করাচিতে নিজের বাড়িতে আত্মজীবনী হাতে হানিফ মোহাম্মদছবি: উৎপল শুভ্র

হানিফ মোহাম্মদের সঙ্গে সেই সন্ধ্যার স্মৃতি

দেখতে ছোটখাটো ছিলেন বলে ভালোবেসে সবাই ডাকত ‘লিটল মাস্টার’, কিন্তু ক্রিকেটীয় কীর্তিতে সেই ছোটখাটো লোকটাই কী বিশাল! হানিফ মোহাম্মদ শুধু নিজের সময়ের না, পাকিস্তানের ক্রিকেট ইতিহাসেই অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট ৮১ বছর বয়সে পরপারে চলে যাওয়া কিংবদন্তি এই ক্রিকেটারের বাড়িতে বসে তাঁর সাক্ষাৎকার নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল প্রথম আলোর প্রধান ক্রীড়া সম্পাদক উৎপল শুভ্রর। কিংবদন্তির মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে নিয়ে উৎপল শুভ্রর সেই স্মৃতিচারণা

‘লিটল মাস্টার’কে এতটা ‘লিটল' দেখাবে, এটা ভাবিনি। এর আগে ১৯৯৬ বিশ্বকাপে দেখেছি, দেখেছি ১৯৯৯ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিন পাকিস্তান দলের নেট প্র্যাকটিসের সময়ও। তখনো দেখে একটু বিস্ময়ই জেগেছে—এই ছোটখাটো লোকটিই ট্রুম্যান-স্ট্যাথাম-গিলক্রিস্টদের ছোড়া আগুনে গোলার সামনে অমন বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন, লড়েছেন অমন বীরত্বের সঙ্গে! ১৬ ঘণ্টা ১০ মিনিট ব্যাট করে হেরে যাওয়া টেস্ট ম্যাচ ড্র করেছেন, পাকিস্তানের পক্ষে টেস্টে প্রথম জোড়া সেঞ্চুরিও, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে তাঁর ৪৯৯ রেকর্ড হয়ে ছিল ৩৫ বছর। ২০০১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় তাঁর করাচির ইউনিভার্সিটি রোডের বাড়িতে হানিফ মোহাম্মদকে দেখে সেই বিস্ময়ও ম্লান। হানিফ মোহাম্মদ যেন আরও ছোট হয়ে গেছেন!

পরনে একটা হাওয়াই শার্ট আর প্যান্ট, চোখে সেই পরিচিত চশমা—মিনিট দশেক অপেক্ষার পর যে ভদ্রলোক সামান্য খোঁড়াতে খোঁড়াতে সামনের সোফায় এসে বসলেন, ড্রেসিংরুমে ঢুকতেই হাসিমুখ যে বিশাল ছবিটি স্বাগত জানিয়েছিল, সেটির সঙ্গে তাঁকে মেলানোই মুশকিল। সেই ছবিটি যৌবনের হানিফ মোহাম্মদের। বলেও ফেললাম কথাটা। হানিফ মোহাম্মদ হাসলেন, ‘আই অ্যাম অ্যান ওল্ড ম্যান নাউ।’

যখন এ কথা বলছেন, এর তিন মাস পরই ৬৭তম জন্মদিন, সে হিসাবে তো ‘ওল্ড ম্যানই’। নাতি-নাতনির সঙ্গই তখন তাঁর আনন্দের প্রধান উৎস। ছেলে শোয়েব মোহাম্মদের দুই সন্তান শেহজার আর শেহজিনের সঙ্গেই কাটে দিনের বেশির ভাগ সময়। ইন্টারভিউর মাঝখানে ১১ বছর বয়সী শেহজার দুবার এসে বসলও দাদার পাশে। কারণটা শুধুই ছেলেমানুষি কৌতূহল নয়। একদিন যে তাকেও এমন ইন্টারভিউ দিতে হবে, এ নিয়ে যে কোনোই সন্দেহ নেই ওই পুঁচকে ছেলেটির মনে! হেসে উড়িয়ে দেবেন না কথাটা। হানিফ মোহাম্মদের কথাটা শুনে নিন আগে, ‘শেষ পর্যন্ত কী হবে, কে জানে! তবে এখন পর্যন্ত ও যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে বিশ্ব ক্রিকেটের মোহাম্মদ পরিবার থেকে আরেকজন উপহার পাওয়ারই কথা। প্রতিভার ব্যাপারটা পুরোপুরি বোঝা যাবে চার-পাঁচ বছর পর, তবে এটুকু বলতে পারি, আমাদের কেউই ওর মতো এতটা ক্রিকেটের পাগল ছিলাম না।’

ওয়াজির মোহাম্মদ (২২), হানিফ মোহাম্মদ (৫৫), মুশতাক মোহাম্মদ (৫৭) এবং সাদিক মোহাম্মদ (৪১) চার ভাই মিলে খেলেছেন মোট ১৭৩টি টেস্ট। আরেক ভাই রাইস মোহাম্মদ অল্পের জন্য মিস করেছেন টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার গৌরব।

বিকেলে তাঁর ইন্টারভিউ চেয়ে যখন টেলিফোন করি, হানিফ মোহাম্মদ তখন শেহজারকে প্র্যাকটিস করাতে নিয়ে যাচ্ছেন। ‘ক্রিকেটই ওর ধ্যানজ্ঞান। এত দিন ও পেপসি ক্রিকেট ক্লিনিকে ছিল। এখন তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওর জন্য কাস্টমস স্পোর্টস ক্লাব মাঠে দু-তিন ঘণ্টার জন্য সাড়ে তিন শ রুপি দিয়ে নেট ভাড়া করতে হয়’—হানিফ যখন এ কথা বলছেন, শেহজার একটু দূরে দাঁড়িয়ে শ্যাডো প্র্যাকটিস করায় মগ্ন। স্বাভাবিক এটাই। মোহাম্মদ পরিবারের রক্তেই যে ক্রিকেট। পাকিস্তানে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট শুরু হওয়ার পর এই ১৯৯৯ পর্যন্ত মোহাম্মদ পরিবারের কেউ না কেউ ছিলই সার্কিটে।

ওয়াজির মোহাম্মদ (২২), হানিফ মোহাম্মদ (৫৫), মুশতাক মোহাম্মদ (৫৭) এবং সাদিক মোহাম্মদ (৪১) চার ভাই মিলে খেলেছেন মোট ১৭৩টি টেস্ট। পাকিস্তানের পক্ষে করেছেন ১০,৯৩৮ রান এবং ২৯টি সেঞ্চুরি। আরেক ভাই রাইস মোহাম্মদ অল্পের জন্য মিস করেছেন টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ার গৌরব, ১৯৫৫ সালে এই ঢাকাতেই ভারতের বিপক্ষে টেস্ট শুরুর আগের দিন অধিনায়ক তাঁকে পরদিন খেলার কথা জানিয়ে দিলেও ম্যাচের দিন সকালে তিনি হয়ে যান দ্বাদশ ব্যক্তি। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৮ পর্যন্ত পাকিস্তানের খেলা প্রথম ১০১টি টেস্টের মধ্যে মাত্র একটিতেই দলে ছিলেন না মোহাম্মদ ভাইদের কেউ। এসব তথ্য পুরো ক্রিকেট বিশ্বেরই জানা। হানিফ মোহাম্মদ সগর্বে জানালেন, মোহাম্মদ পরিবারের উৎপাদিত ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটারের সংখ্যা ১০।

১৯৬৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করাচিতে হানিফের খেলা শেষ টেস্টে অভিষেক সাদিক মোহাম্মদের। মুশতাক মোহাম্মদ ছিলেন আগে থেকেই। একই টেস্টে তিন ভাই খেলার মাত্র তৃতীয় উদাহরণ এটি।

পাঁচ ভাইয়ের পর হানিফের ছেলে শোয়েব তো টেস্টই খেলেছেন ৪৫টি। রাইসের তিন ছেলে আসিফ, শাহিদ ও তারিক এবং সাদিকের ছেলে ইমরান টেস্ট পর্যন্ত যেতে না পারলেও খেলেছেন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট। ক্রিকেট ইতিহাসে এক পরিবার থেকে ১০ জন ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটার বেরোনোর আর কোনো উদাহরণ নেই। তেমনি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে এক ইনিংসে তিন ভাইয়ের সেঞ্চুরি করার একমাত্র উদাহরণটিও মোহাম্মদদেরই গড়া। ১৯৫৪-৫৫ মৌসুমের কায়েদ-ই-আজম ট্রফির ফাইনালে কম্বাইন্ড ইউনিভার্সিটির বিপক্ষে করাচির হয়ে ওয়াজির করেন ১১৮, রাইস ১১০ ও হানিফ ১০৯।

ঘণ্টা দুয়েকের কথোপকথনে এই প্রসঙ্গেই প্রথম পেয়েছিলাম হানিফ মোহাম্মদের রসবোধের পরিচয়, ‘আমরা বয়স অনুযায়ী রান করেছিলাম সে ম্যাচে।’

১৯৬৯ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করাচিতে হানিফের খেলা শেষ টেস্টে অভিষেক সাদিক মোহাম্মদের। মুশতাক মোহাম্মদ ছিলেন আগে থেকেই। একই টেস্টে তিন ভাই খেলার মাত্র তৃতীয় উদাহরণ এটি। মোহাম্মদ ভাইদের ক্ষেত্রে সেটিই যে একমাত্র উদাহরণ হয়ে থাকবে—তখন তা মোটেই ভাবেননি হানিফ। কিন্তু সেই টেস্টের পরই একরকম বাধ্য হয়েই অবসরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হয় তাঁকে।

কেন, কীভাবে তা হয়েছিল, তা-ও বললেন হানিফ মোহাম্মদ। কথা বলেন অনুচ্চ স্বরে, তারপরও হতাশা-তিক্ততা-ক্ষোভ সবই ফুটে উঠল তাতে, ‘সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান আবদুল হাফিজ কারদার কয়েকজন সাংবাদিককে দিয়ে আমাকে খবর পাঠান, নিজে থেকে অবসর না নিলে আমাকে বাদ দেওয়া হবে। আমার ভাইদের ভবিষ্যৎ নিয়েও প্রচ্ছন্ন হুমকি ছিল এর সঙ্গে। অথচ তখন আমার বয়স মাত্র ৩৪, আরও তিন-চার বছর খেলার ক্ষমতা আছে—এটা কদিন আগে কারদারই বলেছিলেন আমাকে। জানি না, যার অধিনায়কত্বে আমার টেস্ট খেলার শুরু, তিনি কেন এমন করলেন!’

সেই ‘অবিচারের’ স্মৃতি আমৃত্যু পুড়িয়ে গেছে হানিফ মোহাম্মদকে, তবে ছেলে শোয়েব এর চেয়েও বড় অবিচারের শিকার হয়েছে বলেই দাবি করেছিলেন তিনি, শোয়েবকে কখনোই স্বস্তিতে খেলতে দেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত তো ফর্মে থাকতেই বাদ দিয়ে দেওয়া হলো।’ এর আগেই অবশ্য আরেকটি ইতিহাস গড়া হয়ে গেছে মোহাম্মদদের। টেস্ট ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি করা একমাত্র পিতা-পুত্র হিসেবে রেকর্ড বুকে নাম উঠে গেছে হানিফ-শোয়েবের। একটা সময় টেস্টে পাকিস্তানের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি ছিল হানিফ মোহাম্মদের আর ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড শোয়েব মোহাম্মদের। শোয়েবের ১২৬ রানের রেকর্ড এখন অতীত হয়ে গেলেও ১৯৫৭-৫৮ সিরিজে ব্রিজটাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হানিফের অপরাজিত ৩৩৭ রানের সেই মহাকাব্যিক ইনিংস এখনো হয়ে আছে পাকিস্তানের পক্ষে টেস্টে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।

হানিফ মোহাম্মদের দাবি যদি সত্যিই হয়, তাহলে প্রশ্ন জাগতে বাধ্য, মোহাম্মদ পরিবারের ছেলে বলে যেখানে শোয়েব মোহাম্মদের বাড়তি সুবিধা পাওয়ার কথা, সেখানে তাঁর প্রতি অবিচার হলো কেন? হানিফের ধারণা এর মূলে আছে হিংসা, ‘মোহাম্মদ পরিবারের এমন সাফল্য অনেকেই সহ্য করতে পারেনি। দেশভাগের পর ভারতের জুনাগড় থেকে সহায়–সম্বলহীনভাবে এখানে এসেছিলাম আমরা। শুরু থেকেই আমাদের সংগ্রাম করতে হয়েছে, আমাদের পক্ষে কথা বলার কেউ ছিল না। কিন্তু আমাদের পারফরম্যান্সের কারণে কেউ আমাদের আটকাতে পারেনি।’

সেই সংগ্রামে মোহাম্মদ ভাইদের সবচেয়ে বড় প্রেরণা ছিলেন মা আমির বী। মা নিজেও ছিলেন খেলোয়াড়। ব্যাডমিন্টন ও ক্যারম খেলে অনেক পুরস্কার জিতেছেন, ছেলেরাও খেলার স্বার্থে তাঁর কাছ থেকে পেয়েছেন সব ধরনের প্রশ্রয়। ভারত থেকে পাকিস্তানে পাড়ি জমানোর দুবছর পরই মারা যান মোহাম্মদ ভাইদের বাবা। এর পর থেকে হানিফ মোহাম্মদদের মা-বাবা দুই-ই আমির বী। কোনো ম্যাচ থাকলে সন্ধ্যায় ছেলেদের পারফরম্যান্স জানার জন্য ছটফট করতেন মা এবং অবধারিতভাবেই কারও না কারও ওপর রেগে যেতেন। সেই রাগ যে সব সময় বাজে পারফরম্যান্সের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকত, তা নয়।

এ রকমই একটি মজার ঘটনা বলতে গিয়ে হাসি ফুটে উঠল হানিফের মুখে, ‘কায়েদ-ই-আজম ট্রফির একটি ম্যাচে আমি আর মুশতাক খেলছিলাম পিআইএর পক্ষে আর করাচির পক্ষে সাদিক। সাদিকের রান যখন ৯৬, আমি মুশতাককে ফরোয়ার্ড শর্ট লেগ থেকে সরিয়ে দ্বিতীয় গালিতে নিয়ে যাই। এই ফিল্ডিং পরিবর্তনের পরপরই সাদিক মুশতাককে ক্যাচ দেয়। রাতে আম্মা এ কথা জানার পর আমার ওপর ভীষণ রেগে যান। আমি যতই তাঁকে বোঝাতে যাই, এটা ছিল শুধুই খেলা, ততই রাগ বাড়ে তাঁর। আমার কারণে ছোট ভাই সেঞ্চুরি পায়নি, এটা তিনি মানতেই পারছিলেন না। ওই ঘটনার পর দুদিন আমার সঙ্গে কথাই বলেননি তিনি।’

৫৫ টেস্টে ১২টি সেঞ্চুরিসহ ৪৩.৯৮ গড়ে তাঁর রান ৩৯১৫, পাকিস্তানের পক্ষে টেস্টে প্রথম জোড়া সেঞ্চুরি। পাকিস্তান থেকে বেরোনো প্রথম ‘গ্রেট’ ব্যাটসম্যানও। তারপরও হানিফ মোহাম্মদ নামটি উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকি সবকিছু ছাপিয়ে জ্বলজ্বল করে ওঠে দুটি সংখ্যা—৩৩৭ ও ৯৭০। আরেকটি সংখ্যা ৪৯৯-ও মনে হয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। ১৯৫৭-৫৮ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ব্রিজটাউন টেস্টে ৯৭০ মিনিট ব্যাট করে অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচ বাঁচানো সেই ৩৩৭ এবং এর এক বছর পর ভাওয়ালপুরের বিপক্ষে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে ৪৯৯ রানের রেকর্ড ভাঙা ইনিংস দুটিই হয়ে আছে হানিফ মোহাম্মদের গ্রেটনেসের সবচেয়ে বড় প্রমাণ।

পাকিস্তান থেকে বেরোনো প্রথম ‘গ্রেট’ ব্যাটসম্যান বলছিলাম, একদিক থেকে সেটাই হয়েছিল হানিফের কাল, হাতে সব স্ট্রোকই ছিল তাঁর, ক্যারিয়ারের শুরুতে ছিলেন দারুণ আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান, কিন্তু দলের স্বার্থে সব ভুলে শুধু উইকেটে টিকে থাকার দিকেই মন দিতে হয়েছিল তাঁকে। এবং এই টিকে থাকার দিকে মন দিয়েই হানিফ মোহাম্মদ গড়েছেন তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বিখ্যাত কীর্তিটি।

১৯৫৮ সালের জানুয়ারির ব্রিজটাউন টেস্ট সাক্ষী হয়ে আছে হানিফের বিস্ময়কর মনঃসংযোগ ও প্রয়োগক্ষমতার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৯ উইকেটে ৫৭৯ রান তুলে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করার পর পাকিস্তান অলআউট হয়ে গিয়েছিল মাত্র ১০৬ রানে। সেই প্রথম ইনিংসে ১৭ রান করতেই দারুণ লড়তে হয়েছিল হানিফকে, ‘অমন ফাস্ট উইকেটে এর আগে কোনো দিনই খেলিনি আমি। তার ওপর তখন তো আর হেলমেট ছিল না। শুধু হেলমেট কেন, এখনকার মতো এলবো গার্ড, চেস্ট গার্ড এমনকি থাই প্যাড পর্যন্ত ছিল না। বোলিংও ছিল খুব ভালো—গিলক্রিস্ট, স্মিথ, সোবার্স, অ্যাটকিনসন ব্রাদার্স, ভ্যালেন্টাইন...।’

প্রায় গ্ল্যাডিয়েটরের রূপ ধরে ব্যাট করতে নামা এখনকার ব্যাটসম্যানরা কল্পনাই করতে পারবেন না ব্যাপারটি। হেলমেট, থাই প্যাড, চেস্ট গার্ড কিছুই নেই—বোলারদের ছুড়ে দেওয়া আগুনের গোলা সামলাতে শুধু ব্যাটই ছিল তখন ব্যাটসম্যানদের সম্বল! থাই গার্ডের বিকল্প হিসেবে হানিফ মোহাম্মদ ট্রাউজারের বাঁ দিকের পকেটে ভরে নিয়েছিলেন মোটা একটা রুমাল, ভাবা যায়! সেই টেস্টটি ছিল ছয় দিনের। তখন তো আর ওভারের সংখ্যা বেঁধে দেওয়া ছিল না, পাঁচ ঘণ্টা করে ছয় দিন খেলে মোট ৩০ ঘণ্টা পুরো করার ব্যবস্থা।

৪৭৩ রানে পিছিয়ে থেকে পাকিস্তান যখন ফলো অন করতে নামল, ম্যাচের তখনো সাড়ে তিন দিন বাকি। ম্যাচের ফলাফল নিয়ে কারও মনেই কোনো সন্দেহ নেই, কতক্ষণে তা শেষ হয়, সেটিই ছিল প্রশ্ন। হানিফও কি তা-ই ভেবেছিলেন? হানিফ বললেন, ‘সত্যি বলতে কি, আমি কোনো কিছুই ভাবিনি। ইমতিয়াজকে নিয়ে যখন ওপেন করতে যাই, যত বেশি সময় সম্ভব টিকে থাকার চিন্তাই ছিল শুধু মাথায়। ৯১ রান করার পর ইমতিয়াজ গিলক্রিস্টের বলে এলবিডব্লু হয়ে যায়, যদিও ও ছিল আনলাকি, আমার ধারণা, বলটি লেগ স্টাম্পের বাইরে চলে যাচ্ছিল। এক দিন কাটিয়ে দিলাম, এরপর দুই দিন...।’

বড় ভাই ওয়াজির মোহাম্মদ ছিলেন হানিফের প্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস, সঙ্গে যোগ হয়েছিলেন অধিনায়ক আবদুল হাফিজ কারদারও, ‘আমার রুমমেট তখন ওয়াজির ভাই, তিনি তো আমাকে উৎসাহ দিতেনই। অধিনায়ক কারদারও প্রতিদিনই খেলা শেষে আমাদের রুমে আসতেন। আমি খেলা শেষে মিউজিক শোনা বা পাকিস্তানি খাবার খাওয়ার জন্য বন্ধুদের বাড়িতে যেতাম। ফেরার পর দেখতাম, কারদার আয়নায় আমার জন্য “ইউ আর দ্য অনলি হোপ”, “ইউ ক্যান ডু ইট”–এ রকম সব মেসেজ লিখে রেখে গেছেন। শেষ দিনের আগের রাতে তিনি লিখলেন, “কাল টি পর্যন্ত যদি টিকে থাকতে পারো, তাহলেই আমরা ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলব।” কাকতালীয়ভাবে পরদিন টির একটু আগে আমি ব্র্যাডম্যানের ৩৩৪ রান পেরিয়ে গেলাম। টির ঠিক পরই অফ স্পিনার ডেনিস অ্যাটকিনসনের একটি লাফিয়ে ওঠা বল আমার ব্যাটের প্রায় হ্যান্ডলে লেগে পেছনে গেল, উইকেটকিপার গ্যারি আলেকজান্ডার বাতাসে লাফিয়ে নিলেন দারুণ এক ক্যাচ।’

ততক্ষণে ম্যাচ বাঁচানোর অবিশ্বাস্য কাজ করা হয়ে গেছে হানিফ মোহাম্মদের। সেই আনন্দের মধ্যেও অবশ্য একটু বিষাদ ঠিকই ছুঁয়ে যাচ্ছিল হানিফকে, ‘ম্যাচ বাঁচিয়ে ফেলেছি, সে জন্য খুশি লাগলেও লেন হাটনের ৩৬৪ রানের রেকর্ডের এত কাছে এসে আউট হয়ে যাওয়ায় একটু খারাপও লাগছিল।’ সেটি তো ছিল তাৎক্ষণিক অনুভূতি, এত বছর পর সেই ইনিংসটির দিকে ফিরে তাকালে প্রথম কী মনে পড়ে, এই প্রশ্নটাও করেছিলাম। হানিফ মোহাম্মদ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মনঃসংযোগ। একমুহূর্তের জন্যও আমার মনঃসংযোগে চিড় ধরেনি। আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে। আমি তখন বাউন্সার দিলেই হুক করতাম, গিলক্রিস্টকেও তা-ই করছিলাম। কিন্তু গিলক্রিস্টের মতো উইকেটও এতই দ্রুত ছিল যে আমার টাইমিং হচ্ছিল না। একটি ওভার শেষে অন্য প্রান্তে যাওয়ার সময় ক্লাইড ওয়ালকট আমাকে বললেন, ‘তুমি গিলক্রিস্টকে হুক করতে যেয়ো না। হি ইজ টু কুইক ফর ইউ।’ ওয়ালকটের এই পরামর্শ আমার অনেক কাজে এসেছে।

টেস্টে সর্বোচ্চ রানের বিশ্ব রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও দীর্ঘতম ইনিংস খেলার যে রেকর্ড গড়েছিলেন হানিফ মোহাম্মদ, সেটি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ড হিসেবে টিকে ছিল ৪০ বছরের বেশি। সেই রেকর্ড ভেঙে গেলেও টেস্টে দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ডটি ভাঙবে বলে মনে হয় না।

হানিফ মোহাম্মদের মনে পড়েছিল আরেকটি স্মৃতি এবং সেটি রীতিমতো ব্যতিক্রমী, ‘শেষ দিনের খেলা শুরুর আগে নেটে প্র্যাকটিস করার সময় সে ইনিংসে আমাকে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় ফেলা ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান পেসার এরিক অ্যাটকিনসন এসে বল করতে শুরু করল। আমি যেমন অবাক হলাম, স্থানীয় সাংবাদিকেরাও। তারা এসে অ্যাটকিনসনকে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, একটু পরে খেলা আর তুমি প্রতিপক্ষের নট আউট ব্যাটসম্যানকে নেটে বল করছ! অ্যাটকিনসন জবাব দিলেন, “দুদিন তো আমি ওকে আউট করতে আপ্রাণ চেষ্টা করে দেখলাম, আমি বুঝে গেছি ওকে আউট করা আমার কাজ নয়।” আমার মনে হয়, টেস্ট ক্রিকেটে কোনো বোলারের প্রতিপক্ষের নেটে এসে বল করার আর কোনো উদাহরণ নেই।’ টেস্টে সর্বোচ্চ রানের বিশ্ব রেকর্ড ভাঙতে না পারলেও দীর্ঘতম ইনিংস খেলার যে রেকর্ড গড়েছিলেন হানিফ মোহাম্মদ, সেটি ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ড হিসেবে টিকে ছিল ৪০ বছরের বেশি। সেই রেকর্ড ভেঙে গেলেও টেস্টে দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ডটি ভাঙবে বলে মনে হয় না। হানিফ অবশ্য তা মানতে চাননি, ‘রেকর্ড নিয়ে এমন বলা যায় না। তবে এই রেকর্ডটি ভাঙতে হলে অনেক কিছু পক্ষে থাকা চাই।’

তা হানিফের ইনিংসটা কত মিনিট স্থায়ী হয়েছিল? রেকর্ড বইয়ে লেখা আছে ৯৭০ মিনিট। কিন্তু এ নিয়ে আপত্তি আছে হানিফের। সেই ইনিংস শেষে একটি গ্রামোফোন রেকর্ড উপহার পেয়েছিলেন, যাতে ছিল তাঁর ইনিংসটির ধারাবিবরণী। আউট হওয়ার পর হানিফ যা শুনেছিলেন, এই গ্রামোফোন রেকর্ডটিও প্রমাণ দেয় তারই—ওই ইনিংসটি ছিল ৯৯৯ মিনিটের। কিন্তু ‘ক্রিকেটের বাইবেল’ উইজডেন অ্যালমানাক অনড় রয়েছে সেই ৯৭০ মিনিটেই। হানিফ ওই প্রমাণ পাঠানোর পর ওই ৯৭০ মিনিটের পর শুধু লেখা হয়েছে, ‘হানিফ মনে করেন আসলে তা ৯৯৯ মিনিট’।

তাঁর কীর্তি থেকে ২৯ মিনিট কমিয়ে দেওয়া নিয়ে হানিফ মোহাম্মদকে বেশ ক্ষুব্ধই মনে হয়েছিল। তা স্বীকার করতেও কোনো দ্বিধা ছিল না তাঁর, ‘কেন ক্ষুব্ধ হব না? সত্যিই যদি আমি ৯৯৯ মিনিট ব্যাটিং করে থাকি, রেকর্ডে কেন ৯৭০ মিনিট লেখা থাকবে? আপনিই বলুন না, এটা কি ঠিক?’

ব্রিজটাউনে ৩৩৭ রানের মহাকাব্যিক ওই ইনিংস খেলার পরও একটা আক্ষেপ ছিল হানিফ মোহাম্মদের। টেস্ট এবং ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে দীর্ঘতম ইনিংসের রেকর্ড গড়েছেন ঠিকই, কিন্তু এর চেয়েও বড় একটা রেকর্ড করার সুযোগও যে ছিল। লেন হাটনের বিশ্ব রেকর্ড ভাঙার সুযোগ। সেই রেকর্ড তো ছিল আর মাত্র ২৭ রান দূরেই। আক্ষেপটা আরেকটু বেড়ে যায়, যখন ঠিক পরের টেস্টেই গ্যারি সোবার্সকে ওই রেকর্ড ভেঙে ফেলতে দেখেন। শুধু দেখেন বললে পুরোটা বলা হয় না। লেন হাটনকে ছাড়িয়ে যাওয়া সিঙ্গেলটি হানিফের বলেই নিয়েছিলেন সোবার্স। ডানহাতি অকেশনাল অফ স্পিনার হানিফ সেই বলটি করেছিলেন বাঁ হাতে। আম্পায়ার তা জানানোর পর সোবার্স যা বলেছিলেন, তা ক্রিকেটের অমর উক্তির একটি, ‘চাইলে ও দুই হাতেও বল করতে পারে।’ যা মনে করিয়ে দেওয়ায় হানিফ শুধু হেসেছিলেন।

১৯৫৮ সালের জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে হানিফ মোহাম্মদের ওই ৩৩৭। পরের বছর জানুয়ারিতে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ডটি করার পরও একটা আক্ষেপ ঠিকই সঙ্গী হয়েছিল তাঁর। ৪৯৯ রানে রানআউট হয়ে গেলে কার না আক্ষেপ হবে! অন্তত ওই মুহূর্তের জন্য ৪৯৯ রান করার তৃপ্তির চেয়ে আর ১ রান করতে না পারার দুঃখই তো বড় হয়ে ওঠার কথা। হানিফের দুঃখ আরও বেড়ে গিয়েছিল একটা ভুল–বোঝাবুঝির শিকার হয়েছিলেন বলে। সে কথায় একটু পরে আসি।

করাচি পার্সি ইনস্টিটিউট মাঠে অনুষ্ঠিত সেই ম্যাচে ৩০০ করার পর বড় ভাই ওয়াজির মোহাম্মদ হানিফকে বলেছিলেন, ‘তোমাকে বিশ্ব রেকর্ড ভাঙতে হবে।’ ক্রিকেটের সব আইন আর রেকর্ড মুখস্থ থাকার কারণে যে ওয়াজিরকে পাকিস্তান দলের সবাই ডাকত ‘উইজডেন’ বলে, তিনিও সেই ম্যাচে একই দলে খেলছেন। ‘বিশ্ব রেকর্ডটা কত’ জিজ্ঞেস করে হানিফ জবাব পেলেন, ‘মাত্র ৪৫২’। হানিফ বড় ভাইয়ের মুখে ‘মাত্র’ শুনে হেসে ফেললেন, ‘আপনি নিশ্চয়ই রসিকতা করছেন। আমার মাত্র ৩০০ হয়েছে, তা ছাড়া আমি এখনই খুব ক্লান্ত।’ বড় ভাই তাতেও দমলেন না, ‘আজ রাতে আমি তোমাকে দারুণ একটা ম্যাসাজ করে দেব। এরপর ভালো একটা ঘুম দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

ঠিক হয়েও ছিল। পরদিন হানিফ রেকর্ড তো ভাঙলেনই; পরে ব্রায়ান লারা যা করেছেন, প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে সেই ৫০০ রান করার গৌরব থেকে তাঁকে বঞ্চিত করল শুধুই দুর্ভাগ্য। সে ঘটনা বলতে গিয়ে এত বছর পরও হানিফের কণ্ঠে ফুটে উঠেছিল আক্ষেপ, ‘দিনের শেষ ওভার শুরুর সময় আমি ছিলাম ৪৯০-এর ঘরে। দুই বল বাকি থাকতে আমি দেখলাম, স্কোরবোর্ডে আমার রান ৪৯৬। পঞ্চম বলটিকে ডিপ এক্সট্রা কাভারে পাঠিয়ে সেখানে মিসফিল্ড হওয়ায় আমি স্ট্রাইক ধরে রাখতে দ্বিতীয় রানটি নিতে গিয়ে রানআউট হয়ে যাই। অথচ আউট হয়ে ফেরার সময় দেখি আমার রান ৪৯৯। আমি তো অবাক। পরে জানলাম, স্কোরবোর্ডে কাজ করছিল যে ছেলেটি, সে ঠিক অঙ্কটি খুঁজে না পাওয়ায় দেরি করেছিল আমার রানটা বসাতে, আসলে দুই বল বাকি থাকতে আমার রান ছিল ৪৯৮। এটা জানার পর আমার খুব মন খারাপ হলো। তখন আমি এত সেট ছিলাম যে রান ৪৯৮ জানলে পঞ্চম বলটিতে ঝুঁকি না নিয়ে ২ রান নেওয়ার জন্য শেষ বলটি পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম।’

হয়তো সেই দুঃখে সান্ত্বনা দিতেই কে একজন এসে তাঁকে বলেছিল, ‘ভালোই হয়েছে। ৫০০ করলে তোমাকে একেবারে নিঃসঙ্গ হয়ে যেতে হতো। আর কাউকে সঙ্গে পেতে না তুমি।’ এই ভয়ে ভীত না হয়ে ব্রায়ান লারা ঠিকই পাঁচ শ করে ফেলেছেন। ১৯৯৪ সালে ৫০১ রান করে তাঁর রেকর্ড ভাঙার পর কিছুক্ষণের মধ্যেই লারাকে টেলিফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন হানিফ মোহাম্মদ। ছোট ভাই মুশতাক ছিলেন সেখানে, তিনিই ফোনে ধরিয়ে দেন লারাকে। রেকর্ড হারানোর দুঃখ থাকলেও একটাই সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছেন হানিফ মোহাম্মদ—‘লারা স্যার গ্যারি সোবার্সের দেশের লোক।’ ত্রিনিদাদের লারা আর বারবাডোজের সোবার্সের দেশ হয়তো ভিন্ন; তবে হানিফ যা বুঝিয়েছিলেন, তা হলো দুজনই তো ওয়েস্ট ইন্ডিজের। সোবার্স শুধু হানিফ মোহাম্মদের অল-টাইম ফেবারিট ক্রিকেটারই ছিলেন না, এই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান অলরাউন্ডারের মতো কাউকে যে ক্রিকেট বিশ্ব আর দেখতে পাবে না—এ নিয়েও কোনো সন্দেহ ছিল না তাঁর মনে।

বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম একটি আলাদা দেশে পরিণত হওয়ার পর আর এখানে আসা হয়নি হানিফ মোহাম্মদের। তবে আসতে ইচ্ছা হয়েছে অনেকবারই, বিশেষ করে ঢাকায়। ঢাকার প্রতি তাঁর বাড়তি ভালোবাসাটা ফুটে বেরিয়েছিল অনেকবারই। হানিফ মোহাম্মদের টেস্ট সেঞ্চুরির তালিকায় চোখে বুলালে এটিকে অবশ্য খুবই স্বাভাবিক বলেই মনে হবে। তাঁর ১২টি টেস্ট সেঞ্চুরির ৩টিই এই ঢাকা স্টেডিয়ামে, এর মধ্যে দুটি আবার একই টেস্টে।

১৯৫৫-৫৬ সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ঢাকাতে ১০৩ রান ছিল হানিফ মোহাম্মদের দ্বিতীয় টেস্ট সেঞ্চুরি। সেই সুখস্মৃতি অবশ্য গৌণ হয়ে যায় বছর পাঁচেক পর ১৯৬০-৬১ তে টেড ডেক্সটারের ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। সেই টেস্টের দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি করে পাকিস্তানের পক্ষে জোড়া সেঞ্চুরির প্রথম কীর্তিটি গড়েন হানিফ মোহাম্মদ। ঢাকায় হানিফ মোহাম্মদের আরেকটি ফার্স্ট ক্লাস সেঞ্চুরি আছে, তবে তা টেস্টে নয়।১৯৬৬-৬৭ মৌসুমে সেই সেঞ্চুরির প্রতিপক্ষ হিসেবে তিনি যে ‘সিলোন’-এর কথা বললেন, সেটি এখন শ্রীলঙ্কা নামে পরিচিত। যেখানে তাঁর এত সাফল্য, সেই ঢাকার প্রসঙ্গ উঠতেই হানিফ মোহাম্মদের কণ্ঠে যে তাই আবেগ ফুটে বেরোবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! ‘ঢাকা আমার খুব লাকি মাঠ। ওখানে খেলাটা আমি সব সময়ই খুব এনজয় করেছি। আমি ঢাকায় খেলেছি, চট্টগ্রামেও গেছি, আসলে বাংলাদেশে মাঠের বাইরেও আমার সময়টা খুব ভালো কাটত। আমার বয়স তখন কম, তা ছাড়া আমি দেখতেও খুব ছোটখাটো, ও কারণে সবাই আমাকে খুব ভালোবাসত। লোকজন আমার জন্য বাসা থেকে খাবার তৈরি করে নিয়ে আসত।’

৩৩৭ রানের ওই রেকর্ড ভাঙা কীর্তিই টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে স্মরণীয় ইনিংস হতে পারে, তবে সেটিকেই তাঁর সেরা ইনিংস মনে করতেন না হানিফ মোহাম্মদ। সেই মর্যাদা ১৯৬৭ সালে লর্ডসে অপরাজিত ১৮৭ রানের। ৯ ঘণ্টার বেশি সময়ব্যাপী ৫৫৬ মিনিটের ওই ইনিংসের সময় ইংল্যান্ডের একটি পত্রিকায় লেখা হয়েছিল, ‘অনলি দ্য পুলিশ ক্যান রিমুভ হানিফ’, সঙ্গে ছাপা হয়েছিল একটি কার্টুন—দুজন পুলিশ উইকেট থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে হানিফ মোহাম্মদকে। এই গল্প বলার সময় পাশে বসা হানিফ মোহাম্মদের নাতি শেহজার অবাক হয়ে দাদুকে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যিই কি তোমাকে পুলিশে ধরেছিল নাকি?’

আদর করে শেহজারের মাথার চুল এলেমেলো করে দিতে দিতে হানিফ জানিয়েছিলেন, লর্ডসের ওই ইনিংসের মতো ১৯৬০-৬১তে বোম্বের ব্র্যাবোর্ন স্টেডিয়ামে রানআউট হওয়ার আগে ১৬১ রানের ইনিংসটিও একটি আলাদা জায়গা নিয়ে আছে তাঁর মনে। তেমনি ১৯৫৪ সালে নটিংহামের ট্রেন্ট ব্রিজে ৫১ রানও। কারণটাও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘আমার অনেক সেঞ্চুরির চেয়েও ওই ইনিংসটিকে এগিয়ে রাখি আমি। এই টেস্টেই ইংল্যান্ডের পক্ষে ডেনিস কম্পটন ২৭৮ করেছিল। আমরা ব্যাট করার আগে বৃষ্টি হয়েছিল, তখন তো আর উইকেট ঢেকে রাখার নিয়ম ছিল না। বৃষ্টিভেজা সেই উইকেটে ট্রুম্যান ও স্ট্যাথামকে খেলাটা ছিল দারুণ এক চ্যালেঞ্জ। আমি আউট হয়েছিলাম অ্যালেক বেডসারের বলে, স্পিনারদের বলে উইকেটকিপার যেমন দাঁড়ায়, বেডসারের বলেও তেমনি স্টাম্পের ঠিক পেছনে দাঁড়ানো গডফ্রে ইভান্স ডাইভ দিয়ে অসাধারণ এক ক্যাচ নিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিল আমায়। ইভান্সের ওই ক্যাচ নেওয়ার ছবিটি আমি এখনো রেখে দিয়েছি।’

উইকেট-বোলিং-কন্ডিশন—এসব কারণে কখনো কখনো সেঞ্চুরির চেয়েও বড় হয়ে যায় হাফ সেঞ্চুরি। ১৯৫৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ট্রেন্ট ব্রিজ টেস্টে ৫১ রানের ইনিংসটাকে যে কারণে তাঁর অনেক সেঞ্চুরির চেয়েও এগিয়ে রাখতেন হানিফ মোহাম্মদ। অ্যালেক বেডসারের বোলিংয়ে স্টাম্পের ঠিক পেছনে দাঁড়ানো গডফ্রে ইভান্স যে ক্যাচটা নিয়ে হানিফকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, তা এমনই দুর্দান্ত ছিল যে ওই ছবিটা রেখে দিয়েছিলেন হানিফ।

আমি ১৭ বছরে ৫৫টি টেস্ট খেলেছি। মাঝেমধ্যে এমনও হয়েছে, আমি হয়তো কোনো টেস্টে সেঞ্চুরি করলাম, দেখা গেল তারপর আর কোনো ম্যাচ নেই, পরের টেস্ট এক বছর পর। অথচ আমার মনে আছে, একবার জাভেদ মিয়াঁদাদ এক বছরেই খেলেছিল ১৪টি টেস্ট।
হানিফ মোহাম্মদ

এ কথার সূত্র ধরেই প্রশ্নটা করেছিলাম, গডফ্রে ইভান্সই কি তাহলে আপনার দেখা সেরা উইকেটকিপার? এই প্রশ্নের উত্তরে ‘আরও অনেক ভালো উইকেটকিপারই দেখেছি’ বলে ‘অ্যালান নট ভালো ছিল, আমাদের ওয়াসিম বারিও ছিল ভালো, এখন রশিদ লতিফ ভালো, মঈন ভালো’ এমন একটি দীর্ঘ তালিকা পেশ করে ফেলেছিলেন হানিফ মোহাম্মদ। কিন্তু তাঁকেই যখন বলা হলো, তাঁর পছন্দের একটা বিশ্ব একাদশ বেছে নিতে, সভয়ে মাথা নাড়ার দৃশ্যটা এখনো চোখে ভাসে, ‘না না, এটি এভাবে তাড়াহুড়ো করে করার জিনিস নয়। এমনিতে আড্ডায় বসে এসব নিয়ে কথা বললে অন্য কথা, কিন্তু আপনি তো এটি পত্রিকাতে ছাপবেন।’

হানিফের এমন শঙ্কিত হওয়ার বড় কারণ ছিল, তখন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের দল নিয়ে ক্রিকেট বিশ্বে তুমুল হইচই হচ্ছে। ডনের মৃত্যুর পর যা প্রকাশিত হয়েছে রোনাল্ড পেরির লেখা ‘ব্র্যাডম্যানস বেস্ট’ নামে এক বইয়ে। সেটির প্রসঙ্গ তুলেই হানিফ বিশ্ব একাদশ গড়তে অপারগতার কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ব্র্যাডম্যানের টিম নিয়ে কেমন হইচই হচ্ছে, তা তো জানেনই। তা ছাড়া আমি এভাবে বিশ্ব একাদশ গড়ায় চেয়ে প্রতি পজিশনে দুই–তিনজন করে খেলোয়াড় বাছাই করাটাকেই বেশি ভালো মনে করি, এটি অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং, এ থেকে সবাই নিজের পছন্দের দলও বেছে নিতে পারবেন।’ তা করতেও দু–তিন দিন সময় চেয়ে নিয়েছিলেন। যে কারণে আর তা জানাই হয়নি।

হঠাৎ শেষ হয়ে যাওয়া টেস্ট ক্যারিয়ার নিয়ে একটু দুঃখবোধ ছাড়া বড় কোনো আক্ষেপ ছিল না হানিফ মোহাম্মদের মনে। তবে আধুনিক যুগে যে হারে ক্রিকেট হয়, তা দেখে মাঝেমধ্যে সামান্য একটু আফসোসের কথা বলেছিলেন, ‘আমি ১৭ বছরে ৫৫টি টেস্ট খেলেছি। মাঝেমধ্যে এমনও হয়েছে, আমি হয়তো কোনো টেস্টে সেঞ্চুরি করলাম, দেখা গেল তারপর আর কোনো ম্যাচ নেই, পরের টেস্ট এক বছর পর। অথচ আমার মনে আছে, একবার জাভেদ মিয়াঁদাদ এক বছরেই খেলেছিল ১৪টি টেস্ট।’

নিজে খেলতে পারেননি, এ জন্য আফসোস ছিল, কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের প্রতি ঈর্ষাবোধের কোনো চিহ্নই খুঁজে পাইনি তাঁর মধ্যে। এমনকি জাভেদ মিয়াঁদাদ যে ক্রিকেটের মান ‘একবারে রসাতলে গেছে’ বলে নিয়মিত চিৎকার করেন, হানিফ মোহাম্মদ তাতে কণ্ঠ মেলাতেও রাজি হননি। মিয়াঁদাদের এই দাবির কথা শুনে প্রথমে তো মৃদু হেসে প্রশ্ন করলেন, ‘ও কি এই কথা সিরিয়াসলি বলেছে? আমার তা মনে হয় না।’ মিয়াঁদাদের মুখ থেকে একাধিকবার এ কথা শুনেছি বলে জানানোর পর মাথা নাড়তে নাড়তে বলেছিলেন, ‘এটা ওর ব্যক্তিগত মত। কিন্তু আমি এর সঙ্গে একমত নই। আমি শুধু একটাই সমস্যা দেখি—বেশি বেশি ওয়ানডে খেলার কারণে ব্যাটসম্যানদের টেকনিক খারাপ হয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানের এখন আর লম্বা ইনিংস খেলার ক্ষমতা নেই।’ এই দুঃখ হানিফ মোহাম্মদকেই সবচেয়ে বেশি ছুঁয়ে যাওয়ায় কথা, হানিফ মোহাম্মদ নামটিই তো সমার্থক লম্বা ইনিংসের সঙ্গে।

হানিফ মোহাম্মদের বাড়িতে ঢুকেছিলাম সন্ধ্যা ছয়টায়, কথায় কথায় কখন যে দুই ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে, টেরই পাইনি। পেলাম, যখন থেমে গেল রেকর্ডারে ঢোকানো দ্বিতীয় ক্যাসেটটিও। শব্দটা শুনে হাসি ফুটে উঠেছিল হানিফ মোহাম্মদের মুখে, ‘আপনাকে আমার অটোবায়োগ্রাফি দিয়ে দিচ্ছি। সবকিছুই ওখানে পাবেন।’ তাহলে অটোবায়োগ্রাফিতে নেই, এমন কোনো মজার ঘটনা বলুন’, এই অনুরোধের দারুণ একটা জবাব দিয়েছিলেন, ‘সেই ঘটনা যদি এতই মজার হবে, তাহলে তা আমি আমার অটোবায়োগ্রাফি থেকে কেন বাদ দেব, বলুন?’

ঘণ্টা দুয়েক আগে পরিচিত হওয়া ভিনদেশি এক ক্রিকেট লেখককে শুভকামনা জানিয়ে খুব যত্ন করে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন তাঁর আত্মজীবনীতে। হানিফ মোহাম্মদের আত্মজীবনী ‘প্লেয়িং ফর পাকিস্তান’–এর একটি কপি আমার ক্রিকেট-সম্পদের তালিকায় যোগ করে যখন তাঁর ঘর থেকে বেরোচ্ছি, দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন পাকিস্তানি কিংবদন্তি। কীর্তিতে নয়, হয়তো হৃদয়-মহিমাতেও নয়, তবে অন্তত শারীরিক আকৃতিতে এই ‘মাস্টার’ যে সত্যিই কত ‘লিটল’, আবার তা টের পেলাম নতুন করে। আমি এমন কোনো দীর্ঘদেহী মানব নই, তারপরও হানিফ মোহাম্মদ পড়ে রইলেন আমার কাঁধসমান উচ্চতায়।

ফিরতি পথটায় কেন যেন হানিফ মোহাম্মদের ছোটখাটো চেহারাটাই ঘুরপাক খেতে থাকল মাথায়। হানিফ মোহাম্মদের একটা কথাই মনে পড়ল বারবার। ব্রায়ান লারা তাঁর ৪৯৯ রানের রেকর্ড ভেঙে দেওয়ার পর এই উচ্চতার রহস্যের দিকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। একটু আগে সে কথা বলেছেন আমাকেও, ‘আপনি দেখবেন, টেস্ট ক্রিকেটে বড় ইনিংস খেলা বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানই উচ্চতায় খাটো। সোবার্স, গ্রেগ চ্যাপেল, গ্রাহাম গুচ—এমন কয়েকজনকে বাদ দিলে ট্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন বা বড় ইনিংস খেলেছেন এমন ব্যাটসম্যানদের বাকি কেউই লম্বা নন।’ এর রহস্যটা অবশ্য ব্যাখ্যা করতে পারেননি হানিফ মোহাম্মদ, ‘আমি জানি না কারণটা কী! তবে একটা কিছু নিশ্চয়ই আছে।’ কারণটি কী কে জানে, তবে ডন ব্র্যাডম্যান, লেন হাটন, সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা...গ্রেট ব্যাটসম্যানদের সারিতে ছোটখাটো লোকগুলোরই ভিড় বেশি। তাঁদের অনেকের সম্পর্কেই ব্যবহৃত হয়েছে ‘লিটল মাস্টার’ শব্দযুগল। তবে এই বিশেষণটি হানিফ মোহাম্মদ সম্পর্কেই ব্যবহৃত হয়েছিল প্রথম। তা প্রথম ব্যবহার করেছিলেন বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার ওমর কুরেশি। সেই ‘লিটল মাস্টার’-এর সঙ্গে কাটানো দু্ই ঘণ্টার স্মৃতি যে এত দিন পরও স্মরণীয় হয়ে আছে, তাতে ক্রিকেটীয় আলোচনার চেয়ে হানিফ মোহাম্মদের বিনয়ী এবং মৃদুভাষী আচরণের ভূমিকাও কম নয়।

ধন্যবাদ হানিফ মোহাম্মদ, স্মরণীয় এক সন্ধ্যার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আত্মজীবনীটা হাতে নিলেই আপনার কথা মনে পড়ে। অটোগ্রাফটা দেখলে আরও বেশি। আপনি নেই, তবে সেই সন্ধ্যার স্মৃতি আছে; আর আছে এই বইটা।