প্রকাশ: ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কোরআন নবী করিম (সা.)-এর উত্তম আদর্শকে আমাদের জন্য অনুপম শিক্ষা হিসেবে সমুজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছে। তিনি ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী, স্বভাবে ছিলেন সবচেয়ে কোমল, আল্লাহর কাছে ছিলেন সবচেয়ে সম্মানিত এবং ইবাদতে সবচেয়ে অগ্রগামী। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী। ’ (সুরা : কলাম, আয়াত : ৪)
দীর্ঘ একটি হাদিসে আয়েশা (রা.) নবী করিম (সা.)-এর চরিত্র বর্ণনা করেছেন।
সাদ ইবনে হিশাম যখন মদিনায় এসে তাঁর কাছে নবীর চরিত্র সম্পর্কে জানতে চাইলেন, তিনি বলেন, ‘তুমি কি কোরআন পড়ো না?’ তিনি জবাব দিলেন : ‘জি, পড়ি। ’ তখন আয়েশা (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর চরিত্র ছিল কোরআন। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৫১২)
এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম নববী (রহ.) বলেন, রাসুল (সা.) ছিলেন সদাচারী, আর তাঁর জীবন ছিল কোরআনের পূর্ণ প্রতিফলন।
আল্লামা মুনাওয়ি (রহ.) বলেন, ‘অর্থাৎ কোরআনের আদেশ-নিষেধ, প্রতিত ও সতর্কবার্তা—সবই তাঁর চরিত্রে প্রতিফলিত হতো।
নবী করিম (সা.)-এর উত্তম গুণাবলি
১. রাসুল (সা.) মিথ্যা ও অসদাচার ঘৃণা করতেন। তিনি কখনো অশ্লীল কথা বলতেন না, অভিশাপও দিতেন না, কারো প্রতি অপমানজনক ভাষা ব্যবহার তো দূরের কথা, এমনকি কাফিরদের বিরুদ্ধেও বদদোয়া করতেন না। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল কখনো অশ্লীল ছিলেন না, অভিশাপ দিতেন না এবং নিন্দাও করতেন না। ’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১৩১)
২. রাসুল (সা.) আশাবাদী মনোভাব পোষণ করতেন এবং হতাশাবাদকে অপছন্দ করতেন।
তিনি ছিলেন সুসংবাদদাতা, সতর্ককারী ও দয়ালু দূত। তিনি ক্ষমাশীল ছিলেন; যারা তাঁর প্রতি অন্যায় করেছে, আল্লাহর আইন লঙ্ঘন ব্যতীত তিনি তাদের ক্ষমা করে দিতেন। আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন : ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) যখনই দুটি কাজের মধ্যে বেছে নেওয়ার সুযোগ পেতেন, তিনি সব সময় সহজটাকেই গ্রহণ করতেন, যতক্ষণ না তাতে কোনো পাপের বিষয় থাকত। আর যদি তাতে পাপ থাকত, তাহলে তিনি সেই কাজ থেকে সবচেয়ে বেশি দূরে থাকতেন। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬১২৬)
৩. রাসুল (সা.) তাঁর সেবকদের প্রতি ছিলেন অত্যন্ত সদয়।
তিনি কখনো তাদের কাজে দোষ ধরতেন না বা তাদের ওপর বিরক্ত হতেন না। আনাস ইবনে মালিক (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি ৯ বছর তাঁর খিদমত করেছি। কখনো তিনি আমাকে বলেননি ‘তুমি কেন এটা করলে?’ কিংবা আমি কিছু না করলে বলেননি ‘তুমি কেন এটা করলে না?’(সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৭৭৩)
৪. রাসুল (সা.) মানুষের প্রয়োজন পূরণে ছিলেন সচেষ্ট। তিনি প্রত্যেককে নিজের নিকটতম ও প্রিয়তম মনে করতেন। তিনি মুমিনদের কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে একজন রাসুল এসেছেন। তোমাদের কষ্ট তাঁকে কষ্ট দেয়; তিনি তোমাদের মঙ্গল কামনা করেন এবং মুমিনদের প্রতি দয়ালু ও করুণাময়। ’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ১২৮)
৫. রাসুল (সা.) ছিলেন অত্যন্ত উদার ও দানশীল। তিনি নিজে দান করতেন এবং অন্যকেও দান করতে উৎসাহিত করতেন। এমনকি তিনি ঋণ পরিশোধ নিয়েও সচেতন থাকতেন। তিনি বলেছেন, ‘আমার কাছে যদি উহুদ পাহাড়ের সমান সোনা থাকত, তাহলেও আমার পছন্দ নয় যে তিন দিন অতিবাহিত হওয়ার পর তার কিছু অংশ আমার কাছে থাকুক। তবে এতটুকু পরিমাণ ছাড়া, যা আমি ঋণ পরিশোধ করার জন্য রেখে দিই। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৩৮৯)
৬. তিনি ছিলেন অত্যন্ত লাজুক ও বিনয়ী, এমনকি গৃহকক্ষে এক কুমারী তরুণীর চেয়েও বেশি। আবু সাঈদ আল-খুদরি (রা.) বলেন, ‘নবী (সা.) ছিলেন তাঁর কক্ষে এক কুমারীর চেয়েও বেশি লাজুক। ’ আয়েশা (রা.) একটি ঘটনার বর্ণনায় তাঁর বিনয়ের উদাহরণ দেন। এক নারী ঋতুস্রাবের পর গোসলের নিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে নবী করিম (সা.) তাকে পদ্ধতি বুঝিয়ে দিলেন এবং বলেন, ‘এক টুকরা কস্তুরী নাও এবং তা দিয়ে নিজেকে পবিত্র করো। ’ নারী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কিভাবে করব?’ এ কথা শুনে নবী করিম (সা.) তাঁর পোশাকের প্রান্ত দিয়ে মুখ ঢেকে লজ্জায় বলেন, ‘আল্লাহ তোমাকে পবিত্র রাখুন, এটা দিয়ে নিজেকে পবিত্র করো। ’ পরে আয়েশা (রা.) ওই নারীকে পাশে নিয়ে ব্যাখ্যা করে দিলেন : ‘রক্তের চিহ্নগুলো অনুসরণ করো। ’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৩১৪)
৭. রাসুল (সা.) মানুষকে সালামের মাধ্যমে শান্তির প্রচার করতেন এবং নিজেই সর্বপ্রথম সালাম দিতেন। কেউ তাঁকে সালাম জানালে তিনি তার থেকেও উত্তমভাবে জবাব দিতেন, যদি না তিনি নামাজে থাকতেন বা প্রাকৃতিক কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তিনি অনুপস্থিতদের কাছে সালাম পৌঁছে দিতে বলতেন এবং কেউ কারো পক্ষ থেকে সালাম দিলে, তিনি উভয়ের প্রতিই জবাব দিতেন। (জাদুল মায়াদ : ২/৩৭১)
৮. রাসুল (সা.) ছিলেন অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। যে-ই তাঁকে ডাকত, তিনি সাড়া দিতেন। তিনি নিজে মুসলমানদের খোঁজখবর নিতেন এবং ছেঁড়া পোশাক নিজ হাতে মেরামত করতেন। তিনি ভবিষ্যতের জন্য কখনো কিছু সঞ্চয় করতেন না। প্রায়ই তিনি ও তাঁর পরিবার না খেয়ে রাত কাটাতেন, কখনো শুধু খেজুর দিয়ে দিন পার করতেন। বেশির ভাগ সময় তাঁদের রুটি ছিল জবের। তাঁকে যা-ই খেতে দেওয়া হতো, তিনি তা সাদরে গ্রহণ করতেন, কোনো ত্রুটি খুঁজে সমালোচনা করতেন না। তিনি নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করতেন, গৃহস্থালির কাজে পরিবারকে সাহায্য করতেন এবং সঙ্গীদের কাজেও অংশগ্রহণ করতেন। তিনি ধৈর্যের সঙ্গে সবার কথা শুনতেন, আলাপ-আলোচনায় অংশ নিতেন, এমনকি অপরিচিত কেউ এলে তাকে আলাদা না করে সমানভাবে বসতে দিতেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, ‘আল্লাহর রাসুল (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে বসতেন, আর কেউ অপরিচিত এলে তাঁকে চিনতে পারত না, যতক্ষণ না প্রশ্ন করত। ’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৬৯৮)
৯. নবী করিম (সা.) মানুষের মধ্যে বিচারকার্যে ছিলেন সম্পূর্ণ ন্যায়পরায়ণ। তিনি সর্বদা এই আয়াতের অনুসরণ
করতেন : ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা আল্লাহর জন্য অবিচল থেকো, ন্যায়ের সাক্ষ্য বহন কোরো। কোনো সম্প্রদায়ের বিদ্বেষ যেন তোমাদের ন্যায়বিচার থেকে বিরত না রাখে। ন্যায়বিচার কোরো—এটাই তাকওয়ার নিকটবর্তী। আর আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত। ’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৮)
১০. রাসুল (সা.) সব সময় প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতেন, তবে সম্পূর্ণ ভরসা রাখতেন আল্লাহর ওপর। তাঁর সংকল্প কখনো দুর্বল হতো না, দ্বিধাগ্রস্ত হতো না। তাঁর অন্তর ছিল দৃঢ় ঈমান ও অটল বিশ্বাসে পরিপূর্ণ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসুলের মধ্যে তোমাদের জন্য আছে উত্তম আদর্শ। ’ (সুরা : আহজাব, আয়াত : ২১)
অতএব, একজন মুমিনের কর্তব্য হলো নবী করিম (সা.)-এর অনুকরণ করা। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যদি তোমরা তাঁর আনুগত্য করো, তবে তোমরা হেদায়েত পাবে। ’ (সুরা : নুর, আয়াত : ৫৪)
আরও পড়ুন