Advertisement
  • হোম
  • ধর্ম
  • স্ত্রী চাহিদা পূরণ করতে না পারলে অনুমতি ছাড়া বিয়ে ...

স্ত্রী চাহিদা পূরণ করতে না পারলে অনুমতি ছাড়া বিয়ে করা যাবে?

যুগান্তর

প্রকাশ: ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

24obnd

মানবজীবনের সবচেয়ে সংবেদনশীল সম্পর্কগুলোর একটি হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। এটি কেবলমাত্র সামাজিক বন্ধন নয়—এটি হৃদয়ের, দায়িত্বের এবং শরিয়তের এক পবিত্র অঙ্গীকার।

এই সম্পর্কে যেমন ভালোবাসা, সহমর্মিতা এবং দায়িত্ববোধ রয়েছে, তেমনি রয়েছে কিছু মৌলিক অধিকার, যার মধ্যে যৌন সম্পর্ক একটি অপরিহার্য দিক।

যখন কোনো স্ত্রীর পক্ষ থেকে স্বামীর এই চাহিদার প্রতি অনাগ্রহ দেখা দেয় বা স্ত্রী শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে ওঠেন, তখন অনেক স্বামীই দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবেন।

কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে শরিয়তসম্মত কি না—এ প্রশ্ন এখনো বহু মানুষের মনে দ্বিধা সৃষ্টি করে।

ইসলামে দ্বিতীয় বিয়ে বৈধ—এ কথা আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনের সূরা নিসার তৃতীয় আয়াতে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।

তিনি বলেন, আর যদি তোমরা ভয় করো যে, স্ত্রীদের মধ্যে ন্যায়বিচার করতে পারবে না, তবে একজনই যথেষ্ট। (সুরা নিসা: ৩)

এই আয়াতেই দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ বিয়ের অনুমতি দেওয়া হয়েছে; কিন্তু সেইসঙ্গে যে শর্তটি অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হয়েছে, সেটি হলো ‘ন্যায়বিচার’। অর্থাৎ একাধিক বিয়ে বৈধ হলেও তা ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া বাধ্যতামূলক।

এখানে মনে রাখা জরুরি, দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নেওয়ার বিষয়ে শরিয়ত কোনো বাধ্যবাধকতা দেয়নি।

ইসলামী আইনবিদদের (ফুকাহা) মধ্যে কোনো মাজহাবই এমন কোনো শর্ত আরোপ করেনি যে, স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে অবশ্যই প্রথম স্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে। হানাফি, মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি চার মাজহাবই এই ব্যাপারে একমত যে, স্ত্রীর অনুমতি না নিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করলেও তা বৈধ এবং সহিহ হবে।

ইমাম ইবনে কুদামা (রহ.) তার বিখ্যাত ফিকহগ্রন্থ আল-মুগনি‑তে বলেন: যদি কোনো ব্যক্তি তার প্রথম স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করে, তাহলে সে বিয়ে শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ এবং তার ওপর কোনো গোনাহ হবে না। (আল-মুগনি, খণ্ড ৭, পৃষ্ঠা ১৩০)

ইমাম নববী (রহ.) সহিহ মুসলিম‑এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন: দ্বিতীয় বিয়ে করলেই তা প্রথম স্ত্রীর প্রতি অন্যায় হয় না, যদি সে তার অধিকার যথাযথভাবে আদায় করে।

এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দৃষ্টিকোণ—শরিয়ত দ্বিতীয় বিয়েকে নিষিদ্ধ করেনি, কিন্তু সেটি যেন কারো প্রতি জুলুম বা অবিচার না হয়, সে বিষয়ে কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

ইসলামী দৃষ্টিতে যদিও স্ত্রীর অনুমতি দ্বিতীয় বিয়ের শর্ত নয়, তথাপি সম্পর্কের সৌন্দর্য, পারিবারিক শান্তি ও সম্মানের খাতিরে এই অনুমতির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। রাসুলুল্লাহ সা. বলেন: “তোমাদের মধ্যে উত্তম সেই ব্যক্তি, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে উত্তম ব্যবহার করে।” (তিরমিযি: ৩৮৯৫)

এই হাদিস শুধুমাত্র একটি নৈতিক বাণী নয়, বরং এটি নির্দেশ করে—একজন মানুষের সত্যিকার উত্তম চরিত্র তার দাম্পত্য জীবনের ভেতরেই প্রতিফলিত হয়।

বিয়েকে যদি আমরা কেবল অনুমতি বা বৈধতার প্রশ্নে সীমাবদ্ধ করি, তাহলে এর মানবিক, মানসিক ও নৈতিক দিকগুলো উপেক্ষিত হয়ে পড়ে। স্ত্রীর যদি শারীরিক অক্ষমতা থাকে, কিংবা মানসিকভাবে সে স্বামীকে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বারবার অস্বীকার করে, তবে স্বামীর জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি শরিয়ত দিয়েছে।

ফাতাওয়া হিন্দিয়া‑তে উল্লেখ আছে: “যদি কোনো স্ত্রী স্বামীর যৌন চাহিদা পূরণে অসমর্থ হন এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাহলে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে।” (ফাতাওয়া হিন্দিয়া, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৫৪৮)

তবে এখানেই শরিয়তের ভারসাম্যপূর্ণ সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। ইসলাম দ্বিতীয় বিয়েকে ‘রুখসাহ’ বা অনুমোদিত বিকল্প হিসেবে চিহ্নিত করে—সেটিকে উৎসাহ দেয় না, বরং যখন সম্পর্কের ভেতর ভারসাম্য থাকে না, তখন এক প্রকার সহনীয় সমাধান হিসেবে দ্বিতীয় বিয়ের পথ দেখায়।

কুরআন সুরা নিসার ১২৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন: “তোমরা নারীদের মধ্যে পূর্ণ ন্যায়বিচার করতে চাইলেও করতে পারবে না—তবে এমন কসরত করো না যাতে একটির প্রতি সম্পূর্ণ ঝুঁকে পড়ে অন্যটিকে ঝুলে পড়া অবস্থায় রেখে দাও।”

এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দ্বিতীয় বিয়ে বৈধ হলেও তার জন্য আত্মিক প্রস্তুতি, ন্যায়পরায়ণতা এবং গভীর আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন।

আজকের সমাজে অনেকেই দ্বিতীয় বিয়েকে ক্ষমতার প্রকাশ হিসেবে ব্যবহার করেন, স্ত্রীকে শায়েস্তা করার অস্ত্র বানান। ইসলাম এমন আত্মঘাতী মানসিকতাকে সমর্থন করে না।

রাসুল সা.‑এর জীবন থেকে আমরা দেখতে পাই, তিনি প্রতিটি স্ত্রীর সঙ্গে ন্যায়ের আচরণ করেছেন, কাউকে গোপনে বিয়ে করেননি, বরং সম্পর্কের ভিত্তি রেখেছেন বিশ্বাস ও পরস্পরের প্রতি সম্মান ও আলোচনার ওপর।

একজন মুসলিম পুরুষ যদি সত্যিই দ্বিতীয় বিয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন, তাহলে তার উচিত হলো—স্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করা, সম্পর্কের সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করা এবং এরপর তার সম্মতি চাওয়া।

শরিয়ত হয়তো অনুমতি ছাড়াও বিয়েকে বৈধ বলেছে, কিন্তু নৈতিকতা, পারিবারিক সৌহার্দ্য এবং সম্পর্কের মর্যাদা—এই তিনটি বিষয়কে অগ্রাধিকার না দিলে সেই বৈধতা একসময় সম্পর্কের উপরই বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায়।

সবশেষে বলা যায়—ইসলাম যেমন নিয়মের ধর্ম, তেমনি এটি মানবিকতার ধর্মও। এখানে বৈধতার পাশাপাশি রয়েছে নৈতিকতার শিক্ষা, কর্তব্যের সঙ্গে রয়েছে ভালোবাসার আলো।

দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি শরিয়ত দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটি যেন হয় পরিপক্বতার সঙ্গে, আলোচনার ভিত্তিতে এবং পূর্ণ ন্যায়পরায়ণতার আত্মবিশ্বাস নিয়ে—এই হল ইসলামের প্রকৃত চেতনা।

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়,কায়রো, মিশর

Lading . . .