প্রকাশ: ১৮ আগস্ট, ২০২৫

জুলাই ঘোষণাপত্রের পর জুলাই সনদ রচনা এবং এর প্রকৃতি ও বাস্তবায়নের পদ্ধতি বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে প্রধানতম আলোচিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বস্তুত এই সনদ চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর একটি সংস্কার রূপরেখা, যা দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান ও রাষ্ট্রের কাঠামো সংস্কারে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি দেশের নতুন রাজনৈতিক যাত্রাপথে নির্দেশকের অবস্থান তৈরি করেছে। এ ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা প্রশংসনীয়। কারণ, দ্বন্দ্বমূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চার প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলগুলোর সংস্কারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক।
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রথম ও দ্বিতীয় পর্বের আলোচনায় ৮৪টি বিষয়ে সহমত প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার নির্বাচন, তথ্য অধিকার আইন, সুপ্রিম কোর্টের সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, গণহত্যা ও ভোট জালিয়াতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে স্বাধীন তদন্ত কমিশন, নির্বাচনী অর্থায়ন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা, নির্বাচন কমিশন গঠন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ ইত্যাদি বিষয় রয়েছে। তবে ভিন্নমত বা নোট অব ডিসেন্টসহ রাষ্ট্রের মূলনীতি, রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি ও ক্ষমতা, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, নারী আসন, ন্যায়পাল নিয়োগ—এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, যেসব বিষয়ে নোট অব ডিসেন্ট আছে, সেগুলো বাস্তবায়নযোগ্য বলে মনে হয় না। ফলে এ বিষয়ে সংশয় থেকে যাচ্ছে। যদিও ঐকমত্য কমিশন বলেছে, তারা ভিন্নমত থাকা বিষয়গুলো বাস্তবায়নের উপায় খুঁজছে।
এখন এমন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নির্মাণ জরুরি, যা ভবিষ্যতে কর্তৃত্ববাদ প্রতিরোধে সক্ষম। বস্তুত সংসদীয় কাঠামোয় প্রকৃত নির্বাহী অতিরিক্ত ক্ষমতাধর হলে স্বেচ্ছাচারমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী হয়। প্রকৃতপক্ষে বিশ্বজুড়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা বেড়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিদ্যমান ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রী পদটি অতিমাত্রায় ক্ষমতায়িত। নিয়ম অনুযায়ী, নির্বাহীকে জবাবদিহি করে সংসদ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী দলীয় প্রধান ও সংসদ নেতার পদে থাকলে তাঁর নিরবচ্ছিন্ন ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এবং সংসদ নির্বাহীর করায়ত্ত থেকে ‘রাবার স্ট্যাম্প’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করে যায়। দেশের রুলস অব বিজনেস (কার্যবিধি) সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া দরকার। নির্বাহীকে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে সংসদীয় তদারকি জোরদার করাসহ স্থায়ী কমিটিগুলোর ক্ষমতায়ন, সংসদে বিরোধী দলের দায়িত্বশীল ও কার্যকর ভূমিকা পালন, প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো দরকার। এটি বিরোধী দলের ভূমিকাকে বেগবান করতে সহায়ক। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করলেও দলে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্র না থাকলে দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা দলীয় প্রধানের মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য।
প্রস্তাবিত জুলাই সনদ দেশের রাজনীতিতে একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’। একে কেন্দ্র করে জনমানুষের প্রত্যাশা জাগ্রত হয়েছে। এই দলিলের আইনি বাধ্যবাধকতাসহ প্রয়োজনীয় বিধিবিধান নির্দিষ্ট করাও জরুরি। এই সনদের কার্যকর বাস্তবায়ন না হলে গভীর হতাশা তৈরি হতে পারে, যা রাজনীতি ও সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ, সনদে সংবিধান, নির্বাচনী ব্যবস্থা, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারসহ ব্যাপকধর্মী প্রস্তাবনার অনুমোদন অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যা সরকারব্যবস্থায় প্রভাব বিস্তারের ইঙ্গিতবাহী।
অতীতে বাংলাদেশে আন্দোলনের পর সনদ রচনার প্রচেষ্টা বিরল। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এই সনদের বাস্তবায়ন তাই জনগণ ও সময়ের দাবি। কাজেই মতপার্থক্য নিরসন করে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সর্বদলীয় সমঝোতা প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। অন্যথায় গণতন্ত্রের পথে উত্তরণ সম্ভব হবে না।
আল মাসুদ হাসানউজ্জামান , জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক
মতামত লেখকের নিজস্ব