এশিয়া কাপ ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের আক্ষেপের শেষ নেই। সেই আক্ষেপটা হলো-হাতের মুঠোতে পেয়েও আজ পর্যন্ত মহাদেশীয় এই ক্রিকেট টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে না পারা।
বাংলাদেশের দুয়ারে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো অবারিত সুযোগ এসেছিল। কিন্তু বারবারই ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হওয়ার সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। একথা সত্য এশিয়া কাপের কোনো আয়োজনে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হলে অবশ্যই ক্রিকেটে তা আলাদা এক আভিজাত্য ও সৌন্দর্য তৈরি করত। কিন্তু না সেটা হয়নি। আর এ কারণেই বাংলাদেশের বড় এক আক্ষেপ রয়েছে ওই এশিয়া কাপ ঘিরে। সেই আক্ষেপ আর সাথে একগুচ্ছ স্বপ্ন নিয়ে এশিয়া কাপের এবারের আয়োজনে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। আজ প্রথম ম্যাচে মাঠে নামবে টাইগার বাহিনী। অবশ্য মাঠে নামার আগে সম্প্রতি পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও নেদারল্যান্ডসকে টি- টোয়েন্টিতে সিরিজ হারানোর সুখস্মৃতি রয়েছে।
দুবাইতে ৯ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া এশিয়া কাপ ক্রিকেটের সতের তম আয়োজন এবার। আজ ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ৮.৩০ মিনিটে হংকং-এর মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। প্রথম ম্যাচে আফগানিস্তানের কাছে ৯৪ রানের বড় ব্যবধানে হেরেছে হংকং। স্বভাবতই জয়ের লক্ষ্যে তারা আজ মরিয়া হয়ে লড়বে।
বাংলাদেশের জন্যও আজকের লড়াইটা সব সমীকরণেই গুরুত্বপূর্ণ। আজকে কোনো কারণে ম্যাচ হাতছাড়া হলে সেটা হবে মহাবিপর্যয়। এবারের আয়োজনে ‘এ’ এবং ‘বি’ গ্রুপে চারটি দল করে মোট ৮টি দেশ এশিয়া কাপে অংশগ্রহণ করেছে। গ্রুপ ‘এ’ তে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমীরাত ও ওমান। গ্রুপ ‘বি’তে রয়েছে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ও হংকং। নতুন দল হিসেবে হিসেবে এবার অভিষেক ঘটেছে ওমানের। আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গ্রুপপর্বের লড়াই শেষে শুরু হবে সুপার ফোর পর্বের লড়াই। সুপার ফোর পর্ব শেষে ২৮ সেপ্টেম্বর এশিয়া কাপ ক্রিকেট ২০২৫-এর ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে দুবাইতে।
এশিয়া কাপ ক্রিকেটের সূচনা হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। সেবারও আয়োজক দেশ ছিল আরব আমিরাত। প্রথম আয়োজনে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ভারত এবং রানার্স আপ হয়েছিল শ্রীলংকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত আয়োজনেও চ্যাস্পিয়ন দেশ ভারত। গত ১৬ আসরে এ পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৮ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ক্রিকেট বিশ্বের এই অন্যতম শক্তি। পরিসংখ্যানে এরপরেই রয়েছে শ্রীলংকা। মোট ৬ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এই দেশটি। পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মাত্র ২ বার।
বাংলাদেশসহ অন্য কোনো দল এখনও চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করতে পারেনি। তবে নিঃসন্দেহে দুর্ভাগা দেশ বাংলাদেশ। অন্তত দুবার চ্যাস্পিয়নশীপটা হাতছাড়া হয় কেবলই ভাগ্যের ফেরে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে-বাংলাদেশের হাসি আনন্দ কেউ ঠেকাতে পারত না। কিন্ত ক্রিকেট ইতিহাসের গল্পগুলো এরকমই ভীষণ নির্মম। মিনিট বা সেকেন্ডের ব্যবধানে যেখানে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
একটু পেছনে চোখ মেলানো যাক। ২০১২ সালে এশিয়া কাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সবচেয়ে সুবর্ণ সুযোগটি উঁকি দেয়। সেবার দেশের মাটিতে মিরপুরে ফাইনালে পাকিস্তানের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। পাকিস্তান প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২৩৬ রান করে। এই রানের জবাব দিতে গিয়ে তামিম, সাকিব দূর্দান্ত ব্যাটিং করে দলকে জয়ের কাছাকাছি পৌঁছে দেয়। কিন্তু শেষ জুটি মাহমুদউল্লাহ এবং শাহাদাত শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাসের অভাবে দলকে চ্যাম্পিয়নশীপ উপহার দিতে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশ দল সেদিন সবার হ্নদয় ভেঙেচুরে পরাজিত হয় মাত্র ২ রানে। ২০১৬ সালে আবারও সুযোগ আসে বাংলাদেশের সামনে।
এ বছর থেকেই এশিয়া কাপ টি টোয়েন্টি ফরমেটে পরিবর্তিত হয়। ৬ মার্চ মিরপুরে ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ১৫ ওভারে (ওভার কমিয়ে আনা হয়) ৫ উইকেট হারিয়ে বাংলাদেশ ১২২ রান করে। বাংলাদেশের এই রানের জবাবে ৮ উইকেটে বাংলাদেশকে হারিয়ে ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ নতুন এক ইতিহাস রচনা করতে পারতো। এবারও এশিয়া কাপের ফাইনালে উঠে বাংলাদেশ। প্রতিপক্ষ হিসেবে ফের পায় ভারতকে। মাশরাফির নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাট করতে নেমে সব উইকেট হারিয়ে ২২২ রানের টার্গেট দিতে সক্ষম হয়। ভারতের ব্যাটিং-এর জবাবে বাংলাদেশের বোলাররা শক্তপোক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলে। কিন্ত ভারত ৩ উইকেটে জয়লাভে সক্ষম হয়। তবে এই ম্যাচেও বাংলাদেশ অনেকটা ভাগ্যের কারণেই হেরে যায়। কেননা ভারতের ব্যাটসম্যানদের ইনিংসের শেষ বলটা পর্যন্ত খেলতে হয়।
এবারের সতের তম আয়োজনে প্রথম পর্বের লড়াইয়ে বাংলাদেশ গ্রুপ ‘বি’ তে। এই গ্রুপে প্রতিপক্ষ দল শ্রীলংকা, আফগানিস্তান ও হংকং। আজ ১১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সময় ৮.৩০ মিনিটে হংকং-এর মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।
টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশের বিপক্ষে একবারই খেলেছে হংকং। কিন্তু সেই লড়াই- এ বাংলাদেশ নয়, জয় পেয়েছিল ক্ষুদ্র দেশ হংকং। সে ২০১৪ সালের কথা। সেবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে চট্টগ্রামের মাঠে বাংলাদেশ প্রথমে ব্যাট করতে নামে।
১৬.৩ ওভার খেলে বাংলাদেশ ১০৮ রানে অল আউট হয়। জবাবে হংকং দল ১৯.৪ ওভার খেলে এক ঐতিহাসিক জয় করতে সক্ষম হয়। সেই দলে থাকা বাবর হায়াত ও নিজাহাত খান দুজনেই এবারের হংকং টিমে রয়েছেন। এ দুজনই জন্মসূত্রে পাকিস্তানি। হংকং দলের পক্ষে খেলছেন অনেকদিন ধরে। সুপার ফোরে ওঠার লড়াই-এ হংকং-এর পর বাংলাদেশকে ১৩ সেপ্টেম্বর শ্রীলংকা এবং ১৬ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তানকে মোকাবিলা করতে হবে। আজ হংকংকে পরাজিত করতে পারলে লিটন দাসেরা বাংলাদেশ সুপার ফোরে ওঠার লড়াইয়ে অনেকটাই এগিয়ে থাকবে।
এরপর শ্রীলংকা ও আফগানিস্তানের মধ্যেকার যেকোনো দলকে হারাতে পারলেই এগিয়ে যাওয়ার পথ আর কণ্টকময় হবে না। কিন্ত আজ হেরে গেলে গ্রুপেই বাংলাদেশকে বিপদজনক অবস্থায় পড়তে হবে।
এবারের এশিয়া কাপ ক্রিকেটে আমাদের সেই সুপরিচিত তারকারা কেউ আর নেই। বিশ্বতারকা সাকিব আল হাসান, তামিম, মাশরাফি, মুশফিক, রিয়াদ কেউই নেই। লিটন, মোস্তাফিজ, তাসকিনদের বাইরে এখন যারা আছেন তাদের অনেকেই বেশ নতুন, কেউ কেউ অপরিচিতও। সবে প্রতিভার স্ফূরণ ঘটতে শুরু হয়েছে অনেকের। আবার দলের বাইরে রয়েছেন অভিজ্ঞ মিরাজের মতো অলরাউন্ডারও। হয়ত এ কারণেই দলের উজ্জ্বলতা অনেকটাই ম্রিয়মান। তবে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বলছেন সম্প্রতি শ্রীলংকা, পাকিস্তান ও নেদারল্যান্ডসের বিরুদ্ধে পরপর তিনটি সিরিজ জয়ের কারণে বাংলাদেশ দল এখন আগের তুলনায় বেশ আত্মবিশ্বাসী।
বাংলাদেশ টিমের অধিনায়ক লিটন দাস ৭ সেপ্টেম্বর দুবাই এর উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়ার আগে সোশাল মিডিয়াতে লিখেন, ‘আমার এবং আমার দলের জন্য বিশ্বের সব সমর্থকদের কাছে দোয়া চাই। আমরা কথা দিচ্ছি সংযুক্ত আরব আমিরাতে আমরা আমাদের সেরাটা দেব। একবারে একটি করে ম্যাচ খেলব, যার চূড়ান্ত লক্ষ্য থাকবে ট্রফি জেতা।’
টি টুয়েন্টি ফরম্যাটের এই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ দলে রয়েছে, লিটন কুমার দাস (অধিনায়ক), তানজিদ হাসান, পারভেজ হোসেন, সাইফ হাসান, তাওহিদ হৃদয়, জাকের আলী, শামীম হোসেন, নুরুল হাসান, মেহেদী হাসান, রিশাদ হোসেন, নাসুম আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান, তানজিম হাসান, শরীফুল ইসলাম, তাসকিন আহমেদ ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। স্ট্যান্ড বাই হিসেবে রয়েছে সৌম্য সরকার, মেহেদী হাসান মিরাজ, তানভীর ইসলাম ও হাসান মাহমুদ।
এবারের এশিয়া কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্টে যথারীতি শিরোপার অন্যতম দাবিদার ভারত। দাবিদার পাকিস্তানও। তবে বিষয়টি পরিস্কার হবে ১৪ই সেপ্টেম্বর। কেননা এদিনে গ্রুপ পর্যায়ের লড়াইয়ে দুবাইতে মুখোমুখি হবে ভারত ও পাকিস্তান।
সাম্প্রতিক দু দেশের মধ্যকার যুদ্ধের পর এই লড়াইয়ের দিকে তাই সবার চোখ থাকবে। গ্রুপ পর্যায়ের লড়াই, সুপার ফোর শেষে ২৮ সেপ্টেম্বর দুবাইতে ফাইনাল অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ দল কতদূর এগোতে পারবে সেটাই দেখার বিষয়। শত আক্ষেপের এশিয়া কাপ কী এবার আমাদের শত আশা পূরণ করতে পারবে?
(এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)