মুসলিম শাসনামলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা
প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

উমাইয়া ও আব্বাসীয় (৭৫০-১২৫৮) যুগে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় উমাইয়া খলিফা মুয়াবিয়া (রা.) সংখ্যালঘুদের প্রতি অত্যন্ত উদার ছিলেন। তার চিকিৎসক, অর্থসচিব ও সভাকবি ছিল খ্রিষ্টান। সমগ্র উমাইয়া সাম্রাজ্যে তারা মোটামুটি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করেছিল। এ সময় অনেক গির্জা মন্দির ও উপাসনালয়ে সংস্কার করা হয়েছিল।
যোগ্য সংখ্যালঘুদের রাজকার্যের উচ্চ পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল। উমর ইবনে আব্দুল আযীয (র.) তার শাসন আমলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করেছিলেন। তিনি তাদের অধিকার যথাযভাবে আদায় করেছিলেন।
তারিক বিন যিয়াদ ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে স্পেন জয় করেন। তারপর প্রায় ৮ শতাব্দী এ অঞ্চল মুসলিম কর্তৃক শাসিত হয়। কুচক্রীদের বিচ্ছিন্ন কিছু অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা ছাড়া দীর্ঘকাল স্পেন ছিল শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশ। দেশটি সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের সেতুবন্ধ রচনা করেছিল। এখানে রোমান ইহুদি, খ্রিষ্টান ও অন্য ধর্মের অনুসারীদের অবস্থান ছিল, ছিল মসজিদ, চার্চ ও সিনাগগের মতো অনেক উপাসনালয়।
স্পেনের মুসলিম শাসনামলে মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের সহাবস্থান ছিল। স্পেনের তৎকালীন এ ধর্মীয় সহিষ্ণু পরিবেশ আফ্রিকা, ইরাক, সিরিয়া ও অন্য দেশের অধিবাসীদের স্পেনে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। যার ফলে স্পেন ইউরোপের একমাত্র ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে পরিণত হয়। নতুন নতুন শহরে অসংখ্য চার্চ ও সিনাগন স্থাপিত হয়।
সংখ্যালঘুদের অনুকূল পরিবেশ মুসলিম বিজয় থেকে শুরু করে প্রায় ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত বিরাজ করেছিল। মোটকথা স্পেনের মুসলিম শাসন আমলে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ তাদের ধর্ম-কর্ম পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছিল।
মুহাম্মদ ইবনে কাসিম ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের সিন্ধু বিজয় করেন। এ বিজয়ের মাধ্যমে ভারত প্রত্যক্ষ মুসলিম শাসনাধীনে আসে। ৭১১-৭১৩ খ্রি. পর্যন্ত মাত্র দুবছরে সিন্ধু ও মুলতানের সব এলাকা মুসলিম শাসক মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের অধীনে চলে আসে। ৭১১-৭১৪ পর্যন্ত প্রায় তিন বছরেরও অধিককাল তিনি এ অঞ্চল শাসন করেন। তিনি যখন এ অঞ্চল বিজয় করেন তখন বসবাসরত বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের সম্পর্কে নতুন রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে এ নিয়ে সমস্যায় পড়েন। মুহাম্মদ ইবনে কাসিম, হাজ্জাজ বি ইউসুফের কাছে এ সমস্যার সমাধান চেয়ে চিঠি লেখেন।
জবাবে হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ লেখেন, ‘তোমার পত্রখানা পেলাম। বর্ণিত ঘটনাবলি সম্পর্কে অবগত হয়েছি। লোকজন তাদের মন্দির মেরামতের জন্য স্বীয় সম্প্রদায়ের ইচ্ছা ব্যক্ত করেছে। তারা যখন আমাদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছে এবং খিলাফতের কর প্রদানের স্বীকারোক্তি ও দায়িত্ব গ্রহণ করেছে, তখন তাদের ওপর আমাদের আর অতিরিক্ত কোনো চাহিদা থাকে না। কেননা, তারা এখন জিম্মির মর্যাদায়। তাদের জানমালের ওপর আমাদের কোনো হঠকারিতা চলে না, এ জন্য তাদের অনুমতি দেওয়া যেতে পারে যে, তারা স্বীয় দেবতার উপাসনা করতে পারে এবং কোনো লোকের পক্ষে তাদের ধর্ম সম্পর্কে আপত্তি উত্থাপন ও বিরোধিতা করা সংগত হবে না।
মুহাম্মদ ইবনে কাসিমের আমলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এতই ব্যাপক ছিল যে, তিনি যখন বন্দি হয়ে ইরাক প্রেরিত হন তখন হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সব শ্রেণির মানুষ তার জন্য ক্রন্দন করেছে।
ভারতের সুলতানি আমলের (১২০৬-১৫২৬) মুসলিম শাসকরা তাদের রাজ্যে বসবাসরত অন্য জাতি হতে মাথাপিছু জিযিয়া কর আদায় করে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতেন। মুসলিম সামরিক বাহিনীতে স্বেচ্ছায় যোগদান কিংবা যুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে অন্য ধর্মের অনুসারীরা এক বছরের জিযিয়া কর দেওয়া হতে অব্যাহতি পেতেন। এমনকি দেশ জয় করার পর বিজিত অঞ্চলের ভিন্নধর্মের অনুসারীদের যতদিন পর্যন্ত জান-মালের নিরাপত্তা বিধান নিশ্চিত করা না হতো ততদিন পর্যন্ত মুসলিম শাসকরা তাদের ওপর জিযিয়া আরোপ করতেন না।
ভারতে মোগল সরকার (১৫২৬-১৮৫৭) ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ছিল। নীতির দিক থেকে মোগল শাসনাধীন সব সম্প্রাদায়ের লোক আইনের চোখে সমান ছিল। মুসলিম ছাড়াও অন্য জাতির মানুষ সরকারি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ লাভ করতেন। সরকারি রাজত্ব ব্যবস্থাপনায় হিন্দুরা নিয়োগ পেতেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে সার্বিক রাজস্ব ব্যবস্থা সনাতন হিন্দু রীতিনীতি ও ইসলামি পদ্ধতির উপকরণের সংমিশ্রণে সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়। সম্রাট আকবর জিযিয়া কর বিলোপ করেন এবং বহুসংখ্যাক সংখ্যালঘুকে সামরিক-বেসামরিক পদে নিয়োগ দান করে প্রশংসনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেব কখনো সংখ্যালঘুদের ধর্ম-কর্ম পালনে হস্তক্ষেপ করেননি। আকবর ও তার পরবর্তী শাসকরাও জনসাধারণের ধর্ম বিশ্বাস ও ধর্ম-কর্ম পালনে কখনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেননি। মোগল আমলে বাংলার সমাজ ধর্মীয় ভিত্তিতে মুসলমান ও হিন্দু এ দুভাগে বিভক্ত ছিল। হিন্দু আইন অনুসারে হিন্দু সমাজ এবং মুসলিম আইন অনুসারে মুসলিম সমাজ শাসিত হতো। মোগল সুবাদার বা নবাবরা উভয় সমাজের জন্য কোনো সাধারণ আইন চাপিয়ে দেননি। তাই উভয় সমাজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিষয়গুলো স্ব স্ব ধর্মের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো।
হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। বর্তমানে ভারতের মতো উভয় জাতির মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না। সে যুগে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার কথাও কোনো ইতিহাসে পাওয়া যায় না। হিন্দু সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার পূর্ণমাত্রায় ভোগ করত। মুসলিম শাসকরা তাতে কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করতেন না।