জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদের (জাকসু) মনোনয়ন ফরম জমাদানের সময় গত ২১ আগস্ট শেষ হয়েছে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হতে যাওয়া এ নির্বাচনে কেন্দ্রীয় সংসদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে চললেও হল সংসদগুলোতে রয়েছে প্রার্থী সংকট।
বিশেষ করে ছাত্রী হলগুলোর বেশ কয়েকটিতে পূর্ণাঙ্গ প্যানেলে প্রার্থীই পাওয়া যায়নি। হল সংসদ নির্বাচনে ৫টি ছাত্রী হলে ১৫ পদের বিপরীতে ১৫টি মনোনয়ন ফরমও জমা পড়েনি।
জাকসুর নির্বাচন কমিশন জানায়, ছাত্রদের মধ্যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হলে সবচেয়ে বেশি মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন প্রার্থীরা। এই হলে মোট ৬০টি ফরম জমা পড়েছে। এছাড়া শহীদ তাজউদ্দীন হলে ৪৯টি, ২১ নং ছাত্র হলে ৩৮টি, মীর মশাররফ হোসেন হল ও ১০ নং ছাত্র হলে ৩০টি, মওলানা ভাসানী হলে ২৭টি, আ ফ ম কামাল উদ্দিন হল, বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল ও শহীদ সালাম বরকত হলে ২২টি এবং শহীদ রফিক জব্বার হলে ২১টি মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন প্রার্থীরা।
অপরদিকে ছাত্রী হলগুলোতে বীর প্রতীক তারামন বিবি হল, ১৫ নং ছাত্রী হল ও রোকেয়া হলে ১৫টি পদের বিপরীতে সর্বোচ্চ ১৭টি করে মনোনয়ন ফরম জমা পড়েছে। এছাড়া জাহানারা ইমাম হলে ১৬টি, ফজিলাতুন্নেসা হলে ১৫টি করে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন প্রার্থীরা। তবে পাঁচটি হলে ১৫টি পদের কোটা পূরণ হয়নি। এর মধ্যে ১৩ নং ছাত্রী হল ও নোয়াব ফয়জুন্নেসা হলে মাত্র ৬টি করে মনোনয়ন ফরম জমা পড়েছে। এছাড়া প্রীতিলতা হল, বেগম খালেদা জিয়া হল এবং বেগম সুফিয়া কামাল হলে যথাক্রমে ১৩টি, ১১টি এবং ১০টি করে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন প্রার্থীরা।
কোনো প্যানেলে ভিপি-জিএস পদে নেই নারী শিক্ষার্থী
অপরদিকে জাকসু নির্বাচনে এখন পর্যন্ত কোনো প্যানেলে ভিপি-জিএস পদে নারী প্রার্থীর নাম শোনা যায়নি। প্রতিটি প্যানেলে সংরক্ষিত যুগ্ম-সম্পাদক (নারী) ছাড়া সহ-সভাপতি (ভিপি) ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে প্রার্থী ছাত্ররা।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলে ভিপি ও জিএস পদে লড়বেন আরিফুল্লাহ আদিব-মাজহারুল ইসলাম। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) ‘শিক্ষার্থী ঐক্য ফোরাম’ প্যানেলে ভিপি ও জিএস পদে রয়েছেন আরিফুজ্জামান উজ্জল-আবু তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম।
এদিকে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জাকসুতে প্যানেল করতে পারেনি ছাত্রদল। তবে এই সংগঠনেও ভিপি-জিএস পদে নারী শিক্ষার্থীর নাম এখনো শোনা যায়নি। গণঅভ্যুত্থানে অবদান রাখা আবদুর রশিদ জিতু-শাকিল আলী সম্ভাব্য প্যানেল হতে পারে বলে জানা গেছে।
সাংস্কৃতিক জোটভুক্ত ৯টি সংগঠন ও ছাত্র ইউনিয়নের (অদ্রি-অর্ক) ‘সম্প্রীতির ঐক্য’ নামে সম্ভাব্য একটি প্যানেল হবে বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। এ প্যানেলে সম্ভাব্য ভিপি-জিএস পদে থাকবেন ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) সাবেক সভাপতি অমর্ত্য রায় ও জাহাঙ্গীরনগর সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি শরণ এহসান।
থিয়েটার (টিএসসি) ও ছাত্র ইউনিয়ন (ইমন-তানজিম) প্যানেল এখনও চূড়ান্ত তালিকা করতে পারেনি। তবে তাদের প্যানেলে ভিপি-জিএস পদে থাকবেন থিয়েটার (টিএসসি) সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহাফুজুল ইসলাম মেঘ ও ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ইমন।
জাকসুতে নারীদের অংশগ্রহণ কম থাকার বিষয়ে ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেলের নারী এজিএস প্রার্থী আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা বলেন, নারীদের নেত্রীত্বে না আসার প্রধান কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। কোনো নারী যখন নেতৃত্বে আসতে চান, তখন সাইবার বুলিং, ট্যাগিং, ব্যাশিং এর শিকার হয়। ইসলামি মতাদর্শের হলে ‘ছাত্রীসংস্থার’ বলা হয় আর মুক্তমনা হলে ‘শাহাবাগী গোসল কর’ বলা হয়।
তিনি বলেন, জনপ্রিয় উপস্থাপিকা দীপ্তি চৌধুরী একটা টকশোতে বলেছিলেন তিনি তার মাকে পোস্টের কমেন্ট দেখতে দেন না। একজন নারী যখন নেতৃত্বে আসতে চান, তখন তার পরিবার চিন্তা করে তার মেয়ের চরিত্র তুলে কথা বলা হবে। এই একটি মাত্র ভয়ে মেয়েরা ইচ্ছা এবং যোগ্যতা থাকার পরও পরিবারের বাধার কারণে সামনে আসতে পারেন না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলোও মেয়েদেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য, তাদের সচেতন করার জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
জাকসু নির্বাচনে সহ-সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক (নারী) পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী জান্নাতুল ফিরদাউস আনজুম বলেন, ৯৯-এর ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ক্যাম্পাসের সব আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা অগ্রগামী। কেবল অংশগ্রহণ নয়, নারীরা এই ক্যাম্পাসে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে নারীরা কখনোই তার যোগ্য মূল্যায়ন পানিনি।
মূল্যায়ন না পাওয়ায় আন্দোলনের এই নেত্রীরা কখনো রাজনীতিতে যুক্ত হন না। তাদেরকে তখন রাজনৈতিক ‘শোকেজিং’ এ ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। যে কারণে বিভিন্ন সংরক্ষিত পদ দেওয়া বা মিটিং-মিছিলের সামনে রাখার মতো অকার্যকরী ঘটনা দেখা যায়।
ফলে একটি বড় অংশের যোগ্য নারীরা এ ধরনের রাজনীতিতে আসতে হীনমন্যতায় ভোগেনে। একপর্যায়ে অনীহা-অনাস্থায় তারা রাজনৈতিকভাবে অসচেতন হয়ে পড়েন।
গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক ধারার আকাঙ্খা মানুষের মধ্যে তীব্রভাবে প্রকাশ পায় এবং বাগছাসের মতো কিছু নতুন সংগঠন সেই প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা তা রক্ষায় ব্যার্থ হয়। পুরাতন ধারার লেজুড়বৃত্তি নতুন মোড়কে আনা এবং আন্দোলনের নেতৃত্বকে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত না করাই তাদের ব্যর্থতার মূল কারণ।
ফলশ্রুতিতে ঢাবিতে উমামা ফাতেমা বা জাবিতে ফাহমিদা ফাইজার মতো অভ্যুত্থানের নেত্রীদেরকে আমরা রাজনৈতিক সংগঠন থেকে ভিপি বা জিএস ক্যান্ডিডেট হিসেবে পাইনি।
ঢাবিতে এজিএস হিসেবে আশরেফাকে জায়গা দেওয়ার ব্যাপারে মুদাসসিরকে নিয়ে সংকট দেখতে পাই। আমার মূল্যায়ন বলে জাবিতে সংরক্ষিত পদ না থাকলে মালিহার মতো অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকেও আমরা এজিএস পদে দেখতাম কিনা তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ রয়েছে। কারণ বাগছাসের সাংগঠনিক নেতৃত্বে আমরা তাকে দেখতে পাইনি।
অন্যদিকে শিবির, ছাত্রদলের মতো মূলধারার ছাত্র সংগঠনগুলোও বরাবরের মতোই তাদের বৈশিষ্ট্য বজায় রেখেছে। আয়েশা আক্তার মেঘলা ছাড়া এই দলীয় প্যানেলগুলোতেও তেমন কোনো নারী মুখকে আমরা ডাকসু-জাকসুতে বলার মতো আলোচনাতে দেখতে পাচ্ছি না।
তিনি বলেন, বাম সংগঠনগুলো এক্ষেত্রে একটি আশার জায়গা। কিন্তু তাদের প্রভাব বা তাদের প্রতি আগ্রহ-আকর্ষণ সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কম থাকায় এখানেও কার্যকরী সমাধান নেই।
ডাকসু, জাকসুতে ভিপি, জিএস, এজিএস এর মতো অন্যসব গুরুত্বপূর্ণ পদেও যদি অধিক পরিমাণে যোগ্য নারী স্বতন্ত্র পদপ্রার্থীরা সাহস করে এগিয়ে আসে এবং সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের ওপর ভরসা করে কেবল তখনই এর সমাধান হতে পারে।
কারণ এই ডাকসু, জাকসুই হতে পারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের শেষ ভরসা। যেখানে দলীয় মতাদর্শিক রাজনীতিবিদ নয়, বরং দল-মতের ঊর্ধ্বে গিয়ে স্বতন্ত্র পদধারীরাই হবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিরপেক্ষ কণ্ঠস্বর।
প্যানেল ঘোষণা করতে পারেনি ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলো
এদিকে, জাকসু নির্বাচন উপলক্ষে জাবি ছাত্রশিবির ও গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা করলেও এখন পর্যন্ত প্যানেল ঘোষণা করতে পারেনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ও বাম সংগঠনগুলো।
শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বাায়ক ও সদস্য পদমর্যাদার অন্তত পাঁচজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাখা ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্যানেল ঘোষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা।
বিশেষ করে একাধিক গ্রুপিং থাকায় প্রত্যেক গ্রুপের সিনিয়র নেতাই চাচ্ছেন তার অনুসারীকে শীর্ষ পদের প্রার্থী ঘোষণা করার। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষকও প্যানেল গঠন কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। এজন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধায় পড়েন শাখা ছাত্রদল ও কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের নেতারা।
তবে শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন বাবর জানিয়েছেন, তাদের প্যানেল প্রস্তুত আছে। তিনি বলেন, আমাদের প্যানেল প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে যেহেতু জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল ঘোষণা করা হবে, সাংগঠনিক স্ট্রাকচার অনুযায়ী সেন্ট্রাল কমিটির গ্রিন সিগন্যাল পেলেই আমরা প্যানেল ঘোষণা করবো। আশা করি, আমরা দুই-একদিনের মধ্যে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল ঘোষণা করতে পারবো।
অপরদিকে প্যানেল ঘোষণার বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের একাংশের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম ইমন বলেন, আমরা দ্রুতই প্যানেল ঘোষণা করব। আপনাদের আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব।
ছাত্র ইউনিয়ন অপরাংশের সাধারণ সম্পাদক ফাইজান আহমেদ অর্ক বলেন, যেহেতু এখনো প্রচারণা শুরু হয়নি, তাই প্যানেল ঘোষণা করা হয়নি। আমাদের প্যানেল প্রস্তুত আছে।
‘সম্প্রীতির ঐক্য’ প্যানেলের সম্ভাব্য জিএস প্রার্থী শরণ এহসান তাদের প্যানেলের বিষয়ে বলেন, জাকসু নির্বাচনে আমাদের সম্ভাব্য ২৫ জনের প্যানেলে রয়েছে ১১ জন নারী, ৭ জন আদিবাসী ও ৪ জন সনাতন ধর্মাবলম্বী। এর মাঝে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীও রয়েছেন, যাদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করবেন প্রাকটিসিং মুসলিমও।
এছাড়া প্যানেলের অধিকাংশ সদস্যই রাজনীতি সচেতন সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠক। জাকসুতে সব ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, জাতিগোষ্ঠী নির্বিশেষে মানুষের অধিকার আদায়ের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা ও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতে আমরা লড়াই করবো সব মুক্তিকামী, সংগ্রামী ও বৈষম্যহীন সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে।