Advertisement
  • হোম
  • ধর্ম
  • মুসলিম সভ্যতায় রসায়নের সোনালি যুগ

মুসলিম সভ্যতায় রসায়নের সোনালি যুগ

প্রথম আলো

প্রকাশ: ৭ আগস্ট, ২০২৫

গোলাপজলের মিষ্টি সুবাস থেকে শুরু করে কেরোসিনের জ্বালানি শক্তি—মুসলিম সভ্যতার রসায়নবিদরা একটি সমৃদ্ধ রসায়নের জগত উপহার দিয়েছেন। নবম শতাব্দী থেকে তারা পাতন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবনকে আরও সুন্দর ও কার্যকর করেছেন। তাদের আবিষ্কার আধুনিক রসায়নের ভিত্তি স্থাপন করেছে, যা আজও আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়।

এই নিবন্ধে জাবির ইবন হাইয়ান, আল-রাজি ও আল-কিন্দির মতো পথপ্রদর্শকদের হাত ধরে মুসলিম সভ্যতার রসায়নের সোনালি যুগের সন্ধান করা হয়েছে।

পাতনের প্রথম ফল ছিল গোলাপজল, যা ছিল খাবার, পানীয়, সুগন্ধি ও প্রসাধনীতে অপরিহার্য। আল-কিন্দি সুগন্ধির রসায়ন বিষয়ে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন, যাতে ছিল ১০৭টি ভিন্ন সুগন্ধির রেসিপি।

নবম শতকের মাঝামাঝি মুসলিম রসায়নবিদরা স্ফটিকায়ন, জারণ, বাষ্পীভবন, পরিশোধন ও ফিল্টারেশনের মতো প্রক্রিয়া সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। ( ১০০১ ইনভেনশনস: দি এন্ডিউরিং লিগ্যাসি অব মুসলিম সিভিলাইজেশন , ৪র্থ সংস্করণ, পৃ. ৯০)

তাদের পরীক্ষাকে নির্ভুল করতে তারা সূক্ষ্ম দাঁড়িপাল্লা আবিষ্কার করেন, যা রাসায়নিক নমুনা ওজনের জন্য ব্যবহৃত হতো। এই পরীক্ষাগুলোর পাশাপাশি তারা নতুন তাত্ত্বিক ধারণা ও রাসায়নিক ধারণা প্রবর্তন করেন, যার কিছু কিছু টিকে ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। পাতন প্রক্রিয়া ছিল তাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান, যা তরল পদার্থকে ফুটিয়ে তার বিশুদ্ধ উপাদান আলাদা করার একটি শিল্প ছিল।

পাতনের প্রথম ফল ছিল গোলাপজল, যা ছিল খাবার, পানীয়, সুগন্ধি ও প্রসাধনীতে অপরিহার্য। আল-কিন্দি সুগন্ধির রসায়ন বিষয়ে একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন, যাতে ছিল ১০৭টি ভিন্ন সুগন্ধির রেসিপি। ( ১০০১ ইনভেনশনস: দি এন্ডিউরিং লিগ্যাসি অব মুসলিম সিভিলাইজেশন , ৪র্থ সংস্করণ, পৃ. ৯১)

এই প্রক্রিয়া আধুনিক সুগন্ধি শিল্পের ভিত্তি স্থাপন করেছে।

জাবির ইবন হাইয়ান (৭২২-৮১৫), পশ্চিমে গেবার নামে পরিচিত, ছিলেন রসায়নের জনক। কুফায় একজন ওষুধ ব্যবসায়ীর পুত্র হিসেবে তিনি পরিশোধন, স্ফটিকায়ন, পাতন, জারণ ও ফিল্টারেশনের মতো প্রক্রিয়াগুলো উন্নত করেন। (আর. আরনালদেজ-এল. ম্যাসিগনন, ইন অ্যানসিয়েন্ট অ্যান্ড মেডিয়েভাল সায়েন্স , লন্ডন: থেমস অ্যান্ড হাডসন: ১৯৬৩, পৃ. ৪১৩)

তিনি এমন কাগজ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন যা পুড়ত না এবং এমন কালি যা অন্ধকারে পড়া যায়।

তিনি অ্যালেম্বিক স্টিল ব্যবহার করে পাতন প্রক্রিয়া পরিচালনা করতেন, যা তরলকে ফুটিয়ে বিশুদ্ধ উপাদান সংগ্রহের জন্য ব্যবহৃত হতো। তিনি এমন কাগজ তৈরির চেষ্টা করেছিলেন যা পুড়ত না এবং এমন কালি যা অন্ধকারে পড়া যায়।

জাবির পদার্থের শ্রেণিবিভাগ ও রাসায়নিক জ্ঞান সংগঠনের নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো পরবর্তী শতাব্দীতে ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয় এবং ১৭শ শতাব্দী পর্যন্ত পুনঃপ্রকাশিত হয়। ( ১০০১ ইনভেনশনস: দি এন্ডিউরিং লিগ্যাসি অব মুসলিম সিভিলাইজেশন, ৪র্থ সংস্করণ , পৃ. ৯৩)

তাঁর কাজ আধুনিক রসায়নের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মুহাম্মদ ইবন জাকারিয়া আল-রাজি, পশ্চিমে ‘রাজেস’ নামে পরিচিত, ছিলেন জাবিরের উত্তরসূরি। তিনি দি বুক অব দি সিক্রেট অব সিক্রেটস নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে তিনি প্রাকৃতিক পদার্থের সুনির্দিষ্ট শ্রেণিবিভাগে তার পূর্বসূরিদের তুলনায় অধিক দক্ষতা দেখান।

তিনি ১১০০ বছর আগে পাতন, ক্যালসিনেশন ও স্ফটিকায়নের পরীক্ষা-নির্মাণ করেন। তাঁর বাগদাদের পরীক্ষাগারে আধুনিক সুগন্ধি শিল্পের ভিত্তি গড়ে ওঠে। ( ১০০১ ইনভেনশনস: দি এন্ডিউরিং লিগ্যাসি অব মুসলিম সিভিলাইজেশন , ৪র্থ সংস্করণ, পৃ. ৯১)

আল-রাজি ওষুধ প্রস্তুত, সিরামিক গ্লেজ উন্নতকরণ, নতুন চুলের রঙ তৈরি এবং কাপড়ের জন্য জলরোধী রঙ তৈরির প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি মদ পাতন করে বিশুদ্ধ অ্যালকোহল তৈরি করেন, যা জীবাণুনাশক বা কালি তৈরিতে ব্যবহৃত হতো।

মুসলিম রসায়নবিদরা পাতন প্রক্রিয়াকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। তারা কীটনাশক, কাগজ তৈরি, রঙ ও ওষুধের জন্য কৃত্রিম রাসায়নিক উপাদান তৈরি করেন। ১২শ শতাব্দীতে তারা নাফত নামক ক্রুড তেল পাতন করে কেরোসিন তৈরি করেন, যা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তারা ভিনেগার পাতন করে আরও শক্তিশালী অ্যাসিড তৈরি করেন, যা আধুনিক রাসায়নিক শিল্পে গুরুত্বপূর্ণ।

আল-রাজি ওষুধ প্রস্তুত, সিরামিক গ্লেজ উন্নতকরণ, নতুন চুলের রঙ ও কাপড়ের জন্য জলরোধী রঙ এবং মদ পাতন করে বিশুদ্ধ অ্যালকোহল তৈরি করেন।

১৪ শতকের একটি পাণ্ডুলিপিতে গোলাপ ও পানির মিশ্রণ পাতনের চিত্র দেখানো হয়েছে, যেখানে বাষ্প সংগ্রহ করে ঠাণ্ডা করা হয় এবং আটটি অ্যালেম্বিকে পাঠানো হয়। ১৮ শতকের একটি আরবি গ্রন্থে পাতন প্রক্রিয়ার বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, যেখানে অ্যালেম্বিক ও সংগ্রহের পাত্রের কাজ ব্যাখ্যা করা হয়। ( ১০০১ ইনভেনশনস: দি এন্ডিউরিং লিগ্যাসি অব মুসলিম সিভিলাইজেশন , ৪র্থ সংস্করণ, পৃ. ৯৩)

মুসলিম রসায়নবিদদের পাতন প্রক্রিয়া আধুনিক রাসায়নিক শিল্পের ভিত্তি। পাতন ছাড়া পেট্রল, কেরোসিন, অ্যাসফল্ট বা প্লাস্টিকের মতো পদার্থ তৈরি সম্ভব হতো না। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তাদের রসায়ন নিয়ে অনেক গ্রন্থ ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়, যা ইউরোপের রসায়নের বিকাশে সহায়তা করে।

জাবির ও আল-রাজির গ্রন্থ রাসায়নিক জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে কাজ করে। তাদের আবিষ্কার শুধু ব্যবহারিক প্রয়োগেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তাত্ত্বিক রসায়নের বিকাশেও অবদান রাখে। আল-কিন্দির সুগন্ধির রেসিপি থেকে আল-রাজির অ্যালকোহল পাতন—এই সব আবিষ্কার আজকের রাসায়নিক শিল্পের প্রাণশক্তি।

মুসলিম রসায়নবিদদের পাতন প্রক্রিয়া আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ছড়িয়ে আছে। গোলাপজলের সুবাস থেকে কেরোসিনের শক্তি, তাদের আবিষ্কার আধুনিক বিশ্বের অপরিহার্য অংশ। তাদের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অবদান রসায়নের ইতিহাসে একটি সোনালি অধ্যায় রচনা করেছে, যা আজও বিশ্বকে আলোকিত করছে।

সূত্র: মুসলিম হেরিটেজ

Lading . . .