ডাকসুতে ছাত্রশিবিরের ভূমিধস জয়ের নেপথ্যে রয়েছে যেসব কৌশল

ডাকসুতে ছাত্রশিবিরের ভূমিধস জয়ের নেপথ্যে রয়েছে যেসব কৌশল

দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছর পর অনুষ্ঠিত হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। স্বাধীনতার পর ডাকসু দেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনার সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।

সুসংগঠিত কর্মকাণ্ড ও ‘পজিটিভ ইমেজ’-এর কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবির নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে সংগঠনটির দলীয় কর্মসূচি এবং শিক্ষার্থীবান্ধব নানা কর্মকাণ্ড পৌঁছে দেওয়ায় এ অভাবনীয় জয় হয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক ও ডাকসুর এক সাবেক জিএস।

তাদের মতে, ছাত্রদল ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ সংগঠিত ছিল না। এর ফলে শিক্ষার্থীদের কাছে তারা কর্মপরিকল্পনা সঠিকভাবে পৌঁছে দিতে পারেনি। শিবিরের প্রার্থীদের তুলনায় ছাত্র ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বাম সংগঠন ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে পারেনি।

এদিকে ছাত্রদলের ভরাডুবিতে হতভম্ব বিএনপি। দলটির নেতাকর্মীরা এমন শোচনীয় পরাজয়ের ন্যূনতম প্রস্তুত ছিলেন না। তারা বলছেন, নির্বাচনে প্রতিপক্ষের কৌশলের কাছে ধরাশায়ী হয়েছেন। তাদের পালটা কোনো কৌশল ছিল না। নির্বাচনজুড়ে সমন্বয় ছিল না কোথাও। এছাড়াও ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার বেশ পরে প্যানেল ঘোষণা করেছে। এর ফলে ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের সাংগঠনিক এজেন্ডা নিয়ে ‘ডোর টু ডোর ক্যাম্পেইন’ করতে পারেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান মনে করেন, গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ জুলাইকে ইস্যু করে যে ক্যাম্পেইন, সেটা সেভাবে হয়তো হয়নি। যেটা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাতে পারেনি। এছাড়া বিজয়ীরা সংগঠিত ছিল এবং লম্বা সময় পরিকল্পিতভাবে কাজ করেছে। ডাকসু নির্বাচন করবে, এটি মাধায় রেখেই ৫ আগস্টের পর থেকে তারা কাজ করেছে। অন্যরা এভাবে লেগে থাকতে পারেনি। অন্যরা কাজ করেছে; কিন্তু এতটা সংগঠিত হয়ে, লক্ষ্য রেখে কাজ করেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সহসভাপতি (ভিপি), সাধারণ সম্পাদক (জিএস) এবং সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদসহ ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতেই জয়ী হয়েছেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ ছাত্র সংসদের প্রার্থীরা। এছাড়া তারা ১৮টি হলেও নিরঙ্কুশ জয় পেয়েছে।

অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের মতে, এখনকার জেন-জিদের মনে হচ্ছে তারা যতটা না বেশি অতীত অর্জনকে প্রাধান্য দেয়, তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় বর্তমান ও ভবিষ্যৎকে। সেই জায়গায় যার কাছে তার এক্সসেস বেশি, তার সঙ্গে থাকতেই হয়তো সে চিন্তা করে রেখেছে, এটাও একটা ব্যাপার। এর মধ্যে বিজয়ীদের এতটা নেটওয়ার্ক ছিল, তারা তাদের সর্বশক্তি ব্যবহার করেছে। তাদের যে কর্মীবাহিনী ও সমর্থক আছে, পুরো শক্তিই ব্যবহার করেছে। অন্যদের ভোট আছে, তাও পায়নি, ভাগাভাগি হতে পারে। এর ফলে তারা দুর্বল হয়ে গেছে। একটা প্যানেলে তাদের যত সমর্থক আছে, একচেটিয়া ভোট দিয়েছে, অন্য কোথাও ভোট দেয়নি। এর বাইরেরও কিছু ভোট এনেছে, যা অন্যরা পারেনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের একজন অধ্যাপক বলেন, ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে সামাজিক আন্দোলনের মতো করে কাজ করেছে। ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সদস্যদের মাধ্যমে ছাত্রশিবির মেয়েদের নিয়ে আলাদাভাবে কাজ করেছে। অনেক শিক্ষার্থী স্কুল ও কলেজে পড়াকালীন ছাত্রশিবিরের কর্মকাণ্ডের বা ইসলামিক অ্যাকটিভিটির ওরিয়েন্টেশন পান। নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ওইসব শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ছাত্রশিবির ও ছাত্রী সংস্থার মাধ্যমে সেই পরিবেশ পেয়ে সংগঠনমুখী হন। দীর্ঘদিনের সেই প্র্যাকটিস এবার তারা ভোটের মাঠে কাজে লাগিয়েছেন।

ওই অধ্যাপক আরও বলেন, ছাত্রশিবির সাধারণ শিক্ষার্থীদের আর্থিক, পড়ালেখা, কোচিংসহ নানাভাবে সহযোগিতা করে। এই কাজ ছাত্রদল ও বাম ছাত্র সংগঠনগুলো খুব একটা করে না। তাই এবার ভোটে ছাত্রশিবির একতরফাভাবে জিতেছে বলে মনে করেন তিনি। এদিকে ১৯৮৯-৯০ সালে ডাকসু নির্বাচনে জিএস পদে বিজয়ী হয়েছিলেন জাসদ ছাত্রলীগ সমর্থিত প্রার্থী ডা. মুস্তাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির বিপরীতে কোনো শক্তিশালী আদর্শিক ছাত্রসংগঠন ছিল না। যে সংগঠন শিবিরের প্রতিপক্ষ হিসাবে নিজেদের পরিচিত করার চেষ্টা করেছে, সাংগঠনিকভাবে বিস্তৃত হলেও নিকট অতীতে তারা শিবিরের সঙ্গে একই রাজনৈতিক লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ ছিল। তাই ডাকসুর ভোটাররা তাদের তুলনায় শিবিরকেই শ্রেয়তর বিবেচনা করেছে।’

পালটা কৌশল ছিল না ছাত্রদলের, সমন্বয়হীনতাকে দুষছেন নেতাকর্মীরা : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে দেশের দ্বিতীয় সংসদ হিসাবে বিবেচিত ডাকসু নির্বাচনে অভাবনীয় পরাজয়কে খুব সিরিয়াস হিসাবে নিয়েছেন বিএনপির হাইকমান্ড। মুখে তেমন কিছু না বললেও পর্দার অন্তরালে পরাজয়ের কারণ খুঁজছেন। তবে জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত কিংবা বাধাগ্রস্ত হতে পারে-এমন আশঙ্কায় প্রকাশ্যে কোনো কিছু বলতে নারাজ দলটি।

ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা স্বীকার করেন, ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের সমন্বয়হীনতা ছিল প্রকট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাবেক ছাত্রনেতা কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কোনো সমন্বয় গড়ে তুলতে পারেনি। শিক্ষক, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও কোনো আলাদা সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। এর সঙ্গে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভরাডুবি ঘটিয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবও ছিল।

নেতাকর্মীরা জানান, ডাকসু নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য ছাত্র সংগঠন পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করলেও ছাত্রদল ছিল নির্বিকার। নির্বাচনি তফশিল ঘোষণার পর তোড়জোড় শুরু করে প্যানেল গঠন করেন দায়িত্বশীল নেতারা। অল্প সময়ে প্যানেল গঠন করায় বিভিন্ন গ্রুপকে এক প্ল্যাটফর্মে আনতে পারেনি সংগঠনটি।

আবার এই নির্বাচনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দলের প্রতিটি স্তরের নেতাকর্মী আর সমর্থকদের পাশে টানতেও পারেনি। শুধু প্রার্থীদের ব্যক্তি ইমেজকে কেন্দ্র করে নির্বাচনি বৈতরণি পার হতে চেয়েছে সংগঠনটি। শিক্ষক, নারী ভোটার কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ সেতু ছিল দুর্বল। বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়ার সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক ছিল অতিসাধারণ মানের। মূলত দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনাই ছিল না।

ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা আরও জানান, ডাকসু নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ারিং যে হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। ঢাবির ভিসি, প্রক্টরিয়াল বডিসহ নির্বাচনে সম্পৃক্ত শিক্ষক এবং অন্যদের বেশির ভাগ জামায়াত-শিবির সমর্থিত ছিল। যার ফলে নির্বাচনে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল আলাদা সুবিধা পেয়েছে, যেটা ছাত্রদল পায়নি। দিনভর নির্বাচনে কারচুপিসহ নানা অসংগতির কথা তুলে ধরলেও কোনো সুরাহা পাননি তারা।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি খোরশেদ আলম সোহেল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো সেট-আপ জামায়াত-শিবির সমর্থিত। ফলে তারা নির্বাচনে একচেটিয়া সুবিধা পেয়েছে। ভোটে কারচুপি হলেও তা ওই সুবিধার কারণে ধামাচাপা দিতে সমর্থ হয় ছাত্রশিবির। আবার নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের গোপন আঁতাতের কারণেও নির্বাচনের ফলাফলের মোড় ঘুরে যায়।