নতুন ‘সুপারম্যান’ কেমন, পৃথিবীকে বাঁচাতে পারলেন কি
প্রকাশ: ৮ আগস্ট, ২০২৫

বেখাপ্পা রসিকতা, চিত্রনাট্যের গোঁজামিল—জেমস গানের রিবুট ‘সুপারম্যান’ নিয়ে অনেক সমালোচনাই আছে। এরপরও সিনেমাটি উপভোগ্য। ‘ডেডপুল’ বা গানের ‘গার্ডিয়ানস অব দ্য গ্যালাক্সি’ ছাড়া সাম্প্রতিক অন্য কোনো সুপারহিরো সিনেমায় এই ‘উপভোগ্য’ ব্যাপারটা নেই। তাই বড় পর্দায় দেখতে বসে এসব ভুলত্রুটি ভুলে সুপারম্যানকে পয়সা উশুল সিনেমা মনে হবে। আর সে কারণেই হয়তো অনেক দিন পর কোনো সুপারহিরো সিনেমা নিয়ে বিশ্বজুড়ে এতটা মাতামাতি হলো। জেমস গান এবার কেবল পরিচালকই নন, বরং ডিসির নতুন ইউনিভার্সের সহস্রষ্টাও। ‘নতুন শুরু’তে নিজের নায়ককে তিনি গতানুগতিক সুপারহিরোর সব উপাদান যেমন দিয়েছেন, তেমনই যোগ করেছেন কিছু মানবিক উপাদান।
একনজরে
সিনেমা : ‘সুপারম্যান’
ধরন: সুপারহিরো
পরিচালনা: জেমস গান
অভিনয়ে: ডেভিড কোরেন্সওয়েট, নিকোলাস হল্ট, র্যাচেল ব্রোসনাহান
দৈর্ঘ্য: ২ ঘণ্টা ৯ মিনিট
‘সুপারম্যান’-এর পরিচিত সেই ক্ল্যাসিক গল্প এবার বাদ গেছে। ক্রিপটন নেই। বরং ঠিক মাঝপথে সুপারম্যানের (ডেভিড কোরেন্সওয়েট) প্রথম হারের দৃশ্য দিয়ে শুরু হয় গল্প। এক আন্তর্জাতিক সংকটে জড়িয়ে পড়ে সুপারম্যান। জাহরানপুর নামের একটি দেশকে বাঁচিয়েছে বরাভিয়ার আক্রমণ থেকে, যেটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। পেন্টাগন তাকে সন্দেহ করে। সুযোগ বুঝে তাকে শেষ করে দিতে চায় লেক্স লুথার (নিকোলাস হল্ট)। নিজের মেটা হিউম্যান বাহিনীকে ব্যবহার করে সুপারম্যানকে দমন করতে চায় সে। তবে সুপারম্যানের পাশে আছে সাধারণ মানুষের সমর্থন আর ‘জাস্টিস গ্যাং’ নামের জনপ্রিয় একটি প্রাইভেট টিম। এরই মধ্যে সামনে আসে সুপারম্যানের ‘গোলমেলে’ অতীত। একদিকে পৃথিবীকে রক্ষা, অন্যদিকে পরিচয়সংকট—সুপারম্যানকে এবার দুই–ই সামলাতে হবে।
এ সিনেমার সুপারম্যানের সবচেয়ে বড় শক্তি তার হৃদয়। ব্র্যান্ডন রাউথের ‘সুপারম্যান রিটার্নস’ কিংবা টেলিভিশনের টাইলার হেকলিন বাদ দিলে, বহুদিন পর এমন এক সুপারম্যান পেলেন দর্শক; যে ক্লার্ক কেন্ট ও ‘সুপারম্যান’—দুই সত্তাকে একসঙ্গে ধারণ করে।
এ যুগে যেখানে আশাবাদ মানেই হাস্যকর বলে মনে করা হয়, সেখানে সুপারম্যানের ইতিবাচকতা একরকম জটিলতাই তৈরি করে। তার চোখে পৃথিবী সাদাকালো, ঠিক যেভাবে পুরোনো কমিক বই বা ক্রিস্টোফার রিভের ‘সুপারম্যান’ দেখে অভ্যস্ত দর্শক। সে মানুষের ভেতরে ইতিবাচকতা দেখতে পায়, সেটাই তার আসল শক্তি। ছবিতে নির্মাতা নায়ককে ‘সুপার’-এর চেয়ে ‘ম্যান’ হিসেবেই বেশি দেখাতে চেয়েছেন। সুপারহিরো সিনেমার মেজাজ অক্ষুণ্ন রেখেই সেটা করতে পেরেছেন তিনি। ছবির শুরুতেই দর্শক বুঝে যান এই সুপারম্যান অতি পরাক্রমশালী কেউ নয়। ব্যর্থতা নিয়ে আহত হয়ে আর্কটিকের বরফে পড়ে আছেন রক্তাক্ত ক্লার্ক কেন্ট; ওদিকে বিপদ আরও বাড়াচ্ছে তার একমাত্র সঙ্গী অবাধ্য কুকুর ক্রিপ্টো। যতই মানবিক হোক, সুপারম্যান যে আজও বিপদে পড়লে দুর্বার গতিতে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত, তা ছবির প্রতিটি ফ্রেমে স্পষ্ট। এই সুপারম্যান তরুণ, মাত্র তিন বছর হলো জনসমক্ষে এসেছেন। গানের পরিচালনা ও কোরেন্সওয়েটের অভিনয়ে তাঁর অনভিজ্ঞতা, দ্বিধা ও নতুন প্রজন্মের সংকটগুলো সুন্দরভাবে ফুটে ওঠে; যেখানে ভালোবাসা, ক্যারিয়ার, পরিচয়সংকট—সবই রয়েছে।
নিকোলাস হল্টের লেক্স লুথার আলাদা করে প্রশংসার দাবি রাখে। যদিও অনেকে একটু বয়স্ক ও কর্তৃত্বশীল লুথার পছন্দ করে (ডিসি অ্যানিমেটেড ইউনিভার্সের মতো), তবে হল্ট চরিত্রটির ঈর্ষা, অহংবোধ আর নিষ্ঠুরতা সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আগের বিতর্কিত জেসি আইজেনবার্গের চিত্রায়ণের তুলনায় এটি অনেক পরিণত।
আর লুইস লেন? র্যাচেল ব্রোসনাহানের পারফরম্যান্স ছবির প্রাণ। একজন তুখোড় সাংবাদিক হিসেবে; সুপারম্যানের সম্ভাব্য প্রেমিকা হিসেবে তাঁকে দারণ মানিয়েছে।
ছবিতে আলাদা করে নজর কাড়ে সুপারম্যানের আদুরে কুকুর ক্রিপ্টো। ছবিতে ক্রিপ্টো যখনই হাজির হয়েছে, তার উদ্ভট কাণ্ডকীর্তি হাসিয়েছে দর্শককে। ছবির সংগীতও বেশ ভালো। জন উইলিয়ামসের ক্ল্যাসিক থিমের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তৈরি হয়েছে নতুন ‘সুপারম্যান থিম’, যা উজ্জীবিত করে।
মহাকাশের দিকে ছুটে যাওয়া দৃশ্য, অতিকায় দানবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, কিংবা শহরে ভূমিকম্পে ফাটল—সব মিলিয়ে ছবির গতিময়তা চোখ ফেরানোর সুযোগ দেয় না। তবে সিনেমার গতির ধারা এতটাই উন্মত্ত যে কখনো কখনো চরিত্রগুলোর আবেগ-সংকট দর্শকের মনে বসে যাওয়ার আগেই দৃশ্য পাল্টে যায়। এ কারণেই হয়তো এটি ‘দ্য ডার্ক নাইট’ বা ‘সুপারম্যান ২’-এর মতো সমালোচকদের ব্যাপক প্রশংসা পায়নি। নির্মাতা যেন জোর করেই নিজের ‘দ্য সুইসাইড স্কোয়াড’-এর সব আজব জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে এসেছেন।
ডিসির অন্য চরিত্রগুলোকে না এনে সে বরং এখানে ‘জাস্টিস গ্যাং’-এর সদস্য হিসেবে হাজির হয়েছে গ্রিন ল্যান্টার্ন (নাথান ফিলিয়ন), মিস্টার টেরিফিক (এডি গ্যাথেগি) আর হকগার্ল (ইসাবেলা মারসেড)। সিনেমায় হিপনোটিক চশমা, ক্লোন, পকেট ইউনিভার্স, দানব, মিলিশিয়া দল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভুয়া তথ্য, ভূরাজনীতির নানা বিষয় একসঙ্গে হাজির হয়েছে। যা কোনোটিই মনে দাগ কাটে না। একসঙ্গে এত বিষয়ের অবতারণা না করলেই কি হতো না?
নির্মাতা গল্পটাকে নিশ্বাস নেওয়ার একটু সুযোগ যদি দিতেন, তাহলে হয়তো আরও জমে উঠত। এই সুপারম্যান একবার দেখার জন্য উপভোগ্য হলেও কত দিন মনে থাকবে বলা মুশকিল!