প্রকাশ: ৯ আগস্ট, ২০২৫

ইসলাম পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত সব জায়গায় রয়েছে ইসলামের ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবিধান। ইসলামের দৃষ্টিতে প্রতিটি মানুষ গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ। মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামী বিধান মানুষের মর্যাদা এবং পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন নিশ্চিত করে। মানুষ হিসেবে আমির-ফকির, রাজা-প্রজা, ধনী-গরিব সবাই সমান। প্রতিটি নাগরিকের বক্তব্য-মন্তব্য ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। তাই দেশে পরিচালনার আসনে যারা বসেন তাদেরও কর্তব্য, নাগরিক হিসেবে প্রতিটি মানুষের মতামত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা। ইসলামের দৃষ্টিতে দেশ পরিচালনার মূল ভিত্তি কোরআন ও সুন্নাহ এবং তার আলোকে প্রণীত শরিয়ত। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় ইসলাম জনমতকে উপেক্ষা করেনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে জনমত বিশেষ গুরুত্বও দিয়েছে।
ইসলামের বিধান অনুসারে শাসকরা জনগণের কথা শুনবে। ইসলামে শাসক ও নাগরিকের ভেতর কোনো মাধ্যম বা প্রতিবন্ধক অনুমোদিত নয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি জনসাধারণের কোনো দায়িত্বে অধিষ্ঠিত হলো এবং দুর্বল ও অসহায় মানুষ থেকে নিজেকে আড়াল করে রাখে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তার আড়ালে থাকবেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস: ২২০৭৬)। তৃতীয় খলিফা ওমর (রা.)-এর যুগে কুফার গভর্নর সাআদ বিন আবি ওয়াক্কাস (রা.)-এর ব্যাপারে অভিযোগ আসে যে, পৃথক ভবন নির্মাণ করেছেন এবং তাতে দরজা লাগিয়েছেন, ফলে জনসাধারণ চাইলেই তার কাছে যেতে পারে না। তখন ওমর (রা.) তাকে মদিনায় ডেকে পাঠান। (তারিখে তাবারি: ৩/১৫০)।
জনগণের কল্যাণের জন্য মতামতের ভিত্তিতেই কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উত্তম। ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান মূলনীতি হলো পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা তাদের প্রতিপালকের আহ্বানে সাড়া দেয়, নামাজ আদায় করে, নিজেদের পরামর্শের মাধ্যমে নিজেদের কাজ সম্পন্ন করে।’ (সুরা: আশ-শুরা, আয়াত: ৩৮)। তবে ইসলামের দৃষ্টিতে সবার পরামর্শ ও মতামতের মূল্য সমান নয়। যারা আল্লাহভীতি, প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ও জাগতিক জ্ঞান, ইনসাফ ও ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তার অধিকারী মতামত প্রদানে তারা অন্যদের তুলনায় অগ্রগামী হবে।
মদিনার রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের মতামত নিতেন নবীজি (সা.)। নবীজির সামনে কোনো ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিষয় এলে এবং এ বিষয়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত না এলে তিনি সাহাবিদের সাধারণ মজলিসে মতামত গ্রহণ করতেন। যেমন বদর যুদ্ধের বন্দি, উহুদ যুদ্ধের অভিযান শুরু, উসমান (রা.)-এর রক্তের বদলা নেওয়া ইত্যাদি। ইসলামী রাষ্ট্র জনসাধারণকে রাষ্ট্রের সমালোচনা করার অনুমতি দিয়েছে। শুধু অনুমতি দিয়েছে তা নয়, বরং ব্যক্তির যদি মনে হয়, শাসক বা রাষ্ট্র জনসাধারণের প্রতি জুলুম করছে, তবে তার প্রতিবাদ করা মুমিনের দায়িত্ব। খালিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, আমরা নবী (সা.)-কে বলতে শুনেছি, মানুষ যখন কোনো অত্যাচারীকে অত্যাচার করতে দেখে (এবং শক্তি থাকার পরও) তার দুই হাত চেপে ধরে না, অবিলম্বে আল্লাহ তাদের সবাইকে শাস্তি দেবেন। আমর (রহ.) হুসাম (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, যে জাতির মধ্যে পাপ কাজ হতে থাকে, এগুলো বন্ধ করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা বন্ধ করা হচ্ছে না, অচিরেই sআল্লাহ তাদের সবাইকে চরম শাস্তি দেবেন। (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস: ৪৩৩৮)।
ইসলামী ইতিহাসের সোনালি যুগে শাসকরা জনমতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। বিশেষত ইসলামের মহান চার খলিফার সবাই রাষ্ট্র পরিচালনায় সাধারণ মানুষের মতামতকে গুরুত্ব দিতেন। ইসলামের প্রথম খলিফা আবু বকর সিদ্দিক (রা.) দায়িত্ব গ্রহণের পর তার শাসন কাজের ব্যাপারে জনমতের প্রত্যাশা করে বলেন, ‘বন্ধুরা, আমাকে আপনাদের নেতা নিযুক্ত করা হয়েছে। যদিও আমি আপনাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ও মর্যাদাবান নই। আমি যদি কল্যাণকর কাজ করি, তাহলে আমাকে সবাই সাহায্য করে যাবেন আর যদি কোনো খারাপ কাজ করি তাহলে অবশ্যই আমার সংশোধন করে দেবেন। সততা ও সত্যবাদিতা হলো আমানত। আর মিথ্যা ও কপটতা হলো খেয়ানত।’ (মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস: ২/৩৫৫)।
ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক শুধু জনগণের মতামতের অপেক্ষা করবে না, বরং নিজের ব্যাপারে জনমত গ্রহণ করবে, যেন নিজেকে যাচাই করা যায়। বিশেষত রাষ্ট্রের প্রাজ্ঞ ও পণ্ডিতজনের মতামত নেবে। ওমর (রা.) খলিফা নিযুক্ত হওয়ার পর একবার বিশিষ্ট সাহাবি মুহাম্মদ বিন মাসলামা (রা.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে কেমন দেখছেন? তিনি বললেন, আপনাকে আমি যেভাবে দেখতে ভালোবাসি সেভাবেই দেখছি এবং সেটা আপনার কল্যাণকর। আমি আপনাকে দেখছি, রাষ্ট্রের সম্পদ একত্র করতে সামর্থ্যবান, কিন্তু তা থেকে নির্মোহ এবং তা বণ্টনে ন্যায়পরায়ণ। যদি আপনি বিচ্যুত হতেন তবে আপনাকে সোজা করে দিতাম, যেভাবে সাঁচের ভেতর রেখে তীর সোজা করা হয়। ওমর (রা.) বললেন, সব প্রশংসা মহান আল্লাহর, যিনি আমাকে এমন জাতির নেতা বানিয়েছেন, আমি বিচ্যুত হলে তারা আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে। (তারিখুল ইসলাম লিজ-জাহাবি: ৪/১১৪)।
সোনালির যুগের মুসলিম শাসকরা জনমতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। জাবির বিন সামুরা (রা.) বলেন, কুফাবাসী সাআদ (রা.)-এর বিরুদ্ধে ওমর (রা.)-এর কাছে অভিযোগ করলে তিনি তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন এবং আম্মার (রা.)-কে তাদের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। (সহিহ বোখারি, হাদিস ৭৫৫)। আল্লামা ইবনে হাজার (রহ.) লেখেন, ৭৭৫ হিজরিতে মিশরের জনসাধারণ পুলিশ বিভাগের প্রধান আলাউদ্দিন বিন আরবের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করলে তাকে পদচ্যুত করা হয়। (ইম্বাউল গুমরি)। তবে জনমতের নামে বিশৃঙ্খলা কাম্য নয়। খলিফা ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) রাষ্ট্র পরিচালনায় জনমতকে বিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি নিজে বাজারে ঘুরে বেড়াতেন, রাতের অন্ধকারে শহর পরিদর্শন করতেন। তার পরও তিনি জনমতের নামে উত্থাপিত বিষয়গুলোকে যাচাই করে দেখতেন। যেমন কুফাবাসীর অভিযোগ পেয়ে তিনি সাআদ (রা.)-কে প্রশাসক পদ থেকে সরিয়ে দিলেও তাদের অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য সেখানে লোক পাঠান। আর তারা সেখানে গিয়ে বিপরীত দৃশ্য দেখতে পান। ইমাম বোখারি (রহ.) বর্ণনা করেন, ওমর (রা.) কুফার অধিবাসীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে এক বা একাধিক ব্যক্তিকে সাআদ (রা.)-এর সঙ্গে কুফায় পাঠান। তারা প্রতিটি মসজিদে গিয়ে সাআদ (রা.) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করল এবং উপস্থিত মুসল্লিরা সবাই তার ভূয়সী প্রশংসা করল। (সহিহ বোখারি, হাদিস: ৭৫৫)।
আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন।
লেখক: ইমাম ও খতিব
আরও পড়ুন