জাকসু নির্বাচন: জিএস প্রার্থীদের যত প্রতিশ্রুতি
দীর্ঘ ৩৩ বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন। আসন্ন নির্বাচনে শিক্ষার্থীদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় পদগুলোর মধ্যে একটি হলো সাধারণ সম্পাদক (জিএস)।
প্রার্থীরা নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত সময় পার করছেন, দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। যুগান্তরের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপকালে চার জিএস প্রার্থী তাদের ভিশন ও কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন।
শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে নীতিমালা প্রয়োগ করতে চাই: মাজহারুল ইসলাম (ইসলামী ছাত্রশিবির)
ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে মনোনীত জিএস পদপ্রার্থী মাজহারুল ইসলাম। জাকসু নিয়ে আলাপকালে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে জাকসু ভূমিকা রাখতে পারে। কোনো স্টেকহোল্ডারের নিকট বিক্রি না হয়ে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে আন্তরিক হলে তবেই কেবল শিক্ষার্থীদের সমস্যাবলী সমাধান সম্ভব হবে।
শিক্ষার্থীদের জন্য এ যাবত কী কী কাজ করেছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক সব আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ক্লাবে নেতৃত্ব দিয়ে এ ক্যাম্পাসের সুন্দর পরিবেশ গঠনে ভূমিকা রেখেছি। এছাড়া ছাত্রসংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিপদ আপদে পাশে দাঁড়িয়ে হেলদি এনভায়রনমেন্ট ক্রিয়েট করার চেষ্টা করেছি।
জাকসুতে নির্বাচিত হলে প্রধান অগ্রাধিকার কি হবে জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিতে নীতিমালার প্রয়োগ এবং যানবাহন সমস্যার সমাধান প্রথমেই অগ্রাধিকার পাবে।
তিনি আরও বলেন, এ ক্যাম্পাসে নারীরা নিরাপদ। তবে মহাসড়কের পাশের হলগুলোর আরও নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রশাসনকে চাপ প্রয়োগ করব। বিশেষ করে সাইবার বুলিংয়ের ব্যাপারটায় বিশেষ গুরুত্ব দেবো যেন কেউ নারীর প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব পোষণ করতে না পারে, অসম্মান করতে না পারে।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, পরিবেশগত উন্নয়নে ইকোলজিক্যাল মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়নে প্রভাবক ভূমিকা রাখব, যানবাহন সমস্যা সমাধানে পরিবহন সংখ্যা বৃদ্ধি কিংবা বিশেষ সিস্টেমের আওতায় এনে তুলনামূলক সহজ বাহনগুলোর নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করণে কাজ করব। এছাড়া ক্যান্টিনে ৫০% ভর্তুকি নিশ্চিত করা ও বটতলার খাবারের মান নিয়মিত নজরদারির মাধ্যমে খাবার সমস্যা সমাধান করতে চাই।
শিক্ষা ও গবেষণামুখী বিশ্ববিদ্যালয় গড়তে একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান করতে চাই: শরণ এহসান (সম্প্রীতির ঐক্য)
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ নামে প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের প্যানেলে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি শরণ এহসান নির্বাচন করছেন।
জাকসু নিয়ে তার ভাবনা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন, ৩৩ বছর পর জাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এটা যেমন আনন্দের খবর, ঠিক তেমনিভাবে শঙ্কারও কারণ হতে পারে। বিগত জাকসু গুলোতে যে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, সেসব যেন একালে ফেরত না আসতে পারে তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্টেকহোল্ডারকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণামুখী ধারায় বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে এই জাকসু নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আমি মনে করি। দেশের সামগ্রিক শিক্ষা কাঠামো ও চাকরির বাজার বিবেচনায় এই জাকসু নির্বাচন ফলপ্রসূ হতে পারে।
তিনি যুগান্তরকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরু থেকেই সাংস্কৃতিক সংগঠনে যুক্ত থাকার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছি সর্বদা। পরবর্তীকালে জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি হিসেবে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। একজন রাজনীতি সচেতন সংস্কৃতি কর্মী হিসেবে কালচারাল-পলিটিক্যাল এনভায়রনমেন্ট নিয়ে কাজ করেছি। ঠিক তেমনিভাবে শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সচেতন করে তুলতে সর্বদা তাদের পাশে থেকেছি। আমি মনে করি শিক্ষার্থীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা এই সময়ের সবচেয়ে বড় ফাইট।
জাকসুতে নির্বাচিত হওয়ার পর কী করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষা ও গবেষণা ধর্মী উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করাই ছিল জাহাঙ্গীরনগরের প্রতিষ্ঠাকালীন লক্ষ্য। কিন্তু বিগত ৫০ বছরেও সে লক্ষ্য যথাযথভাবে অর্জিত হয়নি। এর অন্যতম কারণ একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যানের অভাব। বিশ্ববিদ্যালয়কে শিক্ষা ও গবেষণামুখী করতে একাডেমিক মাস্টারপ্ল্যান জরুরি। জাহাঙ্গীরনগরের বিরাজমান সমস্যা ও সংকটকে ছোট পরিসরে বিবেচনা না করে বৃহৎ পাস্পেক্টিভ থেকে যাচাই করতে চাই। এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সেই সংকট সমাধান করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাজ করে যেতে চাই।
তিনি যুগান্তরকে আরও বলেন, জাহাঙ্গীরনগরে শিক্ষার্থীর অর্ধেক নারী শিক্ষার্থী থাকলেও হলগুলোতে কোন নারী নিরাপত্তা কর্মী নেই। হলে এবং ক্যাম্পাসে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকল্পে নারী নিরাপত্তা কর্মী নিয়োগ একটা উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হতে পারে। এছাড়াও পরিবেশ, যানবাহন ও ক্যান্টিন তথা খাদ্য ব্যবস্থার সংকট সমাধানে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি স্ট্রাকচারাল মাস্টারপ্ল্যান। একাডেমিক ও স্ট্রাকাচারাল মাস্টারপ্ল্যানের ভেতর দিয়ে শিক্ষা ও গবেষণামূলক, সাংস্কৃতিক পরিসর সমৃদ্ধ প্রাণ-প্রকৃতির আধার নতুন জ্ঞান উৎপাদনের কারখানা হিসেবে আদর্শ জাহাঙ্গীরনগর গড়ে তুলতে চাই।
শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রভু-দাস সম্পর্ক ভাঙতে চাই: আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম (শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম)
আসন্ন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচনকে পরিবর্তনের অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে দেখছেন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) সমর্থিত ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম।
যুগান্তরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর জাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আমার প্রথম কাজ হবে নিয়মিত জাকসু নির্বাচন নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। শিক্ষার্থীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য জাকসুকে সচল রাখা সবথেকে জরুরি।
তিনি আরও বলেন, সবার আগে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রভু-দাস সম্পর্ককে ভাঙতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতার ভারসাম্য তৈরি না হওয়ায় শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ গড়ে উঠছে না। এই ভারসাম্য তৈরি করাই আমার বড় লক্ষ্য। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের সিন্ডিকেট ভেঙে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে চাই।
সিয়াম যুগান্তরকে আরও বলেন, আমরা যারা আছি আমরা দীর্ঘদিন ধরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল যৌক্তিক আন্দোলনের সঙ্গে আছি, যখন জাকসু হবে এরকম কোন চিন্তা ভাবনায় ছিল না তখন থেকে আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে আসছি, সেই ফ্যাসিবাদী আমল যখন সবাই ভয়ে চুপ থাকতো তখনও আমরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি যৌক্তিক বিষয় শিক্ষার্থীদের হয়ে আমরা ভয়েস রেইস করেছি এবং যদি আমরা নাও জিতি তারপরও আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করে যাব।
এছাড়াও তিনি শিক্ষার্থীদের একটা ঐক্যবদ্ধ ভয়েজ রেসের জায়গা তৈরি করতে চান। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটা কমিউনিটির জন্য আলাদা আলাদা লেজিট ভয়েজ রেসের জায়গা থাকলেও শিক্ষার্থীদের জন্য লেজিট জায়গা নাই। সেই জায়গা থেকে আমরা আসলে এটা বিশ্বাস করি যে জাকসুর মাধ্যমে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক কিছু পরিবর্তন করে ফেলতে পারব ব্যাপারটা এরকম না কিন্তু পরিবর্তনের জন্য যে শব্দ ইউজ করা দরকার, পরিবর্তনের জন্য যে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রশাসনকে প্রেশার দেওয়া দরকার সেইটা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য আমি নিশ্চিত করব।
নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে চাই: তানজিলা হোসাইন বৈশাখী (ছাত্রদল)
জাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী তানজিলা হোসাইন বৈশাখী। জয়ী হলে ক্যাম্পাসে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করতে কাজ করতে চান এই জিএস প্রার্থী।
তানজিলা হোসাইন বৈশাখী বলেন, আমি সারাজীবনই নিজের ও অন্যদের অধিকারের বিষয়ে সচেতন ছিলাম। কোনো অন্যায় হলে কখনই মেনে নিতে পারতাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর এই প্রবণতা আরও বেড়েছে।
নির্বাচনে জয়ী হলে কী করবেন? জানতে চাইলে ছাত্রদলের এই নেত্রী বলেন, ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতীক হচ্ছে জাকসু। আমাদের লক্ষ্য থাকবে ক্যাম্পাসে গণতন্ত্র অব্যাহত রাখা। সে কারণেই প্রতি বছর যেন জাকসু হয়, তা নিশ্চিত করতে কাজ করব। জাকসু কখনই বন্ধ হতে দেওয়া যাবে না। নানা ষড়যন্ত্র হবে জাকসু বন্ধে। কিন্তু আমরা সব ষড়যন্ত্র রুখে নিয়মিত জাকসু নিশ্চিত করব।
নারী শিক্ষার্থীদের সমস্যা গুরুতর উল্লেখ করে বৈশাখী বলেন, আমাদের ক্যাম্পাসে নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি খুব শঙ্কার। শুধু বাহ্যিক না, নন-কনভেনশনাল সিকিউরিটির কথাও আমাদের চিন্তা করতে হবে। যেমন- ৫ আগস্টের পর আমরা ক্যাম্পাসে নারীদের মোরাল পুলিশিংয়ের শিকার হতে দেখছি, অনলাইন হয়রানির শিকার হতে দেখছি। মেয়েদের হল ও ছেলেদের হলের নিয়মের মধ্যে পার্থক্য আছে। ছেলেরা সারারাত হলে আসা-যাওয়া করতে পারলেও মেয়েরা রাত ১১টার পর হল থেকে বের হতে পারে না। এই বৈষম্য কেন থাকবে? মেয়েদের হলে সিলিং ফ্যান দিচ্ছে না। বলা হচ্ছে, মেয়েরা নাকি সুইসাইড করবে। ২০২৫ সালে এসেও এ ধরনের ভাবনা কিভাবে মাথায় আসে?
তিনি বলেন, মেয়েদের হলের ছাদ-বারান্দার করিডর বন্ধ থাকে। ছেলেদের হলের ক্যান্টিন অনেক রাতে খোলা থাকলেও মেয়েদের হলের ক্যান্টিন রাত ৮-৯টার মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। অথচ অনেকের টিউশনি শেষ করে পৌঁছতে ১০টার বেশি বেজে যায়। জরুরি প্রয়োজনে মেয়েদের হল থেকে হাসপাতালে যেতে যে পরিমাণ প্রশাসনিক ধাপ পার হতে হয়, সেটা খুব কঠিন। মেয়েদের খেলাধুলার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধাও নেই। ক্যাম্পাস ও হলে নারী বৈষম্য যেন দূর হয়, তা নিশ্চিতে কাজ করব।