নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো ইসলামে ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট, ২০২৫
নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো শুধু একটি মানবিক দায়িত্ব নয়, এটি ইসলামের মূল শিক্ষার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে মুসলিমদের উচিত তাদের নিপীড়িত ভাই–বোনদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
এটি একটি নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্যও বটে, যা আমাদের মানবতার প্রতি বিশ্বাসকে শক্তিশালী করে। আজকের বিশ্বে, যেখানে অত্যাচার ও অন্যায়ের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে, এই দায়িত্ব পালন করা আরও জরুরি হয়ে পড়েছে।
যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের অপমানের সময় তাকে সাহায্য করতে সক্ষম হয়েও সাহায্য না করে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন সবার সামনে অপমানিত করবেন।সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৮৪
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, যা মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘যদি তারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে, তবে তোমাদের দায়িত্ব হলো তাদের সাহায্য করা, তবে যদি তোমাদের ও তাদের মধ্যে কোনো চুক্তি থাকে, তা ভিন্ন কথা। আর আল্লাহ তোমাদের কাজ দেখেন।’ (সুরা আনফাল, আয়াত: ৭২)
হজরত মুহাম্মদ (সা.) নিপীড়িতদের সাহায্যের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের অপমানের সময় তাকে সাহায্য করতে সক্ষম হয়েও সাহায্য না করে, আল্লাহ তাকে কিয়ামতের দিন সবার সামনে অপমানিত করবেন।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪৮৮৪)
এই হাদিস থেকে বোঝা যায়, নিপীড়িতদের প্রতি উদাসীনতা ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। আরেকটি হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘মুসলিমরা তাদের ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি ও সমবেদনায় একটি দেহের মতো। যদি দেহের কোনো অঙ্গে ব্যথা হয়, পুরো দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় ভোগে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২, ৫৮৬)
নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতাও। মানুষ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা এবং নির্যাতিতদের পাশে থাকা। আজকের বিশ্বে আমরা দেখি, অনেক জায়গায় মানুষ অত্যাচার, বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নীরব দর্শক হয়ে থাকা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
ইসলাম এই নৈতিক দায়িত্বের ওপর জোর দেয়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলিম পরস্পর ভাই ভাই। সে তাকে অত্যাচার করে না এবং তাকে শত্রুর হাতে ছেড়ে দেয় না। যে তার ভাইয়ের প্রয়োজনে পাশে থাকে, আল্লাহ তার প্রয়োজনে পাশে থাকেন।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২,৪৪২)
মানে নিপীড়িতদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি শুধু কথায় সীমাবদ্ধ থাকবে না; বরং তা কাজে প্রকাশ পাওয়া উচিত। এটি হতে পারে আর্থিক সাহায্য, মানসিক সমর্থন বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা। যেকোনো উপায়ে আমরা যদি নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে পারি, তা আমাদের মানবিকতা ও ধর্মীয় দায়িত্বের প্রকাশ।
আজকের বিশ্বে আমরা দেখি, অনেক জায়গায় মানুষ অত্যাচার, বঞ্চনা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে নীরব দর্শক হয়ে থাকা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ।
একজন সাধারণ মুসলিম হয়েও নিপীড়িতদের সাহায্য করার জন্য আমরা বিভিন্ন পথ অবলম্বন করতে পারি।
প্রথমত, আমরা তাদের জন্য দোয়া করতে পারি। ইসলামে দোয়া একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আমাকে ডাকো, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’ (সুরা গাফির, আয়াত: ৬০)
দ্বিতীয়ত, আমরা আর্থিক সাহায্য দিতে পারি। নিপীড়িতদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র বা চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা ইসলামে অত্যন্ত পুণ্যের কাজ।
তৃতীয়ত, আমরা সচেতনতা বাড়াতে পারি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বা জনসমক্ষে নিপীড়িতদের অবস্থা তুলে ধরে আমরা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি।
এ ছাড়া আমরা নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে পারি। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা সবাই মিলে আল্লাহর রজ্জুকে দৃঢ়ভাবে ধরে থাকো এবং বিভক্ত হয়ো না।’ (সুরা আল–ইমরান, আয়াত: ১০৩)
এই ঐক্য আমাদের শক্তি বাড়াবে এবং নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে আমাদের সক্ষম করবে।
ইসলামি সমাজে আলেমদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাঁদের দায়িত্ব হলো মুসলিমদের মধ্যে নিপীড়িতদের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করা। তাঁরা মানুষকে শিক্ষা দেবেন যে নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষা।
যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে এমন স্থানে সাহায্য করে, যেখানে তার সম্মান ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, আল্লাহ তাকে এমন জায়গায় সাহায্য করবেন, যেখানে সে সাহায্য কামনা করে।সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৮৪
মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে এমন স্থানে সাহায্য করে, যেখানে তার সম্মান ও মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে, আল্লাহ তাকে এমন জায়গায় সাহায্য করবেন, যেখানে সে সাহায্য কামনা করে।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৮৮৪)
তাই আলেমদের উচিত এই হাদিসের আলোকে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা, যাতে তারা নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ায়।
সারকথা
নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ানো আমাদের ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব। ইসলাম আমাদের শেখায় যে আমরা একে অপরের ভাই। আমাদের ভ্রাতৃত্ব, সহানুভূতি ও ঐক্যের মাধ্যমে আমরা নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়াতে পারি। দোয়া, আর্থিক সাহায্য, সচেতনতা বৃদ্ধি ও ঐক্যের মাধ্যমে আমরা এই দায়িত্ব পালন করতে পারি। আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই মুমিনরা পরস্পর ভাই।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ১০)
এই ভ্রাতৃত্বের দাবি হলো, আমরা আমাদের নিপীড়িত ভাই–বোনদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াব।
আরও পড়ুন