পাঁচজনের সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে রামেবি’র সম্পদ

পাঁচজনের সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিচ্ছে রামেবি’র সম্পদ

রাজশাহী মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (রামেবি) মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নিতে গড়ে উঠেছে পাঁচ সদস্যের এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেট গত ১০ মাস ধরে বাধাহীনভাবে চালিয়ে যাচ্ছে হরিলুট। ২০৫ বিঘা আয়তনের বিশাল ক্যাম্পাসে বিধিবিধানের তোয়াক্কা না করে এবং কোনো টেন্ডার ছাড়াই চলছে লুটপাটের এ মহাযজ্ঞ। ইতোমধ্যেই চক্রটি কয়েকটি খাত থেকে অন্তত সোয়া দুই কোটি টাকার সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বের হয়ে এসেছে এসব তথ্য।

বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের দাবি, গত বছরের অক্টোবরে সিন্ডিকেটটি লুটপাট নির্বিঘ্নে চালাতে ক্যাম্পাস থেকে নিয়োগকৃত আটজন নিরাপত্তারক্ষীকে সরিয়ে নেয়। তাদের পুরাতন ক্যাম্পাসে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নিরাপত্তারক্ষীদের সরিয়ে সেখানে সিন্ডিকেটটি নিজেদের লোকজন নিয়োগ দেয়। ফলে ক্যাম্পাসের সম্পদ অরক্ষিত হয়ে পড়ে। দেখার কেউ না থাকায় সম্পদ লুট আরও সহজ হয়।

অভিযোগ উঠেছে, অধ্যাপক ডা. মোহা. জাওয়াদুল হক গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বরে রামেবি’র উপাচার্য হিসাবে চার বছরের জন্য দায়িত্বগ্রহণ করেন। তিনি একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের মতাদর্শের অনুসারী। নতুন ভিসি যোগদানের পরই ওই বিশেষ দলটির অনুসারীরা হয়ে ওঠেন বেপরোয়া। গড়ে তোলেন একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পাঁচ সদস্যের সিন্ডিকেটটি শনাক্ত করেছেন। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে তাদের অপকর্মের বিষয়টি ওঠে এসেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. হাসিবুল হোসেন, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী সিরাজুম মুনীর, উপাচার্যের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএ) নাজমুল হোসেন, বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের সাবেক নেতা খায়রুল ইসলাম এবং তার সহযোগী হাফিজুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ আত্মসাতসহ সার্বিক বিষয়ে বক্তব্যের জন্য উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মোহা. জাওয়াদুল হককে ফোন দেওয়া হয়। তিনি ফোন না ধরায় বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। পরে তার নম্বরে যুগান্তরের পরিচয়ে মেসেজ (বার্তা) দেওয়া হয়। এরপর তিনি ফিরতি মেসেজে জানান, তিনি রাজশাহীর বাইরে আছেন। ফিরে এলে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদককে তার অফিসে যাওয়ার জন্য বলেন।

তবে ভিসির পিএ নাজমুল হোসেন বলেন, ২০২২-২৩ অর্থবছর থেকে ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়েছে। তখন তো এসব বিষয়ে কিছু লেখা হয়নি। ক্যাম্পাসের গাছ কারা কেটেছেন, পুকুর কারা ভোগদখল করছেন, সবজি খেত আর দোকান ভাড়ার টাকা কারা নিচ্ছেন-এসব আমি বলত পারব না। এসবের সঙ্গে আমি জড়িত না।

দরপত্র ও বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া গাছ কাটা : সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন জাতের গাছ রয়েছে প্রায় ৭৩০০টি। ১০ মাস আগে থেকেই কৌশলে কোনো টেন্ডার এবং বন বিভাগের অনুমতি ছাড়া আম ও মেহগনি গাছ কাটা শুরু করে চক্রটি। তবে সম্প্রতি গাছ লুটের মাত্রা বৃদ্ধি পেলে সবার নজরে আসে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঘটনাটি প্রকাশ পেলে শুরু হয় তোলপাড়। ইতোমধ্যে আম ও মেহগনি মিলিয়ে প্রায় এক হাজার গাছ কাটা হয়েছে। এসব গাছের বাজারমূল্য প্রায় অর্ধ কোটি টাকা।

নামমাত্র মূল্যে ইজারা দিয়ে আম লুট : ক্যাম্পাসে গাছ লুটের আগে সুকৌশলে আম লুটের ঘটনা ঘটেছে। সেরাজুল ইসলাম নামের একজনের লাইসেন্সে আম গাছ ইজারা নেন সিন্ডিকেটটির সদস্য সাবেক ছাত্রনেতা খায়রুল ইসলাম। নামমাত্র এক লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যে এ ইজারা দেওয়া হয়। কিন্তু আম বিক্রি করেই কোটি টাকার ওপরে হাতিয়ে নিয়েছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা।

সবজি খেত ইজারা : রামেবি ক্যাম্পাসে অন্তত একশ বিঘা জমিতে সবজি খেত রয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ক্যাম্পাস পার্শ্ববর্তী এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ‘প্রতিবিঘা জমি ২০ হাজার টাকা করে বছর চুক্তিতে ইজারা দেওয়া হয়েছে।’ এ হিসাবে এই সিন্ডিকেট ক্যাম্পাসের জমি লিজ দিয়ে ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

পুকুর দখল করে মাছ চাষ : রামেবি ক্যাম্পাসে ছোটবড় মিলিয়ে ৪০ বিঘার পুকুর রয়েছে সাতটি। এর মধ্যে একটি পুকরই হলো ১৭ বিঘা। এছাড়া সাত ও পাঁচ বিঘার আরও দুটি পুকুর রয়েছে। অন্য চারটি পুকুর কিছুটা ছোট। রাজশাহী অঞ্চলে প্রতিবিঘা পুকুর বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। স্থানীয় রুবেল নামের এক যুবক সিন্ডিকেটের হয়ে এসব পুকুরে মাছচাষ করেন।

ক্যাম্পাসের সম্পদ লুটের অভিযোগ অস্বীকার করে খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু মানুষ সুপরিকল্পিতভাবে আমার নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে। ক্যাম্পাসের আম আমার লোকজন টেন্ডারে অংশ নিয়ে পান। যারা পাননি তারাই হয়তো আমাদের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে নানান অভিযোগ করছেন।’ হাফিজুল তার পরিচিত বলেও তিনি জানান।

অধিগ্রহণকৃত ভবনের এসি লুট : জেলা প্রশাসন অধিগ্রহণের পর গত বছরের শুরুতে জমি বুঝে পায় রামেবি কর্তৃপক্ষ। এ সময় ছোটবড় মিলিয়ে ১১টি ভবন ছিল। এসব ভবনের ২০টি এসি লুট হয়ে গেছে। সিন্ডিকেটটি এসব এসি লুটের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ১৬ লাখ টাকা তছরুপ করেছে।

দুটি দোকানের ভাড়া ভাগবাঁটোয়ারা : ক্যাম্পাসের নির্মাণাধীন মূল ফটকের পাশেই রয়েছে স্পেক্ট্রা ইন্টারন্যাশনাল এবং মীর এন্টারপ্রাইজ নামের দুটি দোকান। এ দুটি দোকানের মাসিক ভাড়া অন্তত ৫০ হাজার টাকা। রোববার সরেজমিনে গেলে দোকান দুটির মালিককে পাওয়া যায়নি। গত ১০ মাসে ভাড়া বাবদ পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ লুটের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন উপপ্রকল্প পরিচালক ও পরিকল্পনা বিভাগের পরিচালক প্রকৌশলী সিরাজুম মুনীর। তিনি বলেন, ‘নিয়ম-বিধির মধ্যেই উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। সিন্ডিকেট করে লুটপাটের অভিযোগ ভিত্তিহীন। গাছ লুটের ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে।’ সবজি খেত, পুকুর ও দোকান ইজারা দেওয়া হয়নি উল্লেখ করে সিরাজুম মুনীর বলেন, ক্যাম্পাসের জমি বর্তমানে ঠিকাদারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। কারা সবজি ও মাছচাষ করছেন, সেটি আমার জানা নেই। দোকানসহ অন্য ভবনগুলো ভাঙার জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। কারা দোকানের ভাড়া তুলছেন, সেটি বলতে পারব না। আর ভবন অধিগ্রহণের সময় সেখানে আমরা এসি পাইনি, সেখানে এসি ভাগবাঁটোয়ার করে নেওয়ার অভিযোগটিও বানোয়াট।