চমক দেখানো ‘ওয়েনসডে’ এবার কতটা জমল
‘ওয়েনসডে’র প্রথম মৌসুম মুক্তির পরে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন ফেলে দেয়; ফ্যান্টাসি, টিন ড্রামা আর ডার্ক হিউমারের সমন্বয়ে হয়ে ওঠে পপ–কালচারের অন্যতম আলোচ্য। রহস্য-থ্রিলার ঘরানার নতুন আবহ আর গথিক লুক এই সিরিজকে নতুন মাত্রা দেয়। আর ওয়েনসডে অ্যাডাম চরিত্রে জেনা ওর্তেগার অভিনয় তাঁকে তরুণদের কাছে রাতারাতি জনপ্রিয়তা এনে দেয়। বিশেষত তাঁর সেই আবেগহীন, শীতল ‘ডেডপ্যান’ লুকের নাচ ভাইরাল হয়ে কোটি ভিউ ছাড়িয়ে যায়। ভক্তরা রিক্রিয়েট করতে থাকে তাঁর সেই ড্যান্স মুভ।
একনজরে
সিরিজ: ‘ওয়েনসডে ২’
পর্বসংখ্যা: ৮
ধরন: সুপারন্যাচারাল, মিস্ট্রি, কমেডি
স্ট্রিমিং: নেটফ্লিক্স
শোরানার: আলফ্রেড গফ ও মাইলস মিলার
পরিচালনা: টিম বার্টন ও গানজা মন্টেনিও
অভিনয়: জেনা ওর্তেগা, এমা মায়ার্স, ক্যাথরিন জেটা-জোনস, লুইস গুজম্যান, স্টিভ বুশেমি
২০২২–এর নভেম্বরে সিরিজটি যখন মুক্তি পায়, তা ৯৩টি দেশের ‘শীর্ষ ১০’–এর তালিকায় জায়গা করে নেয়। ‘স্ট্রেঞ্জার থিংস’-এর পরে নেটফ্লিক্সে প্রথম সপ্তাহে সবচেয়ে বেশিবার দেখা সিরিজ হয়ে ওঠে ‘ওয়েনসডে’। ইংরেজি সিরিজের জন্য যা ছিল নেটফ্লিক্সের রেকর্ড। প্রথম মৌসুম তো দুটি গোল্ডেন গ্লোবের মনোনয়নসহ চারটি প্রাইমটাইম এমি অ্যাওয়ার্ডসও জিতে নেয়।
এবার এসেছে ‘ওয়েনসডে’র দ্বিতীয় মৌসুম। দুই কিস্তিতে মুক্তি পায় সিরিজের আটটি পর্ব। সবশেষ চার পর্ব এসেছে ৩ সেপ্টেম্বর। টিম বার্টন, আলফ্রেড গফ ও মাইলস মিলারের সিরিজটি এবারও কি পারল দর্শকদের মন জয় করতে?
‘ওয়েনসডে’র প্রথম মৌসুম আবর্তিত হয়েছিল নেভারমোর একাডেমির ভেতরে এক হত্যা-রহস্যকে কেন্দ্র করে। তবে দ্বিতীয় মৌসুমের গল্প আরও বিস্তৃত। ‘ওয়েনসডে’ এবার অতিপ্রাকৃতিক জগতে আরও গভীরভাবে প্রবেশ করেছে। প্রথম ৬ মিনিট আগেই মুক্তি দেওয়া হয়েছিল ইউটিউবে। সেখান থেকেই দেখা যায়, ওয়েনসডে অ্যাডাম (জেনা ওর্তেগা) তাঁর ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার ক্ষমতা শাণিত করতে গ্রীষ্মকালজুড়ে অনুশীলনে ব্যস্ত। এর মাধ্যমেই তিনি এক ক্রমিক খুনির সঙ্গে প্রাণঘাতী খেলা খেলেছেন।
তবে তাঁর এ ভবিষ্যৎ দেখার ক্ষমতা নিয়ে চিন্তিত তাঁর মা, মর্টিশিয়া (ক্যাথরিন জেটা-জোনস)। ওয়েনসডে ফিরে আসতে চান নেভারমোরে। কারণ, মায়ের হস্তক্ষেপ এড়িয়ে এখানে তিনি নিজের ক্ষমতা শাণিত করতে পারবেন। এবার ওয়েনসডের সঙ্গে নেভারমোরে যোগ দেন তাঁর ভাই পুগসলে (আইজ্যাক অর্ডোনেজ)। কারণ, তাঁর মধ্যে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে নতুন ক্ষমতা, তাঁর শরীর থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়!
কিন্তু নেভারমোরে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বুঝতে পারেন, সবকিছু আগের মতো নেই। ওয়েনসডে এখন রীতিমতো বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন। গত বছর ভয়ংকর হাইড টাইলারকে (হান্টার ডুহান) ধরিয়ে দেওয়ার পর তিনি হয়ে উঠেছেন ক্যাম্পাসের তারকা। নেভারমোরে আসা মাত্রই তাঁর জুড়ে যায় এক রহস্যময় অনুসারী। অন্যদিকে প্রিয় বন্ধু এনিড সিনক্লেয়ারকে (এমা মায়ার্স) নিয়ে ওয়েনসডে দেখতে পান এক মর্মান্তিক ভবিষ্যদ্বাণী। নতুন প্রিন্সপাল ব্যারি ডর্ট (স্টিভ বুশেমি) নিয়োগ পান আর তিনি ওয়েনসডের মা মর্টিশিয়াকে আমন্ত্রণ জানান নেভারমোরে থাকার জন্য।
আউটকাস্টদের গোপন রহস্য, নেভারমোরের সঙ্গে জড়ানো ওয়েনসডের পারিবারিক ইতিহাস, আর একের পর এক বিপদ ওয়েনসডেকে হাতছানি দিতে থাকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিনি জড়িয়ে পড়তে থাকেন একের পর এক ঘটনায়।
প্রথম মৌসুমের মতো দ্বিতীয় মৌসুমও রহস্যময়, আকর্ষণীয়। তবে এই কিস্তির গল্প আরও ডালপালা মেলেছে। প্রথম মৌসুম মূলত নেভারমোরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রহস্যকেই কেন্দ্র করেছিল, কিন্তু এবার গোপন প্রকল্প, মানসিক হাসপাতাল, হারিয়ে যাওয়া মানুষ, বিশ্বাসঘাতকতা ও আত্মপরিচয়ের জটিলতা—সব মিলিয়ে এক বিস্তৃত জগৎ তৈরি হয়েছে। তবে গল্পের বিস্তৃত পরিধি সত্ত্বেও ভারসাম্য হারায়নি, বরং ওয়েনসডে অ্যাডামের জগৎকে আরও বিশদে জানতে পেরেছেন দর্শকেরা।
সিরিজটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে টিম বার্টনের নির্মাণ। হরর সিনেমার ভক্ত মাত্রই জানেন টিম বার্টন গথিক হরর ঘরানার ওস্তাদ নির্মাতা; ‘বিটলজুস’, ‘এডওয়ার্ড সিজরহ্যান্ডস’ নিয়ে তাই এত বছর পরেও আলোচনা হয়। কস্টিউম, নিখুঁত প্রোডাকশন ডিজাইন আর নির্মাণে বার্টনের ছাপ স্পষ্ট।
জেনা ওর্তেগা তাঁর অভিনয়ে আবারও প্রমাণ করেছেন, তিনি ছাড়া ‘ওয়েনসডে’ অসম্পূর্ণ। তাঁর ঠান্ডা চাহুনির আড়ালে তাঁর ডার্ক টিউমার, মানবিকতা ও আবেগহীনতার মিশেলে দ্বন্দ্বময় চরিত্র—সবই দর্শককে মুগ্ধ করে। এবারের মৌসুমে অনেক তারকার ভিড়েও জেনা ঠিকই সব আলো কেড়েছেন। ওয়েনসডে হয়ে উঠেছেন একই সঙ্গে ভয়ংকর ও কৌতূহলী। সিরিজের প্রতিটি রহস্য সমাধানে তাঁর আগ্রহ যেন আসে অহংকার থেকে; জীবন বাঁচানোর চেয়ে ধাঁধার সমাধান করাই তাঁর কাছে বড় বিষয়। এই ভিন্নতাই অন্য গোয়েন্দাদের কাছ থেকে তাঁকে আলাদা করে তুলেছে।
এমা মায়ার্সের সঙ্গে তাঁর রসায়নও এবারে আরও গভীর, যা তাঁদের বন্ধুত্বকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। ওয়েনসডের মা-বাবা মর্টিসিয়া ও গোমেজ অ্যাডামসের (ক্যাথরিন জেটা-জোনস ও লুইস গুজম্যান) উপস্থিতি এবার গল্পে গভীর প্রভাব ফেলেছে।
গথিক স্টাইল ‘ওয়েনসডে’ সিরিজের মূল আকর্ষণ হলেও দ্বিতীয় সিজন এর থেকে বের হয়ে আসতে চেষ্টা করেছে। যদিও অনেক দর্শকের এটা ভালো নাও লাগতে পারে। তবে হাসপাতালের দৃশ্য, গোপন সংস্থা, পারিবারিক ও অতীত ইতিহাসে গল্প এগিয়েছে দারুণভাবে। রহস্য ও থ্রিলারের গতি আগের মৌসুমের চেয়ে আরও টানটান।
পুরো সিরিজে ক্যামেরার কাজ দারুণ। পিয়ানো আর ভায়োলিনের সুরে গল্পের সাসপেন্স ধরে রাখার দিকটা ভালো ছিল। ভিজ্যুয়াল পরিবেশনা আগের সিজনের তুলনায় ভালো হয়েছে। আট পর্বের সিজনটির গতিও যথেষ্ট টানটান। মাঝের পর্বগুলো একাধিক সাবপ্লট থাকলেও মূল কাহিনি থেকে সরে যায়নি। যদিও কিছু পার্শ্বচরিত্রকে ভালোভাবে দেখানো হয়নি। কিন্তু এতে গল্প বুঝতে অসুবিধা হয় না। প্রথম মৌসুমের মতো আইকনিক নাচের দৃশ্য এবার নেই। একইভাবে কোনো সংলাপই আলাদা করে মনে দাগ কাটে না।
এ ছাড়া কিছু সাবপ্লট যেমন রোমান্টিক ট্র্যাক অপ্রয়োজনীয়ভাবে টেনে নেওয়া হয়েছে। এতে কখনো একঘেয়ে লেগেছে। মনে হয়েছে, কোনো কোনো পর্বের দৈর্ঘ্য কি একটা ছোট হতে পারত। নতুন খলনায়ক প্রত্যাশা অনুযায়ী শক্তিশালী ছিল না। ফলে রহস্য সমাধানের আগেই বোঝা গেছে কী হতে চলেছে।
তবে সিরিজটিকে বাঁচিয়ে দিয়েছে টিম বার্টনের নির্মাণ। হরর সিনেমার ভক্ত মাত্রই জানেন টিম বার্টন গথিক হরর ঘরানার ওস্তাদ নির্মাতা; ‘বিটলজুস’, ‘এডওয়ার্ড সিজরহ্যান্ডস’ নিয়ে তাই এত বছর পরেও আলোচনা হয়। কস্টিউম, নিখুঁত প্রোডাকশন ডিজাইন আর নির্মাণে বার্টনের ছাপ স্পষ্ট।
গথিক আবহ, ডার্ক হিউমার আর টানটান উত্তেজনা মিলিয়ে ‘ওয়েনসডে ২’ আগের মৌসুমের শক্তি ধরে রাখতে পেরেছে। চরিত্রগুলোর ভেতরের আবেগ ও সম্পর্কে গভীরতা এসেছে। কিছু খামতি থাকলেও এটি তাই মোটা দাগে দর্শকদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে।