ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের হাওয়া লেগেছে দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শুরু হয়েছে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড়। নির্বাচন কখনই হয়নি এমন বিশ্ববিদ্যালয়েও দাবি উঠেছে ভোটের আয়োজনের। দীর্ঘদিন ভোটবঞ্চিত শিক্ষার্থীরা যেন ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছেন। ভোটের দাবিতে বেশ কয়েকটি ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনেও রয়েছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগেই ছাত্র সংসদকে কার্যকর দেখতে চান তারা। তাদের দাবির মুখে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও নিচ্ছে ভোটের প্রস্তুতি। শুরু হয়েছে নানামুখী তৎপরতা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেন শুরু হয়েছে তারুণ্যের ভোটের মহড়া। ক্যাম্পাসের পরিবেশ বুঝে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে বলেও শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করছেন তারা। এক্ষেত্রে ডাকসু নির্বাচন বড় ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন সম্পন্ন হলে অন্য ক্যাম্পাসগুলোতেও ভোট হবে উৎসবমুখর এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর অনুযায়ী ডাকসু নির্বাচন ঘিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জোরেশোরে চলছে প্রার্থীদের প্রচারণা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্বিবিদ্যালয়ে জাকসু নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে ২৯ আগস্ট। এর আগেই সরগরম হয়ে উঠেছে ক্যাম্পাস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোনয়ন ফরম উত্তোলনের শেষ সময়ে রাকসু নির্বাচনের তারিখ দুই দফা পরিবর্তন করে ২৫ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হবে আজ। নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে প্রার্থীদের মাঝে শুরু হয়েছে ভোটের হিসাব-নিকাশ। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকসু নির্বাচনের জন্য গঠনতন্ত্র ও সংবিধি প্রণয়নে কমিটি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শুরু হয়েছে নির্বাচনের প্রস্তুতি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাকসু নির্বাচনের দাবি উঠেছে। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনও করেছেন। তাদের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. একে ফজলুল হক ভূঁইয়া। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের মুক্ত মনের বিকাশ, নেতৃত্ব সৃষ্টি এবং তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের আদর্শ প্ল্যাটফর্ম ছাত্র সংসদ। ক্যাম্পাসে রাজনীতি নিষিদ্ধ আছে। তবে ছাত্ররা যদি চায় তবে নির্বাচনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও জকসু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। নির্বাচন শুরু না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাকসু, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাকসু, গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে শিক্ষার্থীরা সোচ্চার রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বিষয়টি ইতিবাচক হিসাবেই দেখছে। শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
জকসু নির্বাচন শুরু না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে : জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জকসু) নির্বাচনের দাবিতে বেশ কয়েকদিন ধরে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে আসছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করতে প্রয়োজন হবে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ। যদিও মঙ্গলবার জকসু সংবিধি সিন্ডিকেটে অনুমোদন হয়েছে। জকসু নির্বাচন শুরু না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। জবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মেহেদি হাসান হিমেল বলেন, জকসু নীতিমালা আমরা অবশ্যই চাই। কিন্তু একই সঙ্গে ছাত্রলীগের যারা ফৌজদারি অপরাধের সঙ্গে জড়িত সেসব সন্ত্রাসীদেরও বিচার চাই। আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য মাসুদ রানা বলেন, সিন্ডিকেটে জকসু সংবিধি অনুমোদনকে আমরা প্রাথমিক বিজয় হিসাবে দেখছি। আমরা আর কালক্ষেপণ করতে চাই না, অতি দ্রুত সময়ে নির্বাচন দেখতে চাই। ছাত্র অধিকারের সভাপতি একেএম রাকিব বলেন, আমরা আর দীর্ঘ প্রক্রিয়া চাই না। প্রশাসনের কার্যক্রমের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না। যতদিন জকসু সংবিধি চূড়ান্ত অনুমোদন না হবে, ততদিন আন্দোলন চলবে। জবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. রেজাউল করিম বলেন, বিশেষ সিন্ডিকেট সভায় জকসুর সংবিধির প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ হলেই আমরা রোডম্যাপ ঘোষণা করব।
শাকসু নির্বাচনে সরব সব ছাত্র সংগঠন, শর্তের বেড়াজালে ছাত্রদল : শাহ্জালাল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (শাকসু) নির্বাচন পুনরায় চালুর দাবি জানিয়েছে। নির্বাচনের জন্য প্রশাসনের কাছে স্মারকলিপি দিয়েছে ছাত্রশিবির, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জুলাই বিপ্লবে নেতৃত্বদানকারী শাবি শিক্ষার্থীরা। তবে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চালুর আগে শাকসু নির্বাচন আয়োজনে রাজি হচ্ছে না শাবি ছাত্রদল। এদিকে, ছাত্রদের দাবির প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতোমধ্যে নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। ১৫ জুলাই ছাত্র উপদেশ ও নির্দেশনা পরিচালক অধ্যাপক ড. এছাক মিয়াকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি শাকসুর গঠনতন্ত্র পুনঃপ্রণয়নে কাজ করছে। ছাত্রশিবির সভাপতি তারেক মনোয়ার বলেন, ছাত্রদের অধিকার আদায়ে সব সময় ছাত্রশিবির বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। জুলাই পরবর্তী বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল দ্রুত সময়ের মধ্যে ছাত্র সংসদ চালু করে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত করা। নির্বাচনের বিষয়ে কাজ শুরু করেছে প্রশাসন। ছাত্রদল সভাপতি রাহাত জামান বলেন, আমরা শাকসু নির্বাচনের বিপক্ষে নই। তবে সেটা ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চালুর পর হতে হবে। বৃহৎ ছাত্র সংগঠনকে বাদ দিয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দেওয়া বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। ইসলামী ছাত্র আন্দোলন সম্পাদক আজাদ শিকদার বলেন, গঠনতন্ত্র সংস্কার ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই নির্বাচন দেওয়া যৌক্তিক বলে মনে হচ্ছে। আশা করি, প্রশাসন এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক ফয়সাল হোসেন বলেন, সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সেপ্টেম্বরের মধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচন চাই।
বাকসুর দাবিতে গণভোট, বিক্ষোভ : সর্বশেষ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (বাকসু) নির্বাচন হয় ১৯৯৮ সালে। এরপর দীর্ঘ ২৬ বছরে বিভিন্ন কারণে বাকসু নির্বাচন আয়োজন করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এবার বাকসু নির্বাচনের দাবিতে সক্রিয় হয়েছে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন। ইতোমধ্যে শিক্ষার্থীদের গণভোট গ্রহণ, উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি প্রদানসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে। মঙ্গলবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাকসু নির্বাচনের তফশিল ঘোষণাসহ ৯ দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে। ছাত্রদলের আহ্বায়ক আতিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সব সময় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। আমরা বাকসু নির্বাচনের দাবি প্রশাসনের কাছে জানিয়েছি। সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট সম্পাদক জায়েদ হাসান ওয়ালিদস বলেন বাকসু নির্বাচন হলে বিভিন্ন দাবিদাওয়া ও সংকট নিরসনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের পক্ষ হয়ে তাদের সংকট ও পরিকল্পনা উত্থাপন করতে পারবে।
গোবিপ্রবিতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তাপ : গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (গোবিপ্রবি) ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবিতে মঙ্গলবার সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন। শাখা ছাত্রদল সভাপতি দুর্জয় শুভ বলেন, ছাত্র সংসদ আমরাও চাই। তবে সবার আগে দরকার এ বিশ্ববিদ্যালয়ের জুলাই ২৪-এর গাদ্দারদের বিচারের আওতায় আনা। ছাত্র অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মাদ আলী তোহা বলেন, শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি ও পেশিশক্তি পরিহার করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এখন সময়ের দাবি।
মাকসু নির্বাচনের জোরালো দাবি : মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (মাকসু) নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা। নির্বাচনের দাবিতে ইতোমধ্যে আমরণ অনশন করেছেন শিক্ষার্থীরা। শিবির সভাপতি হাফিজুর রহমান বলেন, শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় ছাত্র সংসদ প্রতিষ্ঠা ও নির্বাচনের বিকল্প নেই। ছাত্রদলের সভাপতি সাগর নাইম বলেন, শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষায় ছাত্র সংসদের দাবি করছি। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল আজীম আখন্দ বলেন, নির্বাচনের বিষয়ে ইতঃপূর্বে সভা করা হয়েছে। রিজেন্ট বোর্ডে কমিটি করে সরকারের কাছে নির্বাচনের অনুমতি চাওয়া হবে।