ধারাবাহিক নাটক ‘ইউসুফ জুলেখা’ সারা বিশ্বের দর্শকদের হৃদয়ে এক অনন্য স্থান দখল করে নিয়েছে। বিশেষ করে নবি হজরত ইউসুফের (আ.) চরিত্রে অভিনয় করে আলোচনায় আসেন মোস্তফা জামানি। ধর্মীয় কাহিনি অবলম্বনে নির্মিত এই সিরিজের প্রতিটি পর্বে তার সাবলীল, বিনয়ী অভিনয় দর্শককে গভীর আবেগে ছুঁয়ে যায়। অনেকের কাছেই তিনি এখনো ‘ইউসুফ নবি’ নামে পরিচিত।
কে এই মোস্তফা জামানি? অনেকেই তার ব্যাপারে জানতে চান। মোস্তফার জন্ম ১৯৮২ সালের ২১ জুন ইরানের মাজান্দারান প্রদেশে। তার পরিবার মূলত তাজিক বংশোদ্ভূত। ব্যক্তি জীবনে তিনি দুই সন্তানের জনক। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন মেধাবী ও শিল্পপ্রাণ। ইরানের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকলেও অভিনয়ে তার আনুষ্ঠানিক শুরু ২০০০ সালের পরপর।
তবে ফারাজুল্লাহ সালাহশু পরিচালিত ২০০৮ সালে প্রচারিত ‘ইউসুফ জুলেখা’ সিরিজ মোস্তফা জামানির ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় কাহিনির সিরিজটিতে তার চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব ছিল কঠিন। কারণ ইউসুফ নবি শুধু একটি নাটকের চরিত্র নন বরং কোটি মানুষের বিশ্বাসের প্রতীক। তবে মোস্তফা জামানি সেই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেন। তার কোমল চাহনি, মিষ্টি হাসি এবং আন্তরিক অভিব্যক্তি দর্শকের মনে ইউসুফ নবির সৌন্দর্য ও পবিত্রতার ছাপ এঁকে দেয়।

সিরিজ প্রচারের পরপরই ইরানসহ বিশ্বের মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে মোস্তফা জামানি এক পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্যের দর্শকরাও তার অভিনয়ে মুগ্ধ হন। অনেকে তাকে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের মতো শ্রদ্ধা করতে শুরু করেন। যদিও তিনি সবসময় দাবি করেন, ‘আমি একজন শিল্পী মাত্র। অভিনয়ের মাধ্যমে শুধু ইতিহাসকে তুলে ধরেছি। আমি কোনো আধ্যাত্মিক কেউ নই।’
‘ইউসুফ জুলেখা’র সাফল্যের পর মোস্তফা জামানি ২০০৯ সালে ‘আউল’ নামক চলচ্চিত্র দিয়ে তার সিনেমা যাত্রা শুরু করেন। এরপর তিনি চলচ্চিত্র ও ওয়েব প্ল্যাটফর্মে বেশ কিছু প্রশংসিত কাজ করেন। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘ফেয়ারওয়েল বাগদাদ’ (২০০৯), ‘দ্য কুইন’ (২০১২), ‘টেক অফ’ (২০১৫), ‘সারা এন্ড আয়দা’ ও ‘অ্যা স্পেশাল ডে’ (২০১৭), ওয়েব সিরিজ ‘ব্লু হোয়েল’, (২০১৯), ‘রিহনো’ (২০১৯–২০২০) ইত্যাদি।
২০২২ সালে মুক্তি পাওয়া তার অভিনীত চলচ্চিত্র ‘নো প্রিওর অ্যাপয়েন্টমেন্ট’, ‘দ্য সিক্সথ ডে’ এবং ২০২৩ সালের ‘ফ্যাগ্রেন্ট’ দর্শক প্রশংসা কুড়িয়েছে। এছাড়া ২০২৪ সালে তিনি ইরাকি প্রেক্ষাপটে নির্মিত সিরিজ ‘আমিরলি’তে ড. রাফেদ চরিত্রে অভিনয় করেন।

অভিনয়ের জন্য তিনি দেশ-বিদেশে বহু পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে তিউনিশিয়ায় আয়োজিত দ্বিতীয় জাতীয় নাট্য উৎসবে বিশেষ সম্মাননা লাভ করেন মোস্তফা জামানি। এতে তার আন্তর্জাতিক পরিচিতি আরও শক্তিশালী হয়।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে ‘ইউসুফ জুলেখা’ সিরিজ দিয়ে মোস্তফা জামানি দর্শকদের কাছে ইউসুফ নবির চরিত্রেই স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছেন। এই চরিত্রটিই হয়ে গেছে তার সবচেয়ে বড় পরিচয়। এ বিষয়ে একবার তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল ‘আপনি সবসময় ইউসুফ নবির চরিত্র হয়েই থাকবেন। কখনোই এ পরিচয় থেকে বেরোতে পারবেন না। এটা কেমন লাগে আপনার?’
৪৩ বছর বয়সী মোস্তফা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে জবাব দেন, ‘আমি কেন তা থেকে বের হতে যাবো? আমি বিশ্বাস করি, সময় অনেক কিছু মুছে দেয়। কিন্তু কিছু চরিত্র সময়কে অতিক্রম করে টিকে থাকে। তেমনি আমি এই পৃথিবী ছেড়ে গেলেও মানুষ আমাকে হজরত ইউসুফ (আ.) চরিত্র দিয়েই মনে রাখবে। আমি অবশ্যই এটা উপভোগ করি।’