প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

মওলানা আকরম খাঁ, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ও মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছিলেন সমকালীন বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আলেম, সমাজসংস্কারক, আপসহীন রাজনীতিক, নির্ভীক বক্তা, সাহিত্যিক, সাহসী সাংবাদিক ও সফল সম্পাদক। ধর্ম, দেশ এবং মানুষের জন্য তাদের ভূমিকা ছিল অনন্য।
তাদের জীবন সাধনা বাংলা মুসলিম সমাজের মানসিক অবকাঠামো রচনায় যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছে। তিন কিংবদন্তির কণ্ঠস্বর আজও প্রেরণা হয়ে আছে আমাদের জন্য। তাদের আলোকিত জীবনালেখ্য তুলে ধরেছেন তোফায়েল গাজালি
মওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ
মওলানা মুহম্মদ আকরম খাঁ ছিলেন গোটা পৃথিবীর মাঝে বিরল সম্মানের অধিকারী মুসলিম মনীষীদের অন্যতম। যার জীবনের প্রতিটি বাঁক একেক ইতিহাস। মওলানা ১৮৬৯ সালের ৯ জুন পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার হাকিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে বাবা-মাহারা আকরম খাঁ নানার কাছে লালিতপালিত হন।
ইসলামি শিক্ষার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণের কারণে ১৮৯৬ ইংরেজি স্কুল ত্যাগ করে কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হন। ১৯০১ সালে কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজিল পাশ করে তিনি সাংবাদিকতায় যোগ দেন।
মুসলমান সমাজের নীরবতা ও আড়ালে লুকানো দুঃখ-দুর্দশা দেখা দিয়ে উঠলে, তরুণ আকরম খাঁ স্বজাতির মুক্তির জন্য সাংবাদিকতায় প্রবেশ করেন। ১৯১০ সালে তিনি ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মদী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবেই ব্যাপক পরিচিত লাভ করেন।
এরপর ১৯১৩ সালে গঠিত ‘আঞ্জুমান-ই-উলামায়ে-বাঙ্গালা’-র সাধারণ সম্পাদক নর্বাচিত হন। ১৯১৪ সালে তার নেতৃত্বেই প্রকাশ হয় পত্রিকা ‘আল-ইসলাম’। তিনি ছিলেন ‘আল ইসলাম’-এর যুগ্ম সম্পাদক ও প্রকাশক।
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে (১৯১৯-১৯২১) তিনি ছিলেন অগ্রসেনানী। এ সময় তিনি ‘জামানা’ (উর্দু দৈনিক) ও বাংলা দৈনিক ‘সেবক’ প্রকাশ করেন। ‘সেবক’-এ প্রকাশিত অপ্রতিরোধ্য ব্রিটিশবিরোধী সম্পাদকীয়র কারণে তাকে কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু কারাগারেও তার অবস্থান ছিল দৃঢ়। ১৯২২ সালে মুক্তির পর লেখালেখি ও পত্রিকা চালিয়ে যান আরও সুসংহতভাবে। ১৯২৭ সালে তিনি ‘মাসিক মোহাম্মদী’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে মুসলিম বাঙালিদের আধুনিক রসদ পৌঁছে দিতে সক্ষম হন।
১৯৩৬ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানী থেকে প্রথমবার বাংলা দৈনিক ‘আজাদ’ বের করেন যেটি রাজনীতিতে সাম্য, স্বাধীনতা ও ইসলামি ধারণার এক বাস্তব আন্দোলনমুখী সংবাদপত্র হয়ে ওঠে। ‘আজাদ’-এর মাধ্যমে তিনি মুসলমান জাতির মননে স্বাধীনতার চেতনা বুনে দেন যেটি পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার পাকিস্তান ও অবশেষে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়। লেখক, সাংবাদিক ও সমাজচিন্তাবিদ হিসাবে মওলানা আকরম খাঁ বাংলা সাহিত্যে চিরস্মরণীয় অবদান রেখেছেন। তার রচনা ‘মোস্তফাচরিত’ বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ নবী জীবনী। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ঢাকায় এসে প্রশান্তির সঙ্গে বসবাস শুরু করেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় মওলানা তার সাহসের স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৬৩ সালে রাজনৈতি থেকে অবসর নিয়ে একাধারে ধর্ম, সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও চিন্তার দুনিয়ায় নিজেকে নিবেদিত রাখেন তিনি। ১৮ আগস্ট ১৯৬৮ তার মধ্য রাতে ঢাকায় ইন্তেকাল করেন। তার আত্মার প্রতি রইল আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী
মাওলানা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ভারতীয় উপমহাদেশের প্রখ্যাত লেখক, সাংবাদিক ও রাজনীতিক। তিনি ২২ আগস্ট ১৮৭৫ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার বরমা-আড়ালিয়ার চরগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাচীন চট্টগ্রামের নাম ইসলামাবাদের অনুসারে নামের শেষে ‘ইসলামাবাদী’ শব্দ গ্রহণ করেন।
পশ্চিমবঙ্গের হুগলি সরকারি মাদ্রাসা থেকে ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। আরবি, উর্দু, ফারসি ভাষায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করলেও বাংলা ভাষা চর্চায় ছিল বিশেষ মনোযোগ। মাওলানা ইসলামাবাদী রংপুর হারাগাছ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ হিসাবে কিছুদিন চাকরি করেন।
সে সময় বাংলা-আসামে বিভিন্ন স্কুল, মাদ্রাসা স্থাপনে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি সাংবাদিকতাকে গণযোগাযোগ, দ্বীন প্রচার ও সমাজচেতনার শক্তিশালী মাধ্যম হিসাবে গ্রহণ করেন। এ লক্ষ্যে মাওলানা ইসলামাবাদী সোলতান (১৯০১), হাবলুল মতিন (১৯১২), মুহাম্মদী (১৯০৩), কোহিনূর (১৯১১), বাসনা (১৯০৪) ও আল-এসলাম (১৯১৩) পত্রিকার সঙ্গে দীর্ঘসময় যুক্ত ছিলেন।
তিনি বাংলা, আরবি, ফারসি ও উর্দু ভাষায় লেখালেখি করতেন। সে সময় মিসর থেকে প্রকাশিত আল মিনার, আল-ইহরাম, আল-বিলাদেও তার লেখা প্রকাশিত হয়। ফারসি দৈনিক পত্রিকা হাবলুল মতিনের বাংলা সংস্করণ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম থেকে মাসিক ইসলামাবাদ নামেও একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীকে নিয়ে কলকাতা থেকে সাপ্তাহিক সোলতান পত্রিকা প্রকাশ করেন।
১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে মাওলানা ইসলামাবাদীসহ তৎকালীন আলেমদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় ‘আঞ্জুমান-ই-উলামায়ে-বাঙ্গালা’ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তিনি ছিলেন এর যুগ্ম সম্পাদক। তিনি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ-এর বঙ্গীয় প্রাদেশিক শাখার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম কনফারেন্সের আয়োজন করেন। ১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘মুসলিম সাহিত্য সমিতি’ প্রতিষ্ঠায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। মাওলানা রাজনৈতিকভাবে প্রথম দিকে কংগ্রেসে সম্পৃক্ত থাকলেও ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে খেলাফত আন্দোলনে যোগ দেন। ইসলামাবাদী ১৯২৩ সালের বেঙ্গল প্যাক্টের অন্যতম স্থপতি।
১৯২৯ সালে মাদ্রাসাছাত্রদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত আসাম-বেঙ্গল জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান সম্পাদক ছিলেন মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কৃষক প্রজা পার্টির মনোনয়নে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য মাওলানা ইসলামাবাদী মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে দিল্লির লাল কেল্লায় বন্দি ছিলেন। ১৯৪৪ সালে তিনি আবারও আটক হন।
মাওলানা ইসলামাবাদী ৪২টির মতো গ্রন্থ রচনা করেন। ১৯৫০ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। কদম মোবারক মসজিদ প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান জীবনযুদ্ধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন, ‘একটু বয়স হওয়ার পর বুঝতে পেরেছিলাম যে, কিশোর বয়সে যে শোষক অপশক্তির বিরুদ্ধে চাকু হাতে লড়াই করার জন্য আমি সংকল্পবব্ধ হয়েছিলাম ওরা সংখ্যায় এক দুটি নয়, অগণিত। আর চাকু নিয়ে ওদের মোকাবিলা আমার দ্বারা অন্তত সম্ভব নয়। চাকুর চেয়ে অনেক বেশি ধারালো ও কার্যকর অস্ত্রের অনুশীলন আমাকে করতে হবে।কর্মজীবনের শুরুতেই কলম হাতে সংবাদপত্রের জগতে প্রবেশ করার প্রেরণা, আমি কৈশোরের সেই অনুভূতি থেকেই লাভ করেছিলাম।’ (জীবনের খেলাঘরে)।
তাই দেখা যায় মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছাত্রজীবন থেকেই সাংবাদিকতা ও সাহিত্যচর্চা শুরু করেন। ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ‘সাপ্তাহিক নয়া জামানা’ সম্পাদনা করেন। ১৯৬০ মাসিক দিশারী পত্রিকাও সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তার প্রতিষ্ঠিত মাসিক মদীনা পত্রিকা এ দেশের সবচেয়ে বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকা। দেশে-বিদেশে যার পাঠক সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়েছে। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯৬১ সাল থেকে ‘মাসিক মদীনা’ সম্পাদনার গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আমৃত্যু তা পালন করে গেছেন।
মাওলানার জন্ম ব্রিটিশ শাসন আমলে ১৯৩৫ সালের ১৯ এপ্রিল কিশোরগঞ্জ জেলার পাকুন্দিয়ায়। ১৯৫১ সালে আলিম, ১৯৫৩ সালে ফাজিল পাশ করেন। ১৯৫৬ সালে ঢাকার আলীয়া মাদ্রাসা থেকে হাদিসে কামিল ডিগ্রি লাভ করেন। এবং একই সময় তিনি কামিল ডিগ্রি ফিকাহ বিষয়ে অর্জন করেন। তার মৌলিক গ্রন্থের সংখ্যা শতাধিক। প্রিয় নবী (সা.)-এর জীবনের বিভিন্ন দিক ছিল তার লেখালেখি ও বয়ান-বিবৃতির মূল বিষয়বস্তু।
তিনি লেখেন, ‘দুনিয়ার যে কোনো প্রান্তে প্রিয় নবীজি (সা.)-এর পবিত্র সিরাত সম্পর্কিত যে কোনো মূল্যবান উপাদান পাওয়া যায়, তা কুড়িয়ে এনে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের খেদমতে হাজির করাই মাসিক মদীনার সর্বাপেক্ষা বড় সাধনা।’ বিভিন্ন যুগের মনীষীদের সিরাতবিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ অতি আগ্রহসহকারে তিনি অনুবাদ করে গেছেন। তাই তাকে বাংলা ভাষায় সিরাতচর্চার পথিকৃত বলা হয়। সংক্ষিপ্ত মাআরিফুল কুরআনের অনুবাদ ও বিনামূল্যে বিতরণ ছিল তার যুগান্তকারী আয়োজন। ষাটের দশক থেকে তিনি বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রবেশ করেন।
প্রথমে তিনি মাওলানা আতাহার আলী (রহ.) প্রতিষ্ঠিত নেজামে ইসলাম পার্টির কেন্দ্রীয় দায়িত্বে সমাসীন ছিলেন। পরবর্তী সময়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে ইসলামী শাসনতন্ত্রের জোরদার আন্দোলন চালিয়ে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৫-২৬ ডিসেম্বর ঢাকার পাটুয়াটুলী জামে মসজিদের দ্বিতীয় তলায় জমিয়তের কাউন্সিলে তিনি জমিয়তের মহাসচিব নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালের ২৮ মার্চ জমিয়তের সহসভাপতি এবং ২০০৩ সালের ১ জুন নির্বাহী সভাপতি নির্বাচিত হন।
এ ছাড়া তিনি ছিলেন সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের প্রতিষ্ঠাতা। রাবেতা আলমে ইসলামীর কাউন্সিলর। মু’তামারুল আলম ইসলামীর বাংলাদেশ শাখার প্রেসিডেন্ট। ইসলামী ঐক্যজোটের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের প্রধান ইত্যাদি। ২৫ জুন ২০১৬ তারিখে ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তার কবরকে রহমতের চাদরে আবৃত করে রাখুন।
আরও পড়ুন