‘আমাদের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থাকবে, যত দিন না ফিলিস্তিন স্বাধীন হয়’
প্রকাশ: ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

জিন জারমুশের সিনেমা মেজাজে ধীর, ব্যক্তিকেন্দ্রিক। তাঁর ছবিতে প্রচলিত কাহিনিকাঠামো বা সরল প্লটের অগ্রগতি সচরাচর দেখা যায় না; বরং তিনি মনোযোগ দেন পরিবেশ, মেজাজ আর চরিত্রের বিকাশে। ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে এক সাক্ষাৎকারে নির্মাতা বলেছিলেন, ‘দর্শকের জন্য বাস্তব সময়ের অভিজ্ঞতা তৈরি করা’ তাঁর লক্ষ্য। ৭২ বছর বয়সী এই মার্কিন নির্মাতার নতুন সিনেমা ‘ফাদার মাদার সিস্টার ব্রাদার’ও তা–ই করেছে। কেট ব্লানচেট, অ্যাডাম ড্রাইভার আর টম ওয়েটস অভিনীত ছবিটি তৈরি হয়েছে নিউইয়র্ক, ডাবলিন ও প্যারিসে তিন পরিবারের পুনর্মিলনকে কেন্দ্র করে। পরিচালক নিজেই বলেছিলেন, ‘একধরনের অ্যান্টি-অ্যাকশন ফিল্ম।’ সেই সিনেমাই এবার জিতে নিল ভেনিসর সর্বোচ্চ পুরস্কার। স্বর্ণসিংহ পুরস্কার গ্রহণ করে জারমুশ বলেন, ‘আমাদের শান্ত ছবিটিকে ভালোবাসার জন্য ধন্যবাদ।’ মেরুন রঙের স্যুট আর কালো সানগ্লাস পরে মঞ্চে ওঠেন জারমুশ। বুকপিনের ব্যাজে লেখা ছিল ‘অ্যানাফ’, যা দিয়ে গাজায় অব্যাহত অবরোধ ও হামলার প্রতিবাদ জানিয়েছেন তিনি।
পুরস্কার হাতে নিয়ে জারমুশের প্রথম প্রতিক্রিয়া, ‘ওহ শিট।’
এরপর বলেন, ‘আমরা নির্মাতারা প্রতিযোগিতার জন্য কাজ করি না, তবে এই স্বীকৃতি সত্যিই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ভেনিসকে আমি ভালোবাসি। শিল্প সরাসরি রাজনীতি নিয়ে কথা না বললেও রাজনৈতিক হতে পারে।’ তাঁর বক্তৃতার শেষ দিকে এক ইতালীয় নারী গলা মিলিয়ে চিৎকার করে ওঠেন, ‘উই লাভ ইউ, জিম!’ জারমুশ তখন আকিরা কুরোসাওয়ার অস্কার অভিভাষণের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ‘কুরোসাওয়া বলেছিলেন, তিনি এখনো শিখছেন। আমিও তাই এখনো শেখার মধ্যে আছি।’
ফিরে এল হিন্দ রজবের স্মৃতি
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে নিহত হয় ছয় বছরের শিশু হিন্দ রজব। পরিবারসহ গাড়িতে করে গাজা সিটি থেকে পালাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়। হিন্দের সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন তার চার চাচাতো ভাইবোন ও খালা-খালু। পরে সবাই নিহত হন। সে ঘটনা অবলম্বনে ‘দ্য ভয়েস অব হিন্দ রজব’ বানিয়েছেন ফরাসি-তিউনিসীয় নির্মাতা কাওথের বেন হানিয়া।
উৎসবে সিনেমাটি প্রদর্শনের পর রেকর্ড ২৩ মিনিটের স্ট্যান্ডিং ওভেশন পেয়েছিল। সিনেমাটি ভেনিসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার গ্র্যান্ড জুরি পুরস্কার পেয়েছে। পুরস্কার নিতে গিয়ে বেন হানিয়া বলেন, ‘হিন্দ রজবের গল্প কেবল তার নয়, এটি পুরো একটি জাতির গল্প, যারা প্রতিনিয়ত গণহত্যার শিকার। হিন্দের কণ্ঠ সাহায্যের আর্তি ছিল, যা পুরো বিশ্ব শুনেছিল, কিন্তু কেউ সাড়া দেয়নি। যত দিন না বিচার মেলে, তার কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হতে থাকবে।’ নেলসন ম্যান্ডেলার উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের বক্তব্য শেষ করেন বেন হানিয়া, ‘আমাদের স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থাকবে, ফিলিস্তিন যত দিন না স্বাধীন হয়।’
অভিনয়ে সেরা
‘দ্য সান রাইজেস অন আস অল’ ছবিতে অভিনয় করে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন চীনের জিন জিলেই। ৩৯ বছর বয়সী এই তারকা এমন এক নারীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি প্রাক্তন প্রেমিকের কাছে অতীতের ভুলের দায় শোধ করতে মরিয়া। তাঁর কৃত অপরাধের দায়ে জেল খেটেছে সেই প্রেমিক।
ইতালির টোনি সারভিল্লো জিতেছেন সেরা অভিনেতার সম্মান। পাওলো সরেন্তিনোর ‘লা গ্রাজিয়া’ ছবিতে তিনি একজন প্রেসিডেন্টের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, যিনি ইউথেনেশিয়া (বেদনা ও কষ্ট থেকে বাঁচতে স্বেচ্ছা মৃত্যু) বিল আইনে স্বাক্ষর করবেন কি না, সে দ্বিধায় ভুগছেন। পুরস্কার মঞ্চ থেকেই গাজার প্রসঙ্গ টেনে সারভিল্লো বলেন, ‘যাঁরা অবরোধ ভেঙে মানবতার বার্তা পৌঁছাতে সাহস করে নেমেছেন, তাঁদের জন্য শ্রদ্ধা।’
আরও পুরস্কার
মিশ্র মার্শাল আর্টস তারকা ও রেসলার মার্ক কেরের জীবন অবলম্বনে নির্মিত বেনি সাফদির ‘দ্য স্ম্যাশিং মেশিন’ নিয়ে উৎসবে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে ছবির প্রধান চরিত্রে ডোয়াইন জনসনের অভিনয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন সমালোচকেরা। ছবিটি জিতেছে উৎসবের তৃতীয় সর্বোচ্চ রৌপ্যসিংহ পুরস্কার। নেপলসকে ঘিরে জিয়ানফ্রাঙ্কো রোসির প্রামাণ্যচিত্র ‘বিলো দ্য ক্লাউডস’ পেয়েছে বিশেষ জুরি পুরস্কার।
হরাইজনস বিভাগে সেরা হয়েছে এক ট্রাকচালকের গল্প নিয়ে নির্মিত ডেভিড পাবলসের মেক্সিকান ছবি ‘এন এল কামিনো’।
চমকে দিয়েছেন বাঙালি নির্মাতা অনুপমা রায়। ‘সং অব ফরগটেন ট্রিজ’ সিনেমার জন্য অরিজ্জন্তি বিভাগে সেরা নির্মাতা হয়েছেন অনুপমা। ছবিটির প্রযোজক অনুরাগ কশ্যপ। এ ছাড়া চলচ্চিত্রে অবদানের জন্য সন্মানসূচক স্বর্ণপাম পান জার্মান নির্মাতা ভের্নার হেৎসগ ও মার্কিন অভিনেত্রী কিম নোভাক।
উৎসব শুরু হয়েছিল গত ২৭ আগস্ট। মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রধান জুরি ছিলেন মার্কিন নির্মাতা আলেকজান্ডার পেইন।
তথ্যসূত্র: এএফপি, ভ্যারাইটি