প্রকাশ: ৭ আগস্ট, ২০২৫

জান্নাত। অনাবিল শান্তির ঠিকানা। চির সুখের নীড়। অপার আনন্দের মোহনা। প্রতিটি মুমিনের লালিত স্বপ্ন ও সাধনা। জান্নাতের অফুরান সুখ মানুষের কল্পনার ঊর্ধ্বে। সুশীতল জান্নাতে থাকবে না কোনো কষ্ট ক্লেশ। কোনো অপ্রাপ্তি বা হতাশা স্পর্শ করবে না কখনো।
বেদনা বা ব্যর্থতার চোখের জল স্পর্শ করবে না কোনোদিন। না পাওয়ার কষ্টে মলিন হবে না কেউ । দুনিয়ার সবচেয়ে দুখী মানুষটিও জান্নাতের একটু ছোঁয়ায় ভুলে যাবে অতীতের সব যন্ত্রণা ও কষ্ট। হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত হাদিস।
নবীজি বলেন- কেয়ামতের দিন দুনিয়ার সবচেয়ে হতভাগা ও দরিদ্র লোকটিকে ডাকা হবে। এরপর তাকে শুধু একবার জান্নাতে ঘুরিয়ে এনে প্রশ্ন করা হবে, তুমি কি কখনো অভাবে ভুগেছো? কখনো কি দুঃখ কষ্টে পতিত হয়েছো? সে বলবে, না, আল্লাহর কসম। আমি পৃথিবীতে কখনো কষ্ট করিনি। কখনো বিপদে পড়িনি। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ২৮০৭)
দুটি অঙ্গ হেফাজত করলে স্বয়ং নবীজীই হবেন পরম প্রত্যাশার সেই জান্নাতের জামিন।
নবীজি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি নিজের দুই চোয়াল এবং দুই রানের মধ্যবর্তী অঙ্গ হেফাজত করবে, আমি তার জান্নাতের জামিন হবো। (সহিহ বুখারি: ৬৪৭৪)
তার মানে এই নয় যে,অন্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পাপ কোনো পাপ নয়। বরং প্রতিটি অঙ্গের সুরক্ষা এবং যথাযথ ব্যবহার একজন মুমিনের অপরিহার্য কর্তব্য। কারন সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই আল্লাহর আমানত এবং নিয়ামত। সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্পর্কে জিজ্ঞাসার মুখে পড়তে হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন- নিশ্চয় কান, চোখ, হৃদয় সবগুলো সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করা হবে। (সূরা বনী ইসরাঈল: ৩৬)
একবার নবীজিকে প্রশ্ন করা হলো, কোন অঙ্গের কারণে মানুষ জাহান্নামে জ্বলবে? তিনি বলেন, মুখ ও লজ্জাস্থানের কারণে। (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ২০০৪)
তাই এই দুটি অঙ্গের হেফাজতের ব্যাপারে নবীজি অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কেননা জিহ্বা হয়তো একটি ছোট্ট একটি মাংসখণ্ড। কিন্তু এর প্রভাব খুব ব্যাপক ও বিস্তৃত। এই ছোট্ট মাংসপিণ্ড পৃথিবীর অপর প্রান্তের মানুষের হৃদয় চৌচির করে দিতে পারে ।
মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে ছোট্ট এই জিহবা। নিবিড় বন্ধুত্বের মাঝে সৃষ্টি করতে পারে চরম বৈরিতা। অন্যের মনকে করতে পারে ক্ষতবিক্ষত। চরম লজ্জা ও অপমানে কারো সম্মান মাটিত মিশিয়ে দিতে পারে। এই জিহ্বায় কুফরী কথা বলে মানুষ
নিজেকে নিয়ে যায় জাহান্নামের পথে। কুটনামী গীবত গালিগালাজসহ বিভিন্ন মন্দ কাজ এই জিহবা দ্বারাই হয়ে থাকে।
আবার কষ্ট ও বেদনায় মলিন মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারে ছোট্ট এই মাংসপিণ্ড। এই জিহবা দ্বারা কালিমা পড়ে মানুষ মুমিন হয়। এগিয়ে যায় জান্নাতের পথে। কোরআন ও হাদিস পড়ে মানুষ খুঁজে পায় আলোর পথের ঠিকানা। সৎ ও নৈতিকতার কথা প্রচার করে লাভ করা যায় আমলকারীর সমপরিমাণ নেকি। এই জবানের মাধ্যমে লাভ করা যায় সর্বোত্তম জিহাদের মর্যাদা।
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী রা. থেকে বর্ণিত হাদিস। নবীজি বলেন, বড় জিহাদ হলো জালিম শাসকের সামনে ন্যায্য কথা বলা। (সুনানে তিরমিযি- ২১৭৪)
এই জবানের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দূর করা সম্ভব অশান্তির দাবানল। আবার এই যবানই কখনো ঘটাতে পারে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা। ভ্রাতৃপ্রতিম দুই দেশের মধ্যে সৃষ্টি করতে পারে অবিশ্বাস ও দূরত্বের দেয়াল।
একদিন এই জবান আল্লাহর দরবারে বান্দার কৃতকর্ম সম্পর্ক সাক্ষী দিবে।
কোরআনে কারীমে এসেছে- সেদিন তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে তাদের জিহ্বা, তাদের হাত ও পা সাক্ষ্য দেবে। (সূরা নূর: ২৪)
তাই যবান হেফাযতের ব্যাপারে নবীজি বলেন- যে আল্লাহ ও পরকাল বিশ্বাস করে সে যেন ভালো কথা বলে অথবা চুপ থাকে। -সহিহ বুখারি, হাদিস ৬০১৮
একবার নবীজি হযরত ওকবা ইবনে আমের রা.-কে কিছু উপদেশ দেন । এর মধ্যে একটি উপদেশ ছিল এমন, তুমি তোমার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখ। (জামে তিরমিযী, হাদিস ২৪০৬)
দ্বিতীয় যে অঙ্গটির সুরক্ষা দিলে নবীজি জান্নাতের জামিন হবেন তা হলো লজ্জাস্থান। এই অঙ্গের মাধ্যমে বিভিন্ন হারাম এবং যৌন অপরাধ সংগঠিত হয়। এ অঙ্গকে ঘিরেই মানুষ বেহায়াপনা ও অশ্লীলতায় জড়িয়ে পড়ে। এই অঙ্গের মাধ্যমে সংগঠিত হয় ঘৃণ্যতম অনৈতিক অপরাধ জিনা। জিনা মানুষকে আলোর পথ থেকে দূরে সরিয়ে দিতে পারে। বঞ্চিত করতে পারে ঈমানের সৌরভ থেকে।
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত হাদিস। নবীজি বলেন, যখন কোনো মানুষ ব্যভিচার করে তখন তার অন্তরে ঈমান থাকেনা। তখন তার ঈমান অন্তর থেকে বের হয়ে মেঘমালার মতো উপরে চলে যায়। সুনানে আবু দাউদ : ৪৬৯০
আল্লাহ তাআলা বলেন- মুমিনগণ অবশ্যই সফল এবং যারা তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাজতে রাখে। সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৫
অর্থাৎ যারা অবাধ ও অবৈধ যৌনতা থেকে নিজেদেরকে হেফাজতে রাখে। ধর্মীয় ও নৈতিকতার সীমা ডিঙ্গিয়ে যৌনতায় জড়ায় না।
একবার একজন সাহাবী নবীজিকে জিজ্ঞাসা করলেন, সবচেয়ে বড় পাপ কি? উত্তরে নবীজি বিভিন্ন পাপের কথা উল্লেখ করেন। এক পর্যায়ে নবীজি বলেন, প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে জিনা করা বড় পাপগুলোর অন্যতম। সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৫২০
আমার প্রত্যেকটি অঙ্গ আমার কাছে প্রিয়। এই প্রিয় অঙ্গ গুলো যেন আমার বিপদের কারণ না হয়। পরকালে আমার বিপক্ষে সাক্ষী হিসেবে না দাঁড়ায় সেভাবে চলতে হবে।
নিজের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সুরক্ষার চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহর কাছে দোয়া করতে হবে। অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অনিষ্ঠতা থেকে বাঁচতে নবীজি দোয়া শিখিয়েছেন। তিনি দোয়া করতেন-
اللّهُمّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ سَمْعِي، وَمِنْ شَرِّ بَصَرِي، وَمِنْ شَرِّ لِسَانِي، وَمِنْ شَرِّ قَلْبِي، وَمِنْ شَرِّ مَنِيِّي.
হে আল্লাহ! আমি আমার কান, চোখ, যবান, হৃদয় এবং লজ্জাস্থানের অনিষ্টতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই। -জামে তিরমিযী, হাদিস ৩৪৯২
লেখক: শিক্ষক, শেখ জনূরুদ্দীন রহ. দারুল কুরআন চৌধুরীপাড়া মাদরাসা, ঢাকা-১২১৯
আরও পড়ুন