সব ছেড়ে নির্জন দ্বীপে বসতি, শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল তাদের ভাগ্যে
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

একসময় তো অনেকেরই মনে হয়, সব ছেড়েছুড়ে কোনো নির্জন দ্বীপে গিয়ে নতুন করে শুরু করা যায় না? স্বপ্নটা যতই রোমান্টিক শোনাক, বাস্তবে কি তত সহজ? ১৯৩০-এর দশকের শুরুর দিকে ইউরোপ থেকে আসা আটজন মানুষ সত্যিই এমনটা চেষ্টা করেছিলেন। ইউটোপিয়ার খোঁজে তারা পাড়ি জমিয়েছিলেন গালাপাগোসের ফ্লোরেয়ানা দ্বীপে। রন হাওয়ার্ড পরিচালিত সিনেমা ‘ইডেন’ এই সত্য ঘটনা অবলম্বনেই নির্মিত!
১৯৩৪ সালে ব্যারোনেস ও তাঁর প্রেমিক ফিলিপসন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। আসলে কী হয়েছিল, কেউ জানে না। কেউ বলেছে, তাঁর আরেক প্রেমিক রুডলফ ক্ষোভে হত্যা করেছিলেন। আবার গুজব ছিল ফ্রিডরিখও জড়িত। এই রহস্যই আজও সিনেমার গল্পকে রসদ জুগিয়ে যায়।
এর কিছুদিন পরেই ফ্রিডরিখ মারা যান দূষিত মাংস খেয়ে। সত্যিই দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত হত্যা—এ প্রশ্ন থেকে যায়। দোরে ১৯৩৫ সালে জার্মানিতে ফিরে গিয়ে নিজের স্মৃতিকথা লেখেন ‘ইডেনে শয়তান এসেছিল’। যেখানে ব্যারোনেসকে ‘শয়তান’ বলে উল্লেখ করেন।
কী ঘটেছিল
নাৎসি ফ্যাসিবাদ যখন ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন একদল মানুষ পালিয়ে গিয়ে ফ্লোরেয়ানায় বসবাস শুরু করেন—একজন চিকিৎসক ও তাঁর রোগী-প্রেমিকা, এক দম্পতি ও তাঁদের অসুস্থ সন্তান, আরেকদিকে এক ব্যারোনেস তাঁর দুই প্রেমিককে নিয়ে। ১৯২৯ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত এই ছোট্ট দ্বীপে তাঁরা গড়ে তোলেন এক অদ্ভুত সমাজ, যেখানে কেউ কারও সঙ্গে ঠিক বনিবনা করতে পারেননি। ১৯৩৪ সালে দুই বাসিন্দা হঠাৎ উধাও হয়ে যান, আজও রহস্যের সমাধান হয়নি।
হাওয়ার্ড মনে করেন, শত বছর আগের এই গল্প আজকের দর্শকের সঙ্গেও মিলে যাবে। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা সবাই এখনো বিশ্বাস করি, সমাজ থেকে দূরে গেলে হয়তো নিজেকে নতুনভাবে খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা নিজের ভেতরেই সমাজকে বয়ে বেড়াই।’
ফ্লোরেয়ানা যাওয়ার কারণ
১৯২৯ সালে জার্মান চিকিৎসক ফ্রিডরিখ রিটার (চলচ্চিত্রে জুড ল), এবং তাঁর প্রেমিকা দোরে স্ট্রাউখ (ভানেসা কিরবি) দ্বীপে চলে আসেন। দোরে ছিলেন মাল্টিপল জটিল রোগে আক্রান্ত, আগে ফ্রিডরিখের রোগী ছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউরোপে নাৎসি শক্তি যখন ক্ষমতায় উঠছে, তখন তাঁরা পালিয়ে নতুন এক পৃথিবী গড়ার স্বপ্নে আসেন ফ্লোরেয়ানায়।
যুদ্ধ থেকে ফেরার পর ফ্রিডরিখ মানসিক আঘাত ও স্নায়ুরোগে ভুগছিলেন। তাঁর লেখায় উঠে আসত নৈরাজ্যবাদী চিন্তা। যদিও তিনি বলতেন একা থাকতে চান, আসলে খ্যাতি পাওয়ার লোভও ছিল। আমেরিকার সংবাদমাধ্যমে তাঁর ও দোরের গল্প ছাপা হলে তাঁদের নাম ছড়িয়ে পড়ে।
পরে ১৯৩২ সালে জার্মান দম্পতি হেইঞ্জ ও মার্গারেট ভিটমার (ড্যানিয়েল ব্রুয়েল ও সিডনি সুইনি) তাঁদের অসুস্থ সন্তানের সুস্থতার আশায় দ্বীপে চলে আসেন। একই বছরে প্রবেশ করেন আলোচিত চরিত্র ব্যারোনেস আন্তোনিয়া (আনা দে আরমাস), সঙ্গে তাঁর দুই প্রেমিক। বিলাসবহুল হোটেল বানানোর স্বপ্ন ছিল তাঁর।
দ্বীপের জীবনযাপন
নতুন জীবনের প্রস্তুতিতে ফ্রিডরিখ নিজের সব দাঁত তুলেছিলেন, পরে স্টিলের দাঁতের সেট ব্যবহার করতেন। দোরে-ফ্রিডরিখ গড়ে তোলেন সবজির বাগান, মুরগির ডিম খেতেন, পোষ মানিয়েছিলেন একটি গাধাকেও।
ভিটমার পরিবার শিকার করে খেত, বাগান পাহারা দিত যাতে গবাদিপশু নষ্ট না করে। একদিন হেইঞ্জ ও ছেলে বাইরে শিকারে গেলে মার্গারেট একাই গুহায় সন্তান প্রসব করেন।
তারকাবহুল এই ঐতিহাসিক থ্রিলার সিনেমাটি গত বছর টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়। চলতি বছরের ২২ আগস্ট মুক্তি পায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাগৃহে। বক্স অফিসে সেভাবে সাফল্য পায়নি, সমালোচকদের কাছেও পেয়েছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
সমালোচকদের মতে, ছবির শুরুটায় বেশ আশাব্যঞ্জক কিন্তু পরের দিকে গতি হারায়। কোথাও এটি স্যাটায়ার, কোথাও থ্রিলার, আবার কোথাও খুনের রহস্য—শেষমেশ কোনো ধারাই ঠিকভাবে টিকতে পারেনি। স্টাইলের এই জটিল মিশ্রণ ছবিকে একঘেয়ে করেছে।
চিঠি পাঠাতেন সমুদ্রপথে—দ্বীপে রাখা ব্যারেলে নাবিকেরা সংগ্রহ করে যেত। এই লেখাগুলো খবরের কাগজে ছাপা হতো, ফলে আরও পর্যটক দ্বীপে আসতে শুরু করে।
ব্যারোনেস কিন্তু রুক্ষ জীবনযাপনে মানিয়ে নিতে পারেননি। তিনি অদ্ভুত সব আচরণ করতেন—প্রাণীকে আহত করে আবার সেবা করা, সব সময় হাতে রাখতেন অস্কার ওয়াইল্ডের ‘দ্য পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে’, এমনকি অতিথিদের কাছে নিজের বিলাসী রূপে হাজির হতেন।
তিনটি পরিবার—ফ্রিডরিখ-দোরে, ভিটমার আর ব্যারোনেস—মাঝেমধ্যেই একে অপরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াত। গবেষক অ্যাবট কাহলারের মতে, ‘ভিন্ন ভিন্ন ইউটোপিয়া এক জায়গায় মিললে কোনো স্বপ্নই বাস্তবায়িত হয় না।’
ব্যারোনেসের রহস্যজনক অন্তর্ধান
১৯৩৪ সালে ব্যারোনেস ও তাঁর প্রেমিক ফিলিপসন হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান। আসলে কী হয়েছিল, কেউ জানে না। কেউ বলেছে, তাঁর আরেক প্রেমিক রুডলফ ক্ষোভে হত্যা করেছিলেন। আবার গুজব ছিল ফ্রিডরিখও জড়িত। এই রহস্যই আজও সিনেমার গল্পকে রসদ জুগিয়ে যায়।
এর কিছুদিন পরেই ফ্রিডরিখ মারা যান দূষিত মাংস খেয়ে। সত্যিই দুর্ঘটনা, নাকি পরিকল্পিত হত্যা—এ প্রশ্ন থেকে যায়। দোরে ১৯৩৫ সালে জার্মানিতে ফিরে গিয়ে নিজের স্মৃতিকথা লেখেন।
পরে কী হয়েছিল
ব্যারোনেসের প্রেমিক রুডলফ পালাতে গিয়ে মারা যান। দোরে বাকি জীবন জার্মানিতে কাটান। অন্যদিকে ভিটমার পরিবার ফ্লোরেয়ানাতেই টিকে থাকে, তাদের উত্তরাধিকারীরা এখনো দ্বীপে হোটেল চালাচ্ছেন। মার্গারেট মৃত্যুবরণ করেন ২০০০ সালে, বয়স হয়েছিল ৯৫।
কেমন হয়েছে সিনেমাটি
তারকাবহুল এই ঐতিহাসিক থ্রিলার সিনেমাটি গত বছর টরন্টো চলচ্চিত্র উৎসবে প্রিমিয়ার হয়। চলতি বছরের ২২ আগস্ট মুক্তি পায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেক্ষাগৃহে। বক্স অফিসে সেভাবে সাফল্য পায়নি, সমালোচকদের কাছেও পেয়েছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
সমালোচকদের মতে, ছবির শুরুটায় বেশ আশাব্যঞ্জক কিন্তু পরের দিকে গতি হারায়। কোথাও এটি স্যাটায়ার, কোথাও থ্রিলার, আবার কোথাও খুনের রহস্য—শেষমেশ কোনো ধারাই ঠিকভাবে টিকতে পারেনি। স্টাইলের এই জটিল মিশ্রণ ছবিকে একঘেয়ে করেছে।
অভিনয় নিয়েও মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সমালোচকেরা। তাঁদের মতে আনা দে আরমাস যথাসাধ্য করেছেন, কিন্তু চরিত্রটিকে পুরোপুরি ব্যঙ্গাত্মক করে তুলতে পারেননি। জুড লর চরিত্র প্রথমে প্রভাব বিস্তার করলেও শেষদিকে এতটাই ক্লান্তিকর হয়ে ওঠে যে দর্শক তাঁর পতনে করতালি দিতে প্রস্তুত। তবে সিডনি সুইনি সবার মধ্যে আলো কেড়েছেন।
সব মিলিয়ে এডেন এমন এক গল্প, যার সম্ভাবনা ছিল বিস্তর। কিন্তু রন হাওয়ার্ডের হাতে তা হয়ে গেছে ঢিলেঢালা, বেখাপ্পা ও মাঝেমধ্যে কার্টুনধর্মী।
কী বলছেন নির্মাতা, অভিনয়শিল্পীরা
রন হাওয়ার্ড ছবিতে দ্বীপের অনুর্বর প্রাকৃতিক দৃশ্যকে ব্যবহার করেছেন যেন চরিত্রগুলোর ভেতরের অস্থিরতা প্রতিফলিত হয়। দর্শককে তিনি এমন এক চাপা আবহে রাখেন, যেখানে হাসির আড়ালেও লুকিয়ে থাকে ভয়। সিনেমাটি বানানোর প্রেরণা কীভাবে তৈরি হলো? ‘গালাপাগোস ভ্রমণের সময় একটি মিউজিয়ামে কয়েকটি ছবি দেখেছিলাম। সেখান থেকেই কৌতূহল। স্বপ্নবাজ মানুষেরা যখন পুরো জীবন বাজি রাখে আর শেষে ভয়ংকরভাবে ব্যর্থ হয়—এই ট্র্যাজেডিই আমাকে টেনে নিয়েছিল। পরে আমরা পরিবারের সবাই মিলে শুধু এ নিয়েই কথা বলতাম, আসলে কী হয়েছিল আর কেন।’
ছবির অভিনেতা জুড লর মতে, দর্শকেরাও ছবিটি দেখে মুগ্ধ হবেন। তিনি বললেন, ‘অনলাইনে অসংখ্য ফুটেজ, গল্প আর ব্যাক স্টোরি আছে, যা এই মানুষগুলোর অসাধারণ জীবনযাপন আর এই কাহিনির অবিশ্বাস্য দিকগুলো আরও স্পষ্ট করে। তাঁরা যে চরম সীমায় গিয়েছিলেন, তাঁদের স্বপ্ন আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা—সবকিছুই ছিল অবিশ্বাস্য। এসবই আসলে স্বপ্নের মতো।’
রন হাওয়ার্ড সিনেমাটি নিয়ে আরও বলেন,‘আমি এমন একটি চিত্রনাট্য চেয়েছিলাম, যা সাহসী অভিনেতাদের আকর্ষণ করবে, যাঁরা সীমিত বাজেটে কাজ করতে রাজি। কখনোই মনে হয়নি এটা স্টুডিও ছবি হওয়া উচিত। বরং যে আবেগ আর দায়বদ্ধতা দিয়ে আমরা এটি করেছি, সেটাই ছিল সঠিক পথ।’
এই দায়বদ্ধতার অংশ ছিল সঠিক লোকেশন বাছাই। জুড ল জানালেন, ‘সেট বানানো হয়েছিল, তবে সেগুলো এতটাই বাস্তবসম্মত ছিল যে মনে হতো আমরা সত্যিই সেখানে বসবাস করছি। শুটিং হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্টে, যেখানে প্রাকৃতিক উপাদানগুলোকে পুরোপুরি আঁকড়ে ধরা গেছে।’
এ জন্যই শুটিংয়ের সময় নানা বিপাকে পড়তে হয়েছে। জুড ল বলেন, ‘কয়েক দিন বন্যায় ডুবে গেছি, বেশির ভাগ দিন কাটাতে হয়েছে প্রচণ্ড গরমে। আবার কখনো হঠাৎ মাকড়সা বা সাপ ঢুকে পড়ত।’ তবে এটিই তিনি চেয়েছিলেন, ‘মনে হতো এভাবেই—শুধু এভাবেই—এই গল্প বলা সম্ভব।’
অভিনেতা এটাও স্বীকার করেছেন, বাস্তবে তাঁরা দিনের শেষে গাড়ি চড়ে হোটেলে ফিরতেন। তাই আরও গভীরভাবে চরিত্রে ঢোকার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ‘একদিন তো জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমি কি এখানে রাত কাটাতে পারি? অবশ্য বিমা কোম্পানি তা কখনোই মেনে নেয়নি’, বললেন ল।
তথ্যসূত্র: টাইম, দ্য হলিউড রিপোর্টার, স্ক্রিন র্যান্ট