জীবনানন্দের জীবনের গল্পময় নাটক ‘কমলা রঙের বোধ’
তিনি ছিলেন আধুনিক বাংলা কবিতার এক উজ্জ্বলতম কবি। কাব্যিক ব্যঞ্জনায় মেলে ধরেছিলেন এই বাংলার নিসর্গ বা প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে। বলছি রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কথা। কালজয়ী কবি হয়েও জীবদ্দশায় মূল্যায়ন হয়নি জীবনানন্দের। কাব্য রচনায় অমিত প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও অনাদর ও অবহেলার শিকার হয়েছেন। উপেক্ষিত হয়েছেন তার সময়ের গণ্যমান্য কবি-সাহিত্যিকদের কাছে। অথচ অপমৃত্যুর পরে তার নাম লেখা হয়েছে কালোত্তীর্ণ কবির খাতায়।
আর জীবনানন্দ দাশের সেই আক্ষেপময় জীবনের গল্প ও সাহিত্যকীর্তি মেলে ধরা এক নাটক ‘কমলা রঙের বোধ’। নাট্যদল থিয়েটার ফ্যাক্টরি প্রযোজিত নাটকটি রচনার পাশাপাশি নির্দেশনা দিয়েছেন অলোক বসু। শনিবার শরতের সন্ধ্যায় শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে নাটকটির দশম প্রদর্শনী হয়। আজ রবিবার একই ভেন্যু ও একই সময়ে প্রযোজনাটির একাদশতম মঞ্চায়ন হবে।
জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে নাটক নির্মাণ প্রসঙ্গে নির্দেশক অলোক বসু বলেন, অনন্য সব কবিতা রচনার সমান্তরালে গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের ঐশ্বর্যময় এক সাহিত্যভা-ার রেখে গেছেন তিনি। তবে দুঃখের বিষয় হলো, কবি জীবনানন্দ দাশ তার জীবদ্দশায় যেমন মূল্যায়িত হননি, মৃত্যুর পরেও যেন তাই। তার বিশাল সাহিত্য ভা-ারের সিংহভাগই আবিষ্কৃত হয়েছে তার মৃত্যুর পরে। কবিতা রচনায় তিনি ছিলেন এক নতুন পথের দিশারী। বিষয়-ভাব-বোধ-ছন্দ-উপস্থাপনায় তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক কবি।
তারপরও জীবদ্দশায় কুলীন সাহিত্যিককুলে তিনি ছিলেন ব্রাত্য। সে কারণে সর্বসাধারণের কাছে তার পরিচিতি কম। তাই অধিকাংশ পাঠক ও সাহিত্যানুরাগী রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সম্পর্কে যত বেশি জানে জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে ততটা জানে না। অথচ তাদের সমসাময়িক সৃজনশীল মানুষদের মধ্যে জীবনানন্দ দাশও একজন। যারা তাকে নিয়ে চর্চা করেন তারা জানেন জীবনানন্দ দাশ কত বড় ও শক্তিশালী লেখক ছিলেন। বর্তমানে জাতীয় পরিসর পেরিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত এক কবি জীবনানন্দ দাশ।
নতুন করে বাংলা কবিতার প্রধান কবি জীবনানন্দ দাশকে চেনার ও জানার চেষ্টা করছেন অনেকেই। সেই বাস্তবতায় নতুন প্রজন্মের কাছে জীবনানন্দকে সঠিকভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়াই এ নাটকের মূল লক্ষ্য। নাটকে তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গিতে জীবনানন্দের দর্শন-অনুভব ও সাহিত্যকর্মকে মূল্যায়নের চেষ্টা করা হয়েছে। সঙ্গে কবির সময় ও ভাবনার মেলবন্ধন ঘটানো হয়েছে।
নাটকের কাহিনীতে দেখা যায়, ১৯৫৪ সালের ১৪ অক্টোবর জীবনানন্দ দাশ কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় পতিত হন। আহত কবিকে শম্ভুনাথ প-িত হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ২২ অক্টোবর কবি মারা যান। কেউ কেউ ওই দুর্ঘটনাকে বলেছেন আত্মহত্যা। সেই প্রেক্ষাপটে এ প্রজন্মের কয়েক তরুণ কবিকে বোঝার চেষ্টা করে। তারা জীবনানন্দের মৃত্যুর কারণ নিয়ে আলাপ করে, কবির বেড়ে ওঠা, সংসার, কর্মজীবন, দাম্পত্য-প্রেম, জীবন-জগৎ, সাহিত্য, দর্শন নিয়ে আলাপ করতে করতে তার মুখোমুখি পৌঁছে যায়।
তরুণদের ভাবনার জগতের সমান্তরালে আবির্ভূত হন হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা অসুস্থ জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ কল্পনায় নিজেকে দেখতে পান। তার সাদাসিধে জীবন কেমন বেখাপ্পা হয়ে উঠেছিল জীবনযাত্রার প্রায় প্রতিটি বাঁকে, কীভাবে তিনি নিজেকে খোলশের আবরণে আচ্ছাদিত করে চলেছিলেন, কীভাবে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করেও সাহিত্যকর্ম চালিয়ে গেছেনÑসেসবই উঠে আসে নাটকে। মা কুসুমকুমারী দাশ, স্ত্রী লাবণ্য কিংবা কাকাতো বোন শোভনা অথবা কবি বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের সঙ্গে জীবনানন্দ দাশের সম্পর্কের সূক্ষ্ম রন্ধ্রগুলো উপস্থাপিত হয়েছে নাটকে।
প্রযোজনাটিতে জীবনানন্দ দাশের চরিত্রে অভিনয় করছেন দিপু মাহমুদ, আরিফ আনোয়ার ও কে এম হাসান। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করছেন আশা আক্তার, বিপাশা সাইদ, মুনমুন খান, সুভাষ সরকার, আকলিমা আক্তার, শান্তনূর ইহসান, হাসিবুল হক, মৃন্ময় চৌধুরী, নওরীন পাপড়ি, রবিউল ইসলাম রাজিব, শাইরা, সূর্য, প্রীতম প্রমুখ। ঠা-ু রায়হানের আলোক পরিকল্পনায় কস্টিউম ডিজাইন করেছেন মহসিনা আক্তার। রমিজ রাজুর সংগীত পরিকল্পনায় মঞ্চ পরিকল্পনা করেছেন শাকিল সিদ্ধার্থ।