Advertisement

নক্ষত্রখচিত এক সভ্যতার প্রতিধ্বনি

যুগান্তর

প্রকাশ: ১৯ আগস্ট, ২০২৫

24obnd

মানবসভ্যতার আকাশে কখনো কখনো এমন কিছু তারকা জ্বলে ওঠে, যাদের আলো শুধু একটি যুগ নয়, বরং শতাব্দীর পর শতাব্দী আলোকিত করে রাখে।

ইসলামী খেলাফত সেই বিরল দীপ্তির নাম। যার জন্ম হয়েছিল মরুভূমির ধুলো থেকে, কিন্তু বিস্তার হয়েছিল দিগন্ত পেরিয়ে—যেখানে আলো পৌঁছেছিল গ্রন্থাগার, আদালত, মসজিদ ও মানুষের অন্তরে।

খেলাফতের সৌন্দর্য ছিল এর সহজতায়। শাসক ছিলেন কেবল শাসক নন, ছিলেন জনগণের খেদমতগার। ন্যায়ের পাল্লা ছিল ভারী, আর প্রতিটি রায় ছিল আলোর শিখার মতো স্বচ্ছ। যে মিম্বার থেকে কণ্ঠ উঠত, সেখানে রাজনীতির ঝড় নয়, বরং দায়িত্বের ডাক ধ্বনিত হতো। সেই ডাক একদিন ছড়িয়ে পড়েছিল কেবল এক নগর থেকে নয়, গোটা দুনিয়াজুড়ে।

ঐতিহ্যের পথে হাঁটলে দেখা যায়, খেলাফত শুধু ক্ষমতার নাম ছিল না। এটি ছিল জ্ঞানের নগরী। বাগদাদের রাত জেগে থাকা আলোকিত পাণ্ডুলিপি, কর্ডোভার প্রাসাদে প্রতিধ্বনিত পাঠ, বা দামেস্কের সরাইখানায় বসে চলা দর্শনের বিতর্ক—সবই বলে দেয়, খেলাফত ছিল সভ্যতার এক জীবন্ত মহাকাব্য। যে মহাকাব্য এক হাতে লিখেছিল রাজনীতি, আর অন্য হাতে জ্ঞান, বিজ্ঞান ও শিল্পকলা।

মসজিদের খিলান, মিনারের গম্বুজ, বা ক্যালিগ্রাফির সূক্ষ্ম রেখা—এসব কেবল অলঙ্করণ ছিল না, বরং এক আধ্যাত্মিক প্রতীক। প্রতিটি বাঁক ও রেখায় ফুটে উঠত বিশ্বাসের দীপ্তি। সেই সৌন্দর্য আজও মিনারের ছায়ায় দাঁড়িয়ে শ্বাস নেয়, ইতিহাসের ধ্বংসাবশেষ থেকেও জানান দেয়—একদা এখানে গড়ে উঠেছিল নক্ষত্রখচিত এক সভ্যতা।

তবে সৌন্দর্যের গল্প কেবল শাসনের জন্য ছিল না। খেলাফত মানে ছিল ন্যায়ের আশ্রয়। সেখানে বিধবা নারী যেমন আশ্রয় পেতেন রাষ্ট্রের ছায়ায়, তেমনি দূর প্রান্তের ভ্রমণকারীও খুঁজে পেতেন নিরাপত্তা। এক সমাজের ভেতরে আরেক সমাজ নয়, বরং সবাই ছিল একই কাঠামোর অংশ। ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন বর্ণ, ভিন্ন ভাষা—সব মিলেমিশে ছিল এক সুরে বাঁধা।

আজকের দুনিয়ার কোলাহলে দাঁড়িয়ে যখন আমরা খেলাফতের ইতিহাসের দিকে তাকাই, তখন অনিবার্যভাবে অনুভব করি এক বৈপরীত্য। চারপাশে যত কোলাহল, যত কৌশল, যত ভণ্ডামি, ততই মনে হয়—কী অদ্ভুত শান্তি লুকানো ছিল সেই সভ্যতার হৃদয়ে। খেলাফতের প্রতিটি অধ্যায় যেন নীরবে বলে—শাসন মানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, বরং দায়িত্ব; রাজনীতি মানে কৌশল নয়, বরং ন্যায়।

খেলাফতের সৌন্দর্য তাই কেবল অতীতের গৌরব নয়; এটি এক প্রতিধ্বনি, যা আজও ভেসে আসে বাতাসে। হয়তো আকাশ ঢেকে গেছে মেঘে, কিন্তু তারকারা তো নিভে যায়নি। তারা এখনো আলো ছড়ায়, শুধু আমরা অনেক সময় সেই আলো দেখার মতো চোখ খোলা রাখি না।

এ কারণেই খেলাফতের ইতিহাস যত দূরেই থাকুক, তার ঐতিহ্য বারবার ফিরে আসে মানুষের স্মৃতিতে। কারণ মানুষ জানে—ন্যায়ের তৃষ্ণা অনন্ত, আর সৌন্দর্যের প্রতি আকর্ষণ অমোচনীয়। যে সভ্যতা একদিন পৃথিবীকে দেখিয়েছিল কেমন হতে পারে আলোকিত রাজনীতি, কেমন হতে পারে সৌন্দর্যে ভরা রাষ্ট্রব্যবস্থা—তার প্রতিধ্বনি আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, অন্ধকার দীর্ঘস্থায়ী হলেও আলো চিরন্তন।

খেলাফত তাই কেবল অতীত নয়, বরং এক অদৃশ্য দিশারি। যে দিশারি নীরবে বলে—মানুষের ইতিহাস কেবল ক্ষমতার দখল নয়, বরং ন্যায়ের আলো খোঁজার অবিরাম যাত্রা। আর সেই আলো যতদিন থাকবে, ততদিন খেলাফতের নাম উচ্চারিত হবে সভ্যতার অনন্ত প্রতীক হয়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো, মিশর

আরও পড়ুন

Lading . . .