তৈরি পোশাকশিল্পের ঠিকায় কাজ করা বা সাব–কন্ট্রাক্ট কারখানাগুলোকেও বিশেষ নগদ সহায়তা বা প্রণোদনা দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এত দিন এ সুবিধা কেবল নিজস্ব কারখানায় উৎপাদনকারী রপ্তানিকারকেরা পেতেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নগদ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্তটি প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত হলেও প্রস্তাবনার সারসংক্ষেপ এখনো অর্থ উপদেষ্টার চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। সেটি হলে রপ্তানিকারকদের মাধ্যমে সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানাগুলো শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ হারে প্রণোদনার একটি অংশ পাবে।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন গত মে মাসে ইতিবাচক মতামত দিয়েছে। এ ছাড়া বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানান অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানাগুলোকেও বিশেষ নগদ সহায়তা দেওয়ায় বিষয়টি এখনো অনুমোদন করা হয়নি। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ৬ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরলে তা অনুমোদন করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দেওয়ার মোট পরিমাণ বাড়বে না।
তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, সাব-কন্ট্রাক্ট করা কারখানাগুলো বিশেষ নগদ প্রণোদনা পেলে তাতে তৈরি পোশাক খাতের ছোট-মাঝারি কারখানাগুলো সুবিধা পাবে। তবে কীভাবে বিশেষ এই প্রণোদনা দেওয়া হবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। ফলে নীতিগত সিদ্ধান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত সাব-কন্ট্রাক্ট করা কারখানা কীভাবে সুবিধা পাবে, সেটি পরিষ্কার নয়।
পোশাকশিল্পের ঠিকায় কাজ করা কারখানাগুলোকে প্রণোদনা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলেও গত বছর দুই দফায় নগদ সহায়তার পরিমাণ কমিয়েছে সরকার। বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশেষ নগদ সহায়তা দশমিক ৩ শতাংশ। গত বছরের শুরুতেও এই প্রণোদনার হার ছিল ১ শতাংশ।
এদিকে বিজিএমইএ বিদ্যমান বিশেষ নগদ সহায়তার হার দশমিক ৩ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১ শতাংশ করা, শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র ব্যাকের পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তার হার ১ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রণোদনা হার ৩ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ করার দাবি জানিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিজিএমইএর যুক্তি, বর্তমান ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক এ সংকটে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। গত এক বছরে ব্যাংকিং সেক্টরে সংকট, শ্রম অসন্তোষ ও সার্বিক নিরাপত্তা ইস্যুর কারণে শিল্পের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত এবং সরবরাহব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে। কিন্তু পোশাকের মূল্য বাড়েনি, বরং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য কমেছে। এ কারণে বিনিয়োগ কমে আসছে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উত্তরণের পর নগদ সহায়তা পাওয়া যাবে না। তার আগে যদি উদ্যোক্তারা বাড়তি প্রণোদনা পায়, তাহলে তারা আর্থিকভাবে শক্তিশালী হবে। তাতে ব্যবসার সম্প্রসারণ হবে। তখন এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাও সহজ হবে। সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানাকে বিশেষ নগদ সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের পরিষ্কার ধারণা নেই।’
ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে সাব-কন্ট্রাক্ট কারখানার প্রণোদনার বিষয়টি গতি পায়। তবে প্রক্রিয়াটি শুরু হয় গত বছরের অক্টোবরে। একটি মূল কোম্পানির অধীন ভিন্ন ভিন্ন কারখানায় বা কোম্পানিতে সাব-কন্ট্রাক্টিং প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত ও রপ্তানি করা তৈরি পোশাক বা বস্ত্রসামগ্রী রপ্তানিতে নগদ সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয় পর্যালোচনা করতে ট্যারিফ কমিশনকে সমীক্ষা করতে বলা হয়।
গত মে মাসে ট্যারিফ কমিশন সমীক্ষা প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। এতে বলা হয়, সাব-কন্ট্রাক্টিং প্রক্রিয়া একই মালিকানাধীন ভিন্ন কোম্পানিতে যেমন হতে পারে, তেমনি ভিন্ন ভিন্ন মালিকানাধীন কোম্পানির মাধ্যমেও হতে পারে। তাই এই প্রক্রিয়ায় নগদ সহায়তা দেওয়ার ক্ষেত্রে একই মালিকানাধীন ভিন্ন ভিন্ন কোম্পানির পরিবর্তে ভিন্ন মালিকানার মধ্যেও যেন সাব-কন্ট্রাক্টিং হয়, সে সুযোগ রেখে নগদ সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা রাখলে তা সর্বজনীন ও বস্তুনিষ্ঠ হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ফাস্ট সেল ব্যবস্থায় ক্রয়াদেশ দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এ ব্যবস্থায় আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকের বাইরে তৃতীয় পক্ষ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। ফাস্ট সেল ব্যবস্থা অনুযায়ী, প্রথম বিক্রেতার মাধ্যমে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে মার্কিন ক্রেতার মূল শর্ত হচ্ছে, ক্রয়াদেশ গ্রহণকারী কখনোই উৎপাদনকারী হতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে ক্রেতার মনোনীত কারখানা থেকে ক্রয়াদেশ গ্রহণকারীর পণ্য নিতে হবে। অর্থাৎ উৎপাদনকারী ও ক্রয়াদেশ গ্রহণকারী রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান পৃথক হতে হবে।
ফাস্ট সেলের ক্ষেত্রে পণ্য আমদানিকারক দেশ (মূলত যুক্তরাষ্ট্র) প্রথম বিক্রীত মূল্যের ওপর শুল্ক প্রদান করে। এতে আমদানিকারক দেশে শুল্ককরের ভার কমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ক্রেতা একটি নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য একটি বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে (রপ্তানিকারক) ১০০ ডলারের ক্রয়াদেশ দিয়েছে। সেই প্রতিষ্ঠান পণ্য উৎপাদনের জন্য ক্রেতার মনোনীত কোনো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানকে সাব-কন্ট্রাক্ট দেয়। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ইন্টার বন্ড ট্রান্সফারের মাধ্যমে সরবরাহ করে। এ ক্ষেত্রে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় দাঁড়ায় ৯২ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে পণ্যটি আমদানি করার সময় ফাস্ট সেল ভিত্তিতে পণ্যের শুল্কায়ন মূল্য ধরা হয় ৯২ ডলার। এর ফলে ৮ ডলারের মূল্যের ওপর কোনো শুল্ক পরিশোধ করতে হয় না।
ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফাস্ট সেলের বিষয় থেকেই সাব-কন্ট্রাক্টিং প্রক্রিয়ায় উৎপাদন ও রপ্তানি করা পণ্যে নগদ সহায়তা দেওয়ার ইস্যুটি এসেছে। ফলে তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ফার্স্ট সেলের অধীন রপ্তানি বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ২০২০ সালের ১ নম্বর প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে নিজস্ব কারখানা বা সাব–কন্ট্রাক্টিং প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে ১ শতাংশ হারে উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারককে বিশেষ নগদ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় ফাস্ট সেলের অধীন ঠিকায় কাজ করা কারখানাগুলো নগদ সহায়তা দেবে কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
জানতে চাইলে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, তৈরি পোশাকশিল্পের প্রায় ১০ শতাংশ কারখানা সাব-কন্টাক্ট করে। ফলে বিশেষ নগদ সহায়তা দেওয়া হলে তাদের আর্থিক ভিত্তি শক্ত হবে।