমিটির সুপারিশের আলোকে তাকে বহিষ্কারের এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এতে বলা হয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রীকে কুরুচিপূর্ণ ভাষায় আক্রমণ ও হুমকি দেওয়ার ঘটনায় তাকে ৬ মাসের জন্য বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হয়। আলী হুসেনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগ করা হলেও তদন্ত কমিটি এমন কোনো প্রমাণ পায়নি।
দীর্ঘ ছয় বছর পর ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে স্বপ্নের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনকে ঘিরে আশায় বুক বাঁধছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ফলে প্রতিটি প্যানেল বৈচিত্র্যময় থিমকে প্রাধান্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে টানার চেষ্টা চালাচ্ছে। ভোটারদের আকৃষ্ট করতে প্রচারণায় নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে তারা। আবাসিক হলগুলোর পাশাপাশি অনাবাসিক ভোটারদের টানতে বিশেষভাবে কাজ করছে প্যানেলগুলো। মেয়েদের ভোট টানতে নারীবান্ধব ক্যাম্পাসের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন কোনো কোনো প্রার্থী। ছাত্রীদের আবাসন, স্বাস্থ্য, গর্ভকালীন ছুটি ও ক্লাস উপস্থিতির বিষয় শিথিল করাসহ বিভিন্ন সমস্যা ডাকসুর মাধ্যমে সমাধানের আশ্বাস দিচ্ছেন।
আবাসন সংকট নিরসন, হল ও কো-কারিকুলার কার্যক্রমের উন্নয়ন, স্বাস্থ্যসেবা ও খাদ্য নিরাপত্তা, প্রশাসনিক সেবা ডিজিটালাইজেশন, লাইব্রেরি ও শিক্ষার মানোন্নয়ন, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা এবং পরিবহণ সুবিধার উন্নয়নের মতো নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে ১০ দফা ইশতেহার ঘোষণা করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত আবিদ-হামিম-মায়েদ পরিষদ। ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে গঠিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ৩৬ সংস্কারের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনকে একাডেমিক ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত করে প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন বাস্তবায়ন করা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ফ্যাসিবাদের দোসরমুক্ত করা, ফ্যাসিবাদের চিহ্ন ও ফ্যাসিবাদী কাঠামো, ব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও চর্চার পুনরুৎপাদন রোধ করা এবং গেস্টরুম, গণরুম কালচার ফিরে আসার সব পথ রুদ্ধ করার করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। ‘দাড়ি-টুপি, বোরকা-হিজাবসহ’ পোশাক ও আঞ্চলিকতাকেন্দ্রিক ‘মোরাল পুলিশিংয়ের’ বিরুদ্ধে কাজ করাসহ ৮ দফা দেয় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। দলীয়করণ ও বিরাজনীতিকরণমুক্ত একাডেমিক ক্যাম্পাস, নারীবান্ধব ক্যাম্পাস এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ ১১ দফা ইশতেহার দিয়েছে উমামা ফাতেমার নেতৃত্বাধীন স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল। এছাড়া ডাকসুর কাঠামোর সংস্কার ও ক্ষমতা বৃদ্ধি, শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়ন করে শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণায় অগ্রাধিকার, আবাসন সংকট নিরসনসহ ১৮ দফা ইশতেহার দেয় প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেল।
নির্বাচনমুখী এসব জোট-প্যানেলের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের বিষয়ে মহিউদ্দীন আহমেদ নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচন দেখেছি। তখন প্রার্থীরা শতশত ইশতেহার দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের আর পাওয়া যায়নি। ফলে ওই ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের ভাগ্যের পরিবর্তন করতে পারেনি। এবারের নির্বাচনেও যাতে একই ঘটনা না ঘটে, সে দাবি জানাচ্ছি। আয়শা আক্তার নামে আরেক নারী শিক্ষার্থী বলেন, আমরা ইশতেহারের ফুলঝুরি দেখতে চাই না। বরং শিক্ষার্থীদের প্রকৃত সমস্যাগুলোর সমাধান করা উচিত। উম্মে সালমা বলেন, প্রতিটি প্যানেলই বাস্তবসম্মত ইশতেহার ঘোষণা করেছে। এগুলো শুধু খাতাকলমে না রেখে বাস্তবায়ন করতে পারলে শিক্ষার্থীরা প্রকৃতপক্ষে উপকৃত হবে।
প্রার্থীদের আশ্বাস : শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশার বিষয়ে ছাত্রদল প্যানলের জিএস প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামিম বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেই ১০ দফা ইশতেহার ঠিক করেছি। এটা বাস্তবতার নিরিখেই চূড়ান্ত করা হয়েছে। ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোটের ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম বলেন, আমরা শিক্ষার্থীদের অবাস্তব কোনো স্বপ্ন দেখাতে রাজি নই। আমরা ডাকসুর মেয়াদকালকে হিসাব করে সুনির্দিষ্ট ৩৬টি সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। যেগুলার প্রতিটিই বাস্তবায়নযোগ্য। বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদের ভিপিপ্রার্থী আবদুল কাদের বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শত বছর পার হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় নতুন একটি দেশ উপহার দিয়েছে। তবে কেউ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেনি। আশা করি, আমাদের প্যানেলের প্রতিটি ইশতেহার বাস্তবায়ন করা হবে।
প্রচার-প্রচারণা : বুধবার দিনের প্রথমার্ধে একটা ভয় ও শঙ্কা নিয়ে প্রচারণা শুরু করেন ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা। তবে বেলা গড়াতে গড়াতে এলো সুখবরটি। আপিল বিভাগ চেম্বার আদালতের আদেশ বহাল রেখেছেন এবং ৯ সেপ্টেম্বর নির্বাচন হচ্ছেই। হঠাৎই যেন প্রার্থী ও ভোটারদের মাঝে আনন্দ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। প্রার্থীরা জোর প্রচারণা শুরু করেন।
ক্ষমা চেয়েছেন আলী হুসেন : সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলী হুসেনের পুরোনো কিছু ছবি এবং স্ট্যাটাস দিয়ে অনেকে তাকে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির এবং বাংলাদেশ জাতীয়বাদী ছাত্রদলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেছিলেন। তবে তদন্ত কমিটি তার কোনো রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা পায়নি। আলী হুসেনের সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শারীরিক প্রতিবন্ধী হওয়ায় তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই বেশি সময় কাটাতেন। গণমাধ্যমের নিউজ এডিট করে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক পোস্ট করতেন। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানতে চাইলে সত্যানুসন্ধান তদন্ত কমিটির সদস্য ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর মিসেস শেহরীন আমিন ভূঁইয়া বলেন, আলী হুসেন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত মর্মে আমরা প্রমাণ পাইনি। সে নিজেও স্বীকারোক্তিতে বলেছে, তার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নেই। এর বাইরে এমন কোনো প্রমাণ আমরা পাইনি, যা দিয়ে তাকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে মনে হয়। তিনি আরও বলেন, আলী হুসেনের দু-একটি ছবি যেগুলো দিয়ে তাকে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট বলে অভিযোগ করা হয়, সেগুলো সম্পর্কে ওই ছাত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ক্ষোভ থেকে তিনি কুরুচিপূর্ণ স্ট্যাটাসটি আকস্মিক দিয়েছিরেন বলে ক্ষমাও চেয়েছেন।
ডাকসু নির্বাচনের দিন বন্ধ থাকবে ঢাবির ক্লাস-পরীক্ষা : ফের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন। আসন্ন ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে শুধুমাত্র ভোটগ্রহণের দিন আগামী ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত থাকবে। বুধবার রাতে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক ড. জসীম উদ্দিন।
এর আগে গত ৩০ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মুনসী শামস উদ্দিন আহম্মদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে আগামী ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪ দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তকে ভালোভাবে নেননি প্রার্থীরা। এ নিয়ে অনেক প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের কাছে লিখিত অভিযোগও দেন। পরে গত সোমবার এই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) মুনসী শামস উদ্দিন আহম্মদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আগামী ৭ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ক্লাস ও পরীক্ষা চলমান থাকবে। আসন্ন ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন উপলক্ষ্যে ৮, ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর সব ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। আজ ফের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবার ৩ দিনের ছুটি পরিবর্তন করে একদিন করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ফলে শুধুমাত্র ভোটগ্রহণের দিন আগামী ৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের ক্লাস ও পরীক্ষা স্থগিত থাকবে।
আরও পড়ুন