প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মানুষের হৃদয় প্রেমে স্পন্দিত হয়, আবেগে আন্দোলিত হয়। প্রেমই তাকে করে কোমল, স্বপ্নময় এবং কল্পনার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো—প্রেমের নামে যা কিছু ঘটে, সবই কি প্রকৃত প্রেম? নাকি কখনো তা হয়ে ওঠে আত্মপ্রবঞ্চনা, ক্ষণস্থায়ী আকর্ষণ, কিংবা নিষিদ্ধ পথের গোপন অভিযাত্রা?
আমাদের সমাজে দিন দিন বেড়ে চলেছে একটি প্রবণতা—বিয়ের আগে অবৈধ প্রেম, গোপন সাক্ষাৎ আর লুকোচুরি সম্পর্ক, তারপর একসময় সেই প্রেমকে বৈধ করার জন্য বিয়ে।
ধর্ম, নৈতিকতা ও সমাজ—সব কিছুর সামনে এই প্রশ্ন অনিবার্য হয়ে ওঠে: এমন প্রেম কি সত্যিই বৈধ, নাকি এটি কেবল অবৈধতার স্মৃতি নিয়ে শুরু হওয়া বৈধতার এক খণ্ডিত প্রচেষ্টা?
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ পবিত্র একটি প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে মানবজীবনে স্থাপিত হয় শুচিতা ও প্রশান্তি।
মহান আল্লাহ কুরআনে ঘোষণা করেছেন—“আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটেও যেও না। নিশ্চয়ই এটি অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ”। (সূরা বনি ইসরাঈল, আয়াত ৩২)
একইসঙ্গে তিনি আরেক জায়গায় বলেছেন—“আর তার নিদর্শনসমূহের মধ্যে একটি হলো, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকেই সৃষ্টি করেছেন সঙ্গিনী, যাতে তোমরা তাদের কাছে প্রশান্তি পাও, আর তিনি তোমাদের মধ্যে সৃষ্টি করেছেন ভালোবাসা ও দয়া”।(সূরা রূম, আয়াত ২১)
এই দুটি আয়াতই আমাদের সামনে খুলে দেয় একটি পরিস্কার পথ—প্রেম বৈধ, কিন্তু তা কেবল বিবাহের মাধ্যমে; প্রেম নিষিদ্ধ, যখন তা বিবাহের সীমানার বাইরে।
রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন—“হে তরুণগণ! তোমাদের মধ্যে যার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব, সে যেন বিয়ে করে। কারণ এটি দৃষ্টিকে নত রাখে এবং লজ্জাস্থানকে সংরক্ষণ করে”।(সহিহ বুখারী, কিতাব আন-নিকাহ)
নবীর এই নির্দেশনা স্পষ্ট করে দেয় যে, প্রেমকে যদি সমাজ ও ধর্মের আলোয় বৈধ রূপ দেওয়া যায়, তবে সেটি কল্যাণকর; কিন্তু যদি তা অবৈধ পথে লালিত হয়, তবে সেটি কেবল পাপের অন্ধকারই ডেকে আনে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়—যে সমাজে অবৈধ সম্পর্ক বিস্তার লাভ করেছে, সে সমাজ অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল নৈতিক অবক্ষয় এবং অবাধ যৌনাচার।
মধ্যযুগীয় ইউরোপও একসময় নিমজ্জিত হয়েছিল অনৈতিক প্রেম ও ব্যভিচারের অন্ধকারে, যা ভেঙে দিয়েছিল পারিবারিক শৃঙ্খলাকে। ইসলাম সে কারণেই প্রেমকে নিষিদ্ধ করেনি, বরং তা নিয়ন্ত্রণ করেছে বিবাহের পবিত্র ছাদের নিচে।
বর্তমান বাংলাদেশি সমাজচিত্রে প্রযুক্তি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং শহুরে মুক্তজীবনের প্রভাবে তরুণ-তরুণীদের প্রেম করা সহজ হয়ে উঠেছে। কিন্তু সেই প্রেমের অধিকাংশই ঘটে বিবাহের আগে, যা ধর্মীয় ও নৈতিক দিক থেকে স্পষ্টভাবে হারাম।
আজকাল “পরে তো বিয়ে হবেই” যুক্তি দিয়ে অবৈধ সম্পর্ককে বৈধ করার চেষ্টা চলে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—যে প্রেমের শুরু গোপনীয়তা, মিথ্যা আর পাপের ছায়ায়, তার শেষ কতটা পবিত্র হতে পারে?
গবেষণা বলছে, যারা বিয়ের আগে দীর্ঘদিন অবৈধ সম্পর্কে জড়ায়, তাদের দাম্পত্যজীবনে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মাত্রা বেশি। (গিডেনস, The Transformation of Intimacy,1992)
কারণ অবৈধ প্রেমের বীজ থেকে জন্ম নেওয়া বিবাহ প্রায়শই অটুট আস্থার ভিত গড়তে ব্যর্থ হয়।
এই অবস্থার সামাজিক ক্ষতিও ভয়াবহ। অবৈধ প্রেমের ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, অবৈধ সন্তানের জন্ম, আত্মহত্যা ও মানসিক অবসাদ দিন দিন বাড়ছে। পরিবার ভাঙনের হার বেড়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সম্পর্কের ভাঙন এবং মানসিক অশান্তির অন্যতম কারণ হচ্ছে অবৈধ প্রেমের প্রভাব, যা বিবাহিত জীবনের স্থিতিশীলতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
তবে ইসলাম একটি আশার দুয়ার খোলা রেখেছে। যদি প্রেমিক-প্রেমিকা আন্তরিকভাবে তাওবা করে, অতীত ভুলের জন্য অনুশোচনা করে এবং বিয়ের মাধ্যমে সম্পর্ককে বৈধ করে, তবে আল্লাহর রহমতে তাদের নতুন শুরু সম্ভব।
কুরআনে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন—“যারা তওবা করে, ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের মন্দ কাজকে সৎকর্মে পরিবর্তন করে দেন”। (সূরা ফুরকান, আয়াত ৭০)
অর্থাৎ অতীত পাপের দাগ যদি থাকে তওবা ছাড়া, তবে তা ক্ষতিই বয়ে আনে, কিন্তু তওবা করলে আল্লাহর দয়া নতুন জীবন গড়ার পথ খুলে দেয়।
সুতরাং বলা যায়, বিয়ের আগে অবৈধ প্রেম ইসলাম ও সমাজ উভয় দিক থেকেই ক্ষতিকর। এর মধ্য দিয়ে আসে নৈতিক অবক্ষয়, সামাজিক সংকট এবং ব্যক্তিগত মানসিক যন্ত্রণা। কিন্তু সেই একই সম্পর্ক যদি অনুশোচনা ও তওবার মাধ্যমে বিয়েতে রূপ নেয়, তবে তা পবিত্র হয়ে উঠতে পারে।
তবুও মনে রাখা জরুরি—বিবাহের আসল উদ্দেশ্য কেবল অবৈধ প্রেমকে বৈধ করা নয়; বরং বিবাহ হলো দায়িত্ব, ত্যাগ, দয়া ও প্রশান্তির মিলিত বন্ধন, যা ভালোবাসাকে কল্যাণমুখী করে তোলে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর
আরও পড়ুন