প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

চট্টগ্রামের হৃদয়জুড়ে এক নিঃশব্দ অথচ দীপ্তিমান ইতিহাস দাঁড়িয়ে আছে শতাব্দীর সাক্ষ্য হয়ে। সে ইতিহাস কেবল পাথর, চুন কিংবা গম্বুজের সৌন্দর্যে সীমাবদ্ধ নয়। সেখানে আছে আত্মা জাগানো আজানের ধ্বনি, আছে যুগে যুগে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের চোখের অশ্রু, আছে এক কবির পদচিহ্ন যিনি এসেছিলেন হৃদয়ের স্পর্শ খুঁজতে। সে ইতিহাসের নাম আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। যেখানে পাথরের গায়ে (শিলালিপিতে) লেখা বিশ্বাসের ভাষ্য। ‘হে জ্ঞানী, তুমি জগদ্বাসীকে বলে দাও, আজ এ দুনিয়ায় দ্বিতীয় কাবা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যার প্রতিষ্ঠাকাল ১০৭৮ হিজরি।’
মুসলিম বিজয়ের স্মারকস্বরূপকালে সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহাসিক আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ। চাটগছার আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদের সঙ্গে মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের কাহিনি সম্পর্কিত। কথিত আছে এ কেল্লায় এক সময় মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আস্তানা ছিল। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন মোগল শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁর ছেলে উমেদ খাঁ এ কেল্লার ভেতরে প্রবেশ করলে তখন থেকে এর নাম হয় ‘আন্দরকিল্লা’।
পরবর্তীতে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে শায়েস্তা খাঁ ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দ আরবি ১০৭৮ হিজরিতে মোগলদের চট্টগ্রাম বিজয়ের স্মৃতি ধরে রাখতে জলদস্যুদের আস্তানায় মসজিদ নির্মাণ করেন। এ মসজিদের নামকরণ করেন ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ’। নানা কারণে মাঝখানে প্রায় ১১৫ বছর পর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে আজান ও নামাজ বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে হামিদুল্লাহ খাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মুসলমানদের নামাজের জন্য আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদটি আবারও উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মোগল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উপরে ছোট্ট পাহাড়ের ওপর মসজিদটির অবস্থান। নকশা অনুযায়ী মূল মসজিদটি ১৮ গজ (১৬ মিটার) লম্বা, ৭.৫ গজ (৬.৯ মিটার) চওড়া এবং প্রতিটি দেওয়াল প্রায় ২.৫ গজ (২.২ মিটার) পুরু। পশ্চিমের দেওয়ালটি পোড়া মাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি দেওয়াল পাথরের তৈরি। মসজিদের ছাদ মধ্যস্থলে একটি বড় গম্বুজ এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা আবৃত। মসজিদটির আগে তিনটি, উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে।
আন্দরকিল্লা শাহী মসজিদ মুসলিম অস্তিত্বের এক ঐশী ঘাঁটি। মসজিদের দেওয়ালে যেন গাঁথা আছে সেসব সেনানীদের নাম, যারা নামাজে দাঁড়িয়ে চোখ ভিজিয়ে তুলতেন, যাদের তরবারির ধার আর তসবির মাধুর্য ছিল একে অপরের পরিপূরক। এ মসজিদের গম্বুজ ও মিনারে রয়েছে মোগল স্থাপত্যের অপরূপ ছাপ। দেওয়ালে আরবি ক্যালিগ্রাফি, অলংকরণ আর নিপুণ খোদাই প্রতিটি মুসল্লির হৃদয়ে জাগিয়ে তোলে এক ঐশী প্রশান্তি। মেহরাবের কাছে দাঁড়ালে মনে হয়, সময় থেমে গেছে। সেখানে দাঁড়িয়ে আপনি শুধু একজন মুসল্লি নন, আপনি হয়ে উঠবেন ইতিহাসের একজন নীরব দর্শক।
আন্দরকিল্লা মসজিদ যুগ যুগ ধরে শুধু নামাজের স্থান ছিল না, ছিল সমাজ গঠনের পাঠশালা। এ মসজিদ থেকেই শুরু হয়েছে প্রাচীন বাংলায় ইসলামি চেতনার বহমান ধারা, দাওয়াত, তালিম, তাবলিগ ও তাজকিয়া। রমজানে এ মসজিদে তারাবির কণ্ঠ যেন আকাশে মিলিয়ে যায়। কুরআন খতমে যখন ইমামের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘সাদাকাল্লাহুল আজিম’, তখন মনে হয় পুরো নগর থেমে গেছে এক পবিত্র স্তব্ধতায়। এখানে জুমা ও ঈদের দিনে মানুষ শুধু নামাজ পড়তে আসে না, আসে হৃদয়ের উল্লাস ভাগাভাগি করতে। এ যেন চট্টগ্রামের প্রাণের স্পন্দন, ইমানের উৎসব।
১৯২৬ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রথমবার চট্টগ্রাম সফর করেন, যেখানে তিনি ‘চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্র সংসদ’ ও স্থানীয় সামাজিক অঙ্গনে সংবর্ধিত হন। ওই সময়ে তিনি আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে এক সভায় উপস্থিত থেকে ‘কবি সম্রাট’ উপাধি লাভ করেন। সভায় ঘোষণা করা হয়, ‘এই সভা ঘোষণা করিতেছে যে, কবি নজরুল ইসলাম বাংলার মুসলমান সমাজের রত্নস্বরূপ’।
এ সভার মাধ্যমে কবি নজরুলের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব চট্টগ্রামের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে; এরপর তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় প্রচার-সংগ্রাম ও আবৃত্তি করেন। এ সফরে কবি আন্দরকিল্লা মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করেন, তারপর কিছুক্ষণ বসে ছিলেন মসজিদের পাথরের পাটায়। চোখ বুজে তিনি অনুভব করছিলেন সেই আধ্যাত্মিক শীতলতা, যে শান্তি শুধু মসজিদের গম্ভীর গম্বুজ জানে। খতিব সাহেব তাকে বলেছিলেন, ‘আপনার কবিতা যেন হকের আওয়াজ। আপনি কবিতার মাধ্যমে দাওয়াত দিচ্ছেন।’ নজরুলের চোখে তখন অশ্রু, কণ্ঠে কাঁপা ধ্বনি: ‘এই মসজিদে এসে মনে হলো, আমি শুধু কবি নই, একজন সত্যের ফেরিওয়ালা।’ তারপর তিনি ফিসফিস করে বলেছিলেন, ‘আমি বিদ্রোহ করেছি, কিন্তু ইসলামের প্রতি নয়। বরং এই দ্বীনের প্রেমেই আমি জীবনকে উৎসর্গ করেছি।’ কবির এ সংক্ষিপ্ত উপস্থিতিও এই মসজিদকে নিয়ে যায় এক অনন্য উচ্চতায়।
আরও পড়ুন