Advertisement

সাফল্যের শীর্ষ থেকে এক শিল্পীর নিঃসঙ্গ পতন

চ্যানেল আই

প্রকাশ: ৮ আগস্ট, ২০২৫

১৯২৩ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের এক ছোট শহরে জন্মগ্রহণ করেন উমা দেবী খাত্রি। যিনি পরে বলিউডে পরিচিত হন ‘টুন টুন’ নামে। তার জীবন যেন ছিল এক চলমান সংগ্রাম। শৈশবে পিতামাতার হত্যাকাণ্ড, কৈশোরে ভাইয়ের মৃত্যু, বঞ্চনা, অবহেলা- সব পেছনে ফেলে তিনি চলে আসেন স্বপ্নের শহর মুম্বাইয়ে, মাত্র ২৩ বছর বয়সে।

শিশির কৃষ্ণ শর্মাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টুন টুন তার শেষ জীবনে দুঃখভারাক্রান্ত শৈশবের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ছোটবেলায় জমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে তার মা-বাবাকে হত্যা করা হয়। তখন তিনি মাত্র আড়াই বছরের শিশুশিল্পী। এরপর তাকে আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে তার পড়াশোনার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাই নিজেই নিজেকে পড়তে ও লিখতে শেখেন।

তিনি জানান, একটু বড় হতেই তার বড় ভাইকেও হত্যা করা হয়। সেই সময় থেকেই তিনি সব কিছু ছেড়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন—তিনি শুধু গান গাইতে চাইতেন, সেটাই ছিল তার স্বপ্ন।

তার ভাষায়, “আমি মনে করতে পারি না আমার মা-বাবা দেখতে কেমন ছিলেন। আমি তখন দুই বা আড়াই বছরের হবো, যখন তারা মারা যান। আমার একটি ভাই ছিল, বয়স ছিল আট বা নয়, নাম ছিল হরি। শুধু মনে আছে আমরা ‘আলিপুর’ নামের এক গ্রামে থাকতাম। একদিন আমার ভাইকে মেরে ফেলা হয়, আর আমাকে আত্মীয়দের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন আমার বয়স ছিল চার বা পাঁচ।”

এই হৃদয়বিদারক অভিজ্ঞতাই তাকে গানের জগতে ছুটে আসার সাহস জোগায়, যেখানে পরবর্তীতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বলিউডের প্রথম নারী কৌতুকশিল্পী।

যদিও বলিউডে গায়িকা হিসেবে প্রবেশের জন্য কিছুই জানতেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত সাহস করে সংগীত পরিচালক নওশাদের দরজায় গিয়ে বলেন “আমার গান না শুনলে আমি আরব সাগরে ঝাঁপ দেব।” নওশাদ তার কণ্ঠ শুনলেন, এবং সেখানেই খুলে গেল বলিউডের দরজা। গান দিয়েই শুরু হলো তার যাত্রা, ১৯৪৫ সাল নাগাদ সিনেমায় গান গাওয়া শুরু করেন।

কিন্তু ক্যারিয়ারে বড় ধাক্কা আসে যখন তিনি নওশাদের প্রতিদ্বন্দ্বী এক প্রযোজকের ছবিতে গান গাওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে নওশাদ তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন, আর এখানেই থেমে যায় উমার প্লেব্যাক কেরিয়ার।

পরবর্তীতে নওশাদই তাকে বলেন অভিনয়ের দিকে মনোযোগ দিতে, আর দিলীপ কুমার তাকে উপহার দেন নতুন নাম “টুন টুন”। যদিও এই নামটা তার ওজন নিয়ে ঠাট্টার একটা প্রতিফলন ছিল, তবুও তিনি এই নাম গ্রহণ করেন। নিজের মজার স্বভাব ও কৌতুকপূর্ণ উপস্থিতির জন্য তিনি হয়ে ওঠেন বলিউডের প্রথম নারী কৌতুকশিল্পী।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, “আমার ওজনই আমার শক্তি। আমি আফসোস করি না যে আমি মোটা। আমি এমন জন্মেছি, এটাই আমার সৌভাগ্য।”

নতুন প্রজন্মের আগমনে পুরনো শিল্পীরা উপেক্ষিত হতে থাকেন। সাফল্যের পর একসময় বলিউড থেকে হারিয়ে যান টুন টুন। জীবনের শেষ দিকে, তিনি ছিলেন মুম্বাইয়ের এক সাধারণ চাওলে, অবহেলিত, একাকী এবং অর্থহীন! চিকিৎসা বা খাবার কেনার সামর্থ্যও ছিল না।

তার জীবনের শেষ দিনগুলো ছিল বেদনাদায়ক। টাইমস অব ইন্ডিয়া-র জন্য শশী রঞ্জনের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত হয়, টুন টুন (উমা দেবী) তখন মুম্বাইয়ের এক ছোট চাওলেতে বসবাস করছিলেন, চলচ্চিত্রজগত তাকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল। তার খাওয়ার জন্য বা ওষুধ কেনার মতোও টাকা ছিল না।

শশী রঞ্জন বলেন, “তিনি বলেছিলেন যে তিনি হাঁটতে পারছেন না, এমনকি খাবার জোগাড় করতেও কষ্ট হচ্ছে। আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি, সাক্ষাৎকারে তিনি বারবার বলছিলেন, ‘আমি আমার জীবন ইন্ডাস্ট্রির জন্য দিয়েছি, আর আজ আমার এই অবস্থা।’”

তবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, “আমাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তিনি ধন্যবাদ দিয়েছিলেন, এবং আমি অনুরোধ করতেই তিনি গেয়ে উঠলেন ‘আফসানা লিখ রাহী হুঁ’ গানটি।”

সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল তীব্র দারিদ্র্য ও অবহেলার মধ্যেও টুন টুন তার হাস্যরসবোধ হারাননি। নিজের দারিদ্র্য নিয়েও হাসতেন, সমাজ তার সঙ্গে কেমন আচরণ করছে তা নিয়েও হাসতেন।

শশী রঞ্জন বলেন, “এই বিষয়টাই আমাকে গভীরভাবে ছুঁয়ে গিয়েছিল, সব হারিয়ে ফেলেও তিনি তার আনন্দ-ইচ্ছা হারাননি।”

টুন টুন ২০০৩ সালে ৮০ বছর বয়সে প্রয়াত হন। তার জীবন ছিল এক অনন্য উদাহরণ, সাফল্যের শীর্ষ থেকে নিঃসঙ্গ পতনের করুণ ইতিহাস, যার ভিতরেও জেগে ছিল অব্যাহত আনন্দ ও মানবিকতা। – ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস

Lading . . .