জামায়াতের সাবেক আমীরের ছেলেসহ 'বিতর্কিত' অনেকে জাবি ছাত্রদল হল কমিটিতে
প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ৩৭০ সদস্য বিশিষ্ট বর্ধিত কমিটি ও ১৭টি হলে ৮৮ সদস্যের কমিটি ঘোষণা করেছে ছাত্রদল। এতে হত্যা মামলার ৩ জন পলাতক আসামীসহ নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নেতা-কর্মী এবং বিভিন্ন সময় মাদক ও ছিনতাইয়ের কারণে বহিষ্কার হওয়া অনেকেই স্থান পেয়েছেন। এমনকি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ছাত্রদলের সভাপতি পদে চাঁদপুর জেলা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমিরের ছেলে হামিদুল্লাহ সালমানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার (৮ আগস্ট) কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ৩৭০ সদস্য বিশিষ্ট বর্ধিত কমিটি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া দু’জনকে দাপ্তরিক দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
একই দিনে শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব স্বাক্ষরিত পৃথক আরেক বিজ্ঞপ্তিতে ৬টি ছাত্রী হল, ১১টি ছাত্র হল ও একটি অনুষদসহ ৮৮ সদস্যের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়। গঠিত কমিটিকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে জানা যায়, বর্ধিত কমিটিতে গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা শামীম মোল্লা হত্যা মামলার পলাতক আসামী হামিদুল্লাহ সালমান ও মোহাম্মদ রাজন মিয়া সদস্য এবং রাজু আহমেদ যুগ্ম-আহ্বায়ক পদ পেয়েছেন। অথচ গত ১৭ মার্চ দিবাগত রাতে অনুষ্ঠিত এক সিন্ডিকেট সভায় শামীম মোল্লা হত্যার ঘটনায় জড়িতদের তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হামিদুল্লাহ সালমান সহ বাকিদের ৬ মাসের জন্য বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ ঘটনায় সালমান, রাজু, রাজনসহ ৮ জনের নাম উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গত ২০ সেপ্টেম্বর একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।
একই ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শামীম মোল্লার ভাই শাহীন মোল্লা বাদী হয়ে পৃথক আরেকটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ইতোমধ্যে ৩ জন আসামী কারাভোগ করলেও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন হামিদুল্লাহ সালমান, রাজু ও রাজন মিয়া।
শামীম মোল্লা হত্যার ঘটনার পরদিন ১৯ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ছাত্রদল এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, ‘অভিযুক্তরা ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন।’ তবুও মামলার ৮ আসামীর মধ্যে হামিদুল্লাহ সালমান, রাজু আহমেদ ও মোহাম্মদ রাজন মিয়া নতুন কমিটিতে স্থান পেয়েছেন। এর মধ্যে হামিদুল্লাহ সালমান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সভাপতি পদে দায়িত্ব পেয়েছেন। সালমানের বাবা মাওলানা আবদুর রহিম পাটোয়ারী চাঁদপুর জেলা জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির।
অভিযোগ উঠেছে, জাবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে সালমান অধরাই রয়েছেন। সালমানকে ছাত্রদলের রাজনীতিতে নানা ‘ব্যাকআপ’ পাচ্ছে বলে ছাত্রদলের একাধিক শীর্ষ নেতা জানিয়েছেন।
জাবির ছাত্রদলের ৩ জন শীর্ষ যুগ্ম-আহ্বায়ক জানান, “কেন্দ্রীয় সংসদের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়ার সঙ্গে এক বৈঠকে হল কমিটির সভাপতি পদে সালমানের নাম বাবর প্রস্তাব করলে সুপার ফাইভের অধিকাংশই আপত্তি জানায়। তারপরও শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক তার ‘ব্যক্তিগত গ্রুপের লোক’ বলে এরকম ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তিকে পদ দিয়েছে। যার মাধ্যমে জাবি ছাত্রদলকে জাতীয়ভাবে বিতর্কিত করা হয়েছে। এর দায়ভার আহ্বায়ক বাবরকে নিতে হবে।”
শামীম হত্যা মামলার পলাতকদের বিষয়ে পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনিসুর রহমান বাপ্পী বলেন, ‘এ মামলায় এখন পর্যন্ত দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- জাবি শিক্ষার্থী মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান রায়হান (২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪) এবং সাইফুল ইসলাম ভুইয়া (২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪)। এছাড়া, আতিক নামে আরও একজন আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। হামিদুল্লাহ সালমান, রাজন ও রাজু এখনও পলাতক রয়েছেন।’
শামীম মোল্লা হত্যা মামলার ৩ পলাতক আসামি
পলাতক আসামীদের গ্রেপ্তারের কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার কুদরত-ই-খুদা।
এছাড়া, কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সভাপতির পদ পাওয়া কাজী মৌসুমী আফরোজ ৫ আগস্টের পূর্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন বলে অভিযোগ আছে। ফজিলাতুন্নেছা হলের সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়া সাবরিনা সুলতানা সুরভী, ২১নং ছাত্র হলে সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়া ফিরোজ আহমেদ রিমন ও একই হলের সহ-সভাপতি পদ পাওয়া সাইদুর রহমান সীমান্ত, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক পদ পাওয়া মাহমুদুল হাসান ইমন (বাবু) আওয়ামী লীগ আমলে অংশ নিয়েছিলেন ছাত্রলীগের বিভিন্ন মিটিং-মিছিলে। আর সালাম-বরকত হলের সভাপতির পদ পাওয়া সাইদুল ইসলাম ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় সংসদের বিগত কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে ছিলেন।
বর্ধিত কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক পদ পাওয়া মো. শাকুর বাপ্পী জড়িত ছিলেন ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে। থার্টি ফার্স্ট নাইটে মাদকসহ আটক হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার হওয়া শিপন হোসাইন ও সতীর্থ বিশ্বাস বাঁধন সদস্য হিসেবে স্থান পেয়েছেন ছাত্রদলের বর্ধিত কমিটিতে। গত বছরের ২৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে আসা স্কুল শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মোবাইল ছিনতাইয়ের অভিযোগে বহিষ্কৃত ইমরান নাজিজকেও রাখা হয়েছে কমিটিতে।
এছাড়া, মূল কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক- রিফাত আকন্দ অন্তর, রবিন রহমান, সদস্য- মোস্তাফিজুর রহমান, হারুনুর রশিদ, সাদিকুল ইসলাম শুভ, রায়হান পারভেজ, জোবায়ের হাসান রিফাত, গোলাম রব্বানী অর্নব (ফুচকার দোকানে চাঁদাবাজির দায়ে সদ্য বহিষ্কৃত), রিহাব হোসেন, খন্দকার সাকিব আঞ্জুম শারফি, মুমিনুল, শাহরিয়ার শ্রেষ্ঠ, তাসলীম খান বাপ্পি, নাসির উদ্দীনের নামে ৫ আগস্টের পূর্বে ছাত্রলীগের রাজনীতি করার অভিযোগ রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জাবি ছাত্রদলের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। তবে এর আগে তিনি কোন হত্যা মামলার আসামী এবং নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের ছাত্রদল পুনর্বাসন করবে না বলে মন্তব্য করেছেন।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন নাছির কোনো মন্তব্য না করে বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবকে প্রশ্ন করতে বলেন।
প্রশ্নের জবাবে জাবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন মোহাম্মদ বাবর বলেন, “যথেষ্ট যাচাই-বাছাই করে কমিটি তৈরি করা হয়েছে। এরপরও বিতর্কিত অনেকে হয়তো রয়ে গেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পেলে আমরা অবশ্যই সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো।”