Advertisement
  • হোম
  • বিনোদন
  • ‘আমি নাকি কবরীর বারোটা বাজিয়ে দেব, সেগুলো বলে ভয় দ...

‘আমি নাকি কবরীর বারোটা বাজিয়ে দেব, সেগুলো বলে ভয় দেখায়’

প্রথম আলো

প্রকাশ: ১৮ আগস্ট, ২০২৫

24obnd

জনপ্রিয়তা সব সময় এক রকম থাকে না। সময়ের সঙ্গে বদলে যায় দর্শকদের ভালোবাসা। যে কারণে ‘মিয়া ভাই’খ্যাত নায়ক মনে করতেন, ‘মানুষ ভালোবাসতে বাসতে একটা সময় ভুলে যায়।’ সময়ের সঙ্গে এই ভাবনা তাঁকে কষ্ট দিত। কখনো ভাবতেন, সময়ের সঙ্গে কি তিনি হারিয়ে যাবেন? কিন্তু তিনি কখনোই হারিয়ে যাননি। ঢালিউডে অভিনেতা আকবর হোসেন পাঠান ফারুক এখনো ভক্তদের কাছে নায়ক হয়েই বেঁচে রয়েছেন। আজ এই অভিনেতার জন্মদিন। ১৯৪৮ সালে তাঁর জন্ম। সিনেমার গল্পের মতোই ছিল এই নায়কের জীবনের গল্প।

ঢালিউড এই নায়ককে কি ভুলে যাওয়া সম্ভব? এখনো যাঁর সিনেমাকে নানা কারণে উদাহরণ হিসেবে টানা হয়। যাঁর ক্যারিয়ারে রয়েছে একাধিক জনপ্রিয় ও প্রশংসিত সিনেমা। ঢালিউড সিনেমাকে এগিয়ে নেওয়ায় যাঁর রয়েছে অবদান। দর্শকদের কাছে ‘লাঠিয়াল’, ‘সুজন সখী’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘আলোর মিছিল’সহ বহু সিনেমায় তিনি ঢালিউডে পোক্ত আসন গড়েছেন। সেই নায়কের শুরুটা কেমন ছিল?

সিনেমার মতোই ছিল এই অভিনেতার শৈশবের গল্প। সেই গল্পগুলোই তাঁকে জীবনবোধ শিখিয়েছে। তিনি শৈশবে মাকে হারিয়েছিলেন। তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করতেন। সেই সময়ে মায়ের সঙ্গে হারিয়ে যায় গোটা শৈশব।। হঠাৎ মায়ের স্নেহবঞ্চিত এই অভিনেতার জীবন ছন্দ হারায়। তখন আর মন বসে না পড়ার টেবিলে। শাসনের লোক থাকলেও ভালোবাসার মতো কেউ ছিল না। এভাবে তাঁর শৈশব–কৈশোর কাটতে থাকে। তখনো সিনেমায় অভিনয় করবেন, এমনটা কখনোই ভাবেননি।

ছন্নছাড়া জীবন হওয়ার কারণে ফারুকের স্বাধীনতা বেশি ছিল। তিনি পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার, গুলিস্তানসহ আশপাশের অন্য এলাকায় পরিচিত ছিলেন। এই পরিচিতিই তাঁকে একসময় রাজনীতির মানুষের সঙ্গে মিল ঘটিয়ে দেয়। টাকার জন্য সেই সময়ে মিছিল–মিটিংয়ে যেতেন তিনি। ফারুক জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার সব থাকতেও কিছুই ছিল না। যে কারণে খেলার বয়সের সময় থেকেই আমাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে।’

এই অভিনেতার কাছে এই সংগ্রামের কোনো শেষ ছিল না। একসময় তিনি ভাসানী থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনেছেন। সেখান থেকে দেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন, স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছেন। যে কারণে অনেকেই তাঁর ওপর রুষ্ট ছিলেন। তরুণ বয়সেই পূর্ব পাকিস্তানের সেই সময়ে তাঁর নামে ৩৭টি মামলা ছিল। এসব মামলার মধ্যে খুন, ডাকাতিসহ নানান কারণ ছিল। বহুবার তিনি বলেছেন, তাঁর ওপর নানাভাবে অত্যাচার করা হতো। এ থেকে বাঁচতে একসময় তিনি অভিনয়ে নাম লেখান। ‘আমি সোনার চামচ মুখে নিয়ে অভিনয়ে আসিনি। আমাকে জীবনসংগ্রামের জন্য কষ্ট করতে হয়েছে। মিথ্যা মামলা নিয়ে বহুদিন আড়ালে থাকতে হয়েছে।’

ছন্নছাড়া জীবন হওয়ার কারণে ফারুকের স্বাধীনতা বেশি ছিল। তিনি পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার, গুলিস্তানসহ আশপাশের অন্য এলাকায় পরিচিত ছিলেন। এই পরিচিতিই তাঁকে একসময় রাজনীতির মানুষের সঙ্গে মিল ঘটিয়ে দেয়। টাকার জন্য সেই সময়ে মিছিল–মিটিংয়ে যেতেন তিনি। ফারুক জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমার সব থাকতেও কিছুই ছিল না। যে কারণে খেলার বয়সের সময় থেকেই আমাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে।’

শিল্পসত্তার সঙ্গে ফারুকের কোনো যোগ ছিল না। এগুলোকে এতটা গুরুত্বও দিতেন না; বরং শিল্পচর্চায় ব্যাঘাত ঘটিয়েছেন তিনি। ফারুক নিজেই জানিয়েছিলেন, শৈশবে কোথাও নাটক হচ্ছে, সেখানে গিয়ে নাটক মঞ্চায়নের পরিবেশ নষ্ট করেছেন। কখনো ডিমও মেরেছেন। সেখান থেকে নাটকে আসার গল্পটাও নাটকীয়। তিনি একসময় শিল্পের প্রেমে পড়েন।
ফারুকের মতে, ‘নাটকে অভিনয় করে আমার মধ্যে বড় একটা পরিবর্তন আসে। তখন আমি বুঝতে পারি, নাটকের সেট ভেঙে ফেলার কষ্ট। এটা আমার কাছে ছিল শিক্ষণীয়। নাটক করতে এসে আমার গান্ধীজির কথা মনে হয়, “এক গালে চড় মেরেছে, আরেক গাল পেতে দিয়ো।” এই ভালো লাগাই আমাকে অভিনয়ে নিয়মিত করে, ভালোবাসতে শেখায়। নাটক দিয়েই আমার অভিনয় শুরু। কিন্তু আমার নিজের ওপর আস্থা ছিল না আমাকে দিয়ে অভিনয় হবে।’

প্রায়ই নাটকে অভিনয় করলেও হঠাৎ ফারুক সিনেমায় আসেন। একবার তিনি অনেকের সঙ্গে একটি রুমে বসে ছিলেন। সেখানে সিনেমার পরিকল্পনা করছিলেন এইচ আকবর, এ টি এম শামসুজ্জামানসহ অনেকে। সিনেমার প্রায় সবকিছুই প্রস্তুত। সেখানে একজন জানতে চান, এই সিনেমার নায়ক কে হবে? এইচ আকবর জানান, কেন, ওই যে বসে ফারুক। পাশ থেকে আরেকজন জানান, ও তো ফারুক নন দুলু। আকবর জানান, সিনেমায় এখন থেকে ওর নাম হবে ফারুক। সেই দুলু থেকে নানা ঘটনায় তিনি দর্শকদের কাছে ফারুক হয়ে যান।

‘জলছবি’ দিয়ে সিনেমার ক্যারিয়ার শুরু। প্রথম সিনেমার নায়িকা ছিলেন কবরী। সিনেমাটি ১৯৬৮ সালে মুক্তি পায়। ভক্তদের কাছে রহস্য হয়ে রইল তাঁর অতীত। তিনি হয়ে গেলেন নায়ক ফারুক। হতে থাকল নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার শুরু প্রথম সিনেমার শুটিংয়ের আগেই। সেই সময় তিনি ধরেই নিয়েছিলেন হয়তো সিনেমা করা সম্ভব হবে না।

দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রথম সিনেমার শুটিংয়ের গল্প ফারুক কখনোই ভোলেননি। সেই শুটিংয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে শুরুতে কোনো কথাই বলতে পারেননি। তার হাত–পা কাঁপছিল। পরিচালক মুখ থেকে সংলাপই বের করতে পারেননি। তখন সরাসরি সিনেমার পরিচালক মোহাম্মদ আকবর তাঁকে বলেন, ‘ওই মিয়া, আপনাকে দেখলে হাজার মানুষ পালায়, আর আপনি এক ক্যামেরা দেখে কাঁপছেন কেন?’

সিনেমায় নাম লেখাচ্ছেন শুনে বেড়ে গেল ফারুকের সমালোচনা করার মানুষের সংখ্যা। তাঁরা কেউ কেউ নায়ক হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে পারছিলেন না। এটা নিয়ে বিরূপ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন সেই দুলু। ‘যে–ই শোনে, আমি নায়ক হয়েছি, সে–ই বলতে লাগল, আমি কীভাবে অভিনয় করব। আমি তো অভিনয় পারি না। আমি শুধু মারামারি পারি, আমি গালাগালি পারি। আমি নাকি উগ্র ধরনের লোক। এসব শুনতে হলো।’ শুধু তা–ই নয়, সেই সময়ে ফারুকের পথচলা থামানোর জন্য নায়িকা কবরীর সঙ্গেও অনেকে দেখা করেন।

সাক্ষাৎকারে অভিনেতা ফারুক সেই ঘটনা নিয়ে বলেছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে কবরীকে নেতিবাচক কথা বলে। আমি মাস্তান, এটা–সেটা। আমার ওঠাবসা ভালো না। আমি নাকি কবরীর বারোটা বাজিয়ে দেব, সেগুলো বলে ভয় দেখায়। আমি নাকি মাস্তান গ্রুপের সদস্য ছিলাম। কবরীকে বলেছিল, ওকে দিয়ে অভিনয় হবে না, তুমি ওর সঙ্গে অভিনয় কোরো না। আমার কাছের মানুষই কবরীকে কথাটা বলেছিল।’

অবশেষে এসব আর বাধা হয়নি। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রথম সিনেমার শুটিংয়ের গল্প ফারুক কখনোই ভোলেননি। সেই শুটিংয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে শুরুতে কোনো কথাই বলতে পারেননি। তার হাত–পা কাঁপছিল। পরিচালক মুখ থেকে সংলাপই বের করতে পারেননি। তখন সরাসরি সিনেমার পরিচালক মোহাম্মদ আকবর তাঁকে বলেন, ‘ওই মিয়া, আপনাকে দেখলে হাজার মানুষ পালায়, আর আপনি এক ক্যামেরা দেখে কাঁপছেন কেন?’ সেদিনই ফারুক বুঝতে পেরেছিলেন, সবকিছু সবাইকে দিয়ে হয় না। মনের মধ্যে একটা জেদ চেপে যায়, ‘অতীত ঘোচাতে হলে, আমাকে অভিনয় পারতে হবে।’ সেই জেদ দিয়েই তাঁর অভিনয়ের শুরু।

এরপর ‘সারেং বৌ’, ‘সুজন সখী’, ‘নয়নমনি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’সহ অনেক সিনেমা দিয়ে ফারুক দর্শকদের প্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। তাঁর সিনেমায় ঠোঁট মেলানো ‘ওরে নীল দরিয়া’, ‘তুমি আমার মনের মাঝি’, ‘তুমি ডুব দিয়ো না’, ‘চোখের জলে আমি ভেসে চলেছি’ সিনেমার এমন জনপ্রিয় গানগুলো ঘুরতে থাকে দর্শকদের মুখে মুখে। একসময় তিনি হয়ে ওঠেন দর্শক পছন্দের নায়ক।

ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে খান আতাউর রহমান, নারায়ণ ঘোষ মিতা, আবদুল্লাহ আল মামুনসহ গুণী পরিচালকদের কাছে ফারুক সব সময়ই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। ক্যারিয়ার নিয়ে তাঁর আফসোস ছিল, একসময় সিনেমায় উপস্থিতি কমে গেলে সম্মানটা পাননি। এমনকি সেই মাপে চিত্রনাট্যও হাতে পাননি।

দেশের নানা ঘটনা ফারুককে ভাবাত। দেশ নিয়ে আক্ষেপ করে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘একসময় মানুষের মাঝে যে ভালোবাসা ছিল, এখন সেই ভালোবাসা নাই। যুদ্ধের সময় আমরা দেখেছি, যারা জিনজিরা দিয়ে ঢাকা ছাড়ছিল, তাদের জন্য ওই এলাকার মানুষ মুড়ি, চিড়া, শরবত, যা ছিল তা–ই দিয়ে সহায়তা করেছিল। দেশের মানুষের মাঝে একে অন্যের প্রতি সেই ভালোবাসা হারিয়ে গেছে। সেই ভালোবাসার বাংলাদেশ আবার দেখার স্বপ্ন আমার।’ জাতীয় পুরস্কারসহ একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ২০১৮ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা অর্জন করেন এই নায়ক। ২০২৩ সালের ১৫ মে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ফারুক। এই অভিনেতা সংসদ সদস্যও ছিলেন।

Lading . . .