প্রকাশ: ২৩ আগস্ট, ২০২৫

‘টুপি’ শব্দের বাংলা অর্থ শিরস্ত্রাণ বা মাথার আবরণ। এটি সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত। আরবিতে টুপির পরিচিত নাম ‘কালানসুওয়া’, যা ‘কালসুন’ থেকে এসেছে এবং এর বহুবচন ‘কালানিস’। ‘কালানসুওয়া’ অর্থ শিরোভূষণ। ( আল-মুজামুল ওয়াসিত , রিয়াদ: মাকতাবাতুশ শুরুকিদ দাওলিয়্যাহ, পৃ. ৭৫৬)
টুপি মাথা আবৃত করার একটি পরিধেয়, যা প্রায় ৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আবিষ্কৃত হয়েছিল। (অ্যালেক্স টেরস, হু ইনভেনটেড দ্য হ্যাট? আমেজিং হ্যাট হিস্টোরি)
টুপি পাশ্চাত্যের ‘হ্যাট’-এর সমতুল্য, যা শীত ও রোদ থেকে সুরক্ষা দেয়। এ ছাড়া ধর্মীয় আচার, সেনাবাহিনী, পুলিশ, নার্স, শেফ, ক্রীড়াবিদদের পোশাকের অংশ হিসেবেও টুপি ব্যবহৃত হয়। টুপি গঠনে হ্যাট, মাথাল বা হেলমেট থেকে ভিন্ন। (এলমার স্মিথাম, দ্য ডিফারেন্স বিটুইন হ্যাট, ক্যাপ অ্যান্ড আদার টার্মস ফর হেডগিয়ার )
বিশ্বব্যাপী শতাধিক ধরনের টুপি বা হ্যাট রয়েছে, যা পোশাকের অংশ হিসেবে জনপ্রিয়। কিছু উল্লেখযোগ্য প্রকার হলো মুসলিম টুপি, বেসবল ক্যাপ, স্ন্যাপব্যাক, ড্যাড হ্যাট, ট্রাকার হ্যাট, বিনি, টপ হ্যাট, ফেডোরা, ট্রাইবি হ্যাট, পর্ক পাই, হমবার্গ, বেরেট, ক্লোশ হ্যাট, ফ্ল্যাট ক্যাপ, বোলার, কাউবয় হ্যাট, ব্রেটন হ্যাট, আর্মি হ্যাট, পিলবক্স, বোটার হ্যাট, পানামা হ্যাট, সান হ্যাট, বাকেট হ্যাট, শেফ হ্যাট, সেইলর হ্যাট, সান্টা হ্যাট, উইচ হ্যাট, পার্টি হ্যাট, গ্র্যাজুয়েশন হ্যাট ইত্যাদি।
ঢাকা টুপি
ঢাকা টুপি বা নেপালি টুপি ঢাকাই কাপড়ের তৈরি, নেপালের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। রাজা মহেন্দ্রর শাসনামলে (১৯৫৫-৭২) এটি জনপ্রিয় হয়। সরকারি কাজে এই টুপি পরা বাধ্যতামূলক ছিল। দশৈং ও তিহার উৎসবে এটি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। বর্তমানে নেপালের সমাজে এটি বিশেষ অনুষ্ঠানে বা নিয়মিত ব্যবহৃত হয়। (বরুণ রায়, গোরখাস অ্যান্ড গোরখাল্যান্ড , পৃ. ১৮৮)
সিন্ধি টুপি
সিন্ধি টুপি বা ‘সিন্ধি কুফি’ পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের ঐতিহ্যবাহী টুপি। কালহোরা আমলে এর উৎপত্তি। আজরাক পোশাকের সঙ্গে এটি সিন্ধি সংস্কৃতির অংশ। হাতেবোনা এই টুপি থারপার্কার, উমেরকোট, সাংঘর ও মিরপুরখাসে তৈরি হয়। ‘সিন্ধি টুপি দিবস’ ২০০৯ সাল থেকে উদ্যাপিত হয়, যা পরে ‘সিন্ধি সাংস্কৃতিক দিবস’ নামে পরিচিত।
ইহুদি ধর্মে কিপ্পা
ইহুদিরা ‘কিপ্পা’ নামক ছোট টুপি পরেন, যা মাথার পেছনের তালুতে ঢাকে। এটি ক্লিপ দিয়ে আটকানো হয়। তালমুদে বলা হয়, ‘মাথা ঢেকে রাখো, যেন আসমানের ক্রোধ তোমার ওপর না পড়ে।’ প্রার্থনার সময় কিপ্পা পরা বাধ্যতামূলক, তবে অন্য সময় ঐচ্ছিক। রঙের ভিন্নতা শ্রেণি ও মর্যাদার প্রতীক—রক্ষণশীল ও সংস্কারকেরা সাদা, কট্টর ধর্মাবলম্বী ও গবেষকেরা কালো কিপ্পা পরেন।
ইসলামে টুপি
ইসলামে মাথার আচ্ছাদন গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষেরা টুপি বা পাগড়ি পরেন, নারীরা হিজাব। মুসলিম টুপি মাথার উপরিভাগ ঢেকে। অনেকে ঘুম ও গোসল ছাড়া সর্বদা টুপি পরেন, তবে কেউ কেউ শুধু নামাজে পরেন। সুতি, পশমি বা বাহারি রঙের টুপি বিশ্বব্যাপী প্রচলিত।
টুপি মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক প্রতীক। মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম টুপি পরতেন। হাসান বিন মেহরান বর্ণনা করেন, ‘আমি মহানবী (সা.)-এর মাথায় সাদা টুপি দেখেছি।’ ( আল-ইসাবাহ ফি মারিফাতিস সাহাবা , খণ্ড ৪, পৃ. ৩৩৯)
সুলাইমান ইবনে আবি আবদুল্লাহ বলেন, ‘মুহাজিরেরা কালো, সাদা, লাল, সবুজ ও হলুদ পাগড়ির ওপর টুপি পরতেন।’ ( মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা , খণ্ড ১২, পৃ. ৫৪৫
মহান আল্লাহ বলেন, ‘নামাজের সময় তোমাদের সর্বোৎকৃষ্ট পোশাক পরিধান করো।’ (সুরা আরাফ, আয়াত: ৩১)
টুপি ইসলামের শিয়ার ও সুন্দর পোশাক। জুহাইর (রহ.) বলেন, আবু ইসহাক আস-সাবেয়ি মাটি থেকে টুপি তুলে নামাজে পরতেন। ( তবাকাতে ইবনে সাদ , খণ্ড ৬, পৃ. ৩১৪)
ইসলামি আইনজ্ঞরা নামাজে টুপি পরাকে সুন্নত এবং অবহেলায় না পরাকে মাকরুহ বলেছেন। ( রদ্দুল মুহতার , খণ্ড ১, পৃ. ৬৪০)
নবীযুগ
মহানবী (সা.) সর্বদা টুপি পরতেন। আয়েশা (রা.) বলেন, তিনি সফরে কানটুপি এবং অন্য সময় শামি টুপি পরতেন। ( আখলাকুন নবি , খণ্ড ২, পৃ. ৩১৪)
আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, তাঁর তিন ধরনের টুপি ছিল: সাদা তুলার, ডোরাদার ইয়েমেনি এবং কানঢাকা টুপি। ( আখলাকুন নবী , খণ্ড ২, পৃ. ৩১৫)
সাহাবি ও তাবেয়ি যুগ
সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেয়িরা টুপি পরতেন। হাসান বসরি বলেন, ‘লোকেরা গরমে পাগড়ি ও টুপির ওপর সেজদা করতেন।’ ( ফাতহুল বারি , খণ্ড ১, পৃ. ৫৮৮)
আনাস বিন মালেক (রা.) সাদা টুপি পরতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫৮০২)
পরবর্তী যুগ
ইমাম আবু হানিফা উঁচু টুপি, ইমাম মালেক হাদিস বর্ণনার সময় টুপি এবং ইমাম আহমদ পাগড়ির সঙ্গে বা একা টুপি পরতেন। ( আল-ইনতিকা , পৃ. ৩২৬; সিয়ারু আলামিন নুবালা , খণ্ড ১১, পৃ. ২২০)
ইসলামি আইনজ্ঞদের মতে, ঘুম ছাড়া সর্বাবস্থায় টুপি পরা মুস্তাহাব। ( রদ্দুল মুহতার , খণ্ড ১, পৃ. ৬৪৫)।
ইবনুল কাইয়িম বলেন, মহানবী (সা.) পাগড়ির সঙ্গে বা একা টুপি পরতেন। ( জাদুল মাআদ , খণ্ড ১, পৃ. ১৩৫)
খালি মাথায় থাকা শিষ্টাচারবিরোধী, বিশেষ করে অভ্যাস হলে ইসলামি সংস্কৃতিপরিপন্থী। ( ফতোয়ায়ে রশিদিয়্যা , পৃ. ৫৯০)
মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরাম নামাজে টুপি পরতেন। ফুকাহারা এটিকে সুন্নত বলেছেন। অবহেলায় না পরা মাকরুহ, তবে নামাজ আদায় হয়। ( ফতোয়ায়ে কাজিখান , খণ্ড ১, পৃ. ১৩৫; ফতোয়ায়ে উসমানি , খণ্ড ৪, পৃ. ৩৪২)
আল্লামা নিজামুদ্দিন বলেন, খুশু (বিনয়) প্রকাশের জন্য খালি মাথায় নামাজ প্রশংসনীয়, তবে গাফলতির কারণে তা মাকরুহ। ( ফতোয়ায়ে আলমগিরি , খণ্ড ১, পৃ. ১০৬)