শিল্পের ইতিহাসে একটি প্রশ্ন চিরকালই জাগ্রত থাকে শিল্পী কবে থামবেন? তিনি কি অবসন্ন ও সৃজনীশক্তি নিঃশেষ হওয়ার পর, জনতার উচ্ছ্বাস ফুরিয়ে গেলে সরে যাবেন? নাকি সাহসের সঙ্গে নিজেই সীমারেখা টেনে দেবেন, যখন আলো এখনো দীপ্ত, হাততালির ঢেউ এখনো উত্তাল, দর্শকের আহ্বান এখনো প্রবল? প্রকৃত শিল্পীর পরিচয় অনেকাংশেই নির্ভর করে এই সিদ্ধান্তের ওপর। কারণ, বিদায় কেবল এক সমাপ্তির নাম নয়, এটি একটি নন্দনতাত্ত্বিক ঘোষণা, একটি দার্শনিক অবস্থান। বিদায়ে যেমন বেদনা থাকে, তেমনি থাকে মাধুর্যও। শিল্পীর বিদায়ও তেমন; এটি কেবল অনুপস্থিতি নয়, বরং স্মৃতির গভীরতা সৃষ্টি করে। বিদায় উচ্চারণ কোনো চূড়ান্ত বিলোপ নয়, বরং এটি অন্য রূপে ফিরে আসা, শিল্পীর উত্তরাধিকারে অমর হওয়া। বাংলাদেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী তাহসান খান সেই দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছেন। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, শিল্পীর জন্য সবচেয়ে মহৎ বিদায় হলো মধ্যগগনের সূর্যের মতো, যখন প্রভা সর্বাধিক, ঠিক তখনই অদৃশ্য হওয়া। এতে শিল্পীর উত্তরাধিকার দীর্ঘস্থায়ী হয়, মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকে। তাহসানের সিদ্ধান্তকে আরও গভীরভাবে বোঝার জন্য আমরা তাকাতে পারি বিশ্বের মহৎ শিল্পীদের দিকে-
ক্যাট স্টিভেন্স (ইউনাইটেড কিংডম) : ১৯৭০-এর দশকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় তিনি সংগীত জগৎ থেকে বিদায় নেন। ইসলাম গ্রহণের পর ধর্ম ও আধ্যাত্মিক জীবনের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করেন। অর্থ ও খ্যাতির মোহ থেকে বেরিয়ে নিজের আত্মিক শান্তিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন।
  লিওনার্ড কোহেন (কানাডা):  কয়েক দশক ধরে শ্রোতাদের মুগ্ধ করার পর হঠাৎ করেই তিনি গানের মঞ্চ থেকে সরে যান। আধ্যাত্মিক-অনুসন্ধানের জন্য তবহ মঠে চলে যান। পরে আবার ফিরে এলেও সেই বিরতি তার শিল্পীজীবনকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। 
  বব ডিলান (যুক্তরাষ্ট্র)  : খ্যাতির ঝড়ে থেকেও তিনি একাধিক সময় নীরবতা বেছে নিয়েছেন। কখনো মঞ্চ থেকে দূরে থেকেছেন, কখনো খ্যাতির সীমা ভেঙে ভিন্নধর্মী সংগীত করেছেন। তার এই থেমে যাওয়া বা দিক পরিবর্তনও ছিল এক ধরনের সাহসী সিদ্ধান্ত। 
 এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে খ্যাতির চূড়ায় থেকেও শিল্পী যদি নিজেকে আত্মার শান্তি ও নৈতিকতা অনুসারে পরিচালনা করেন, তাহলে তার সৃষ্টিশীলতা চিরস্থায়ী মর্যাদা পায়। তাহসান সেই একই নৈতিক স্রোতে দাঁড়িয়ে নিজের সিদ্ধান্তকে শিল্প-দর্শনের উচ্চতায় উন্নীত করেছেন। বাংলাদেশের সংগীত-ঐতিহ্যেও এমন দৃষ্টান্ত রয়েছে। লাকী আখন্দ, অল্প বয়সেই জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে, ব্যক্তিগত আঘাত ও জীবনের বাস্তবতায় সংগীত থেকে দীর্ঘ বিরতি নেন। পরে ফিরে এলেও সেই বিরতি প্রমাণ করেছে একজন শিল্পী চাইলে খ্যাতির চূড়া থেকে সরে গিয়েও নিজের শিল্পকে নতুন মর্যাদা দিতে পারেন। তাহসানের বিদায়ও সেই ধারার উত্তরসূরি। 
খ্যাতির মোহ বনাম আত্মার শান্তি : শিল্পীর সবচেয়ে বড় বিপদ হলো খ্যাতি ও অর্থের মোহ। একসময় শিল্পী নিজেকে হারায়, হয়ে ওঠে নিছক বাজারিপণ্য। কিন্তু তাহসান দেখিয়েছেন শিল্পী হতে হলে প্রথমেই মুক্তি চাইতে হয় খ্যাতির দাসত্ব থেকে। তিনি জনতার ভালোবাসাকে সম্মান করেছেন কিন্তু সেটিকে নিজের আত্মার শেকল হতে দেননি।
একজন গীতিকার হিসেবে আমি, তাহসানের এই সিদ্ধান্তকে গভীর শ্রদ্ধাসহ অভিনন্দন জানাই। জনপ্রিয়তার চূড়ায় থেকে নিজের সৃজনশীলতা ও নৈতিকতা রক্ষার এই সাহসী পদক্ষেপ আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। এটা শুধু ব্যক্তিগত বিদায় নয়, বরং বাংলাদেশের সংগীত জগতের জন্য এক মহৎদৃষ্টান্ত। তাহসান দেখিয়েছেন, খ্যাতি ও অর্থের মোহ কখনোই শিল্পীর সত্যিকারের পথ নির্ধারণ হতে পারে না, সৃজনশীলতা ও নৈতিকতা সর্বদাই প্রথম ও প্রণম্য।
ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা : তাহসানের এই সিদ্ধান্ত আমাদের ভবিষ্যতের শিল্পীদের জন্য গভীর এক শিক্ষা বহন করে। এটি শেখায় খ্যাতির চূড়ায় থেকেও একজন শিল্পী থামতে জানেন, নিজের সীমা ও মর্যাদার নিয়ন্ত্রণরেখা টানতে জানেন। অর্থ বা খ্যাতির প্রলোভন কখনোই শিল্পীর পথ নির্ধারণ করতে পারবে না। সত্যিকারের শিল্পী সর্বদা নিজের অন্তর্নিহিত নৈতিকতা ও সৃজনশীলতার ওপর ভর করে সিদ্ধান্ত নেন। এই শিক্ষা শুধুমাত্র সংগীতশিল্পীর জন্য নয়, যেকোনো সৃজনশীল ক্ষেত্রের জন্য প্রাসঙ্গিক। আমরা শিখি সাহসী আত্মনিয়ন্ত্রণ, নৈতিক দৃঢ়তা এবং নিজের অন্তরের প্রতি সততা।
আমরা তাহসানের গানকে স্মরণ করবো, তার কণ্ঠের আবেগকে হৃদয়ে ধারণ করবো। তবে সবচেয়ে বড় শিক্ষা হবে, তার সাহস ও নৈতিকতা জনপ্রিয়তার চূড়ায় থেকেও নিজের শিল্পকে মর্যাদাপূর্ণ রাখার দৃঢ় সিদ্ধান্ত। তাহসান, আপনি শুধু একজন গায়ক নন, আপনি হয়ে উঠেছেন শিল্পীর নৈতিক দৃষ্টান্ত, সাহসের প্রতীক। আপনার এই বিদায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় সত্যিকারের শিল্প কখনো অস্থায়ী নয়, তা চিরকালীন। শিল্পের আকাশে এক দীপ্তিমান আলোকবর্তিকা হিসেবে আপনি আমাদের মন ও মননে চিরকাল থাকুন।
 
 লেখক: গীতিকবি