নড়াইল সদর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা গোয়াইলবাড়ির ভোঁদড়পল্লিতে চিত্রা নদীর পাড়ে বসে ছবি আঁকছে শিশুরা। গতকাল শনিবার বিকেলেছবি : প্রথম আলো

ভোঁদড়পল্লির শিশুদের রঙিন ক্যানভাসে গ্রামবাংলার চিত্র

চিত্রা নদীর ঘাটে বাঁধা মাছ ধরার নৌকা। পাশে খাঁচায় শান্তভাবে বসে আছে ভোঁদড়। সেই নদীর পাড়েই রঙে রঙে ক্যানভাস ভরিয়ে তুলছে প্রত্যন্ত ভোঁদড়পল্লির শিশুরা। কেউ আঁকছে বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে, কারও তুলিতে ফুটে উঠছে কৃষকের ঘামে ভেজা দেহ ও ধানের মাঠ। আবার কারও ছবিতে নদীর বুকে পাল তুলে ভেসে চলেছে নৌকা, কারও রঙের আঁচড়ে ভোরের আকাশ জেগে উঠছে আগুনঝরা সূর্যের লাল-কমলা আভায়।

১০ আগস্ট ছিল এস এম সুলতানের ১০১তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে নড়াইল সদর উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকা গোয়াইলবাড়ির জেলেপল্লিতে গতকাল শনিবার শেষ হয়েছে দুই দিনব্যাপী সুলতান উৎসবের। ওই পল্লির শিল্প সংগঠন ‘চারু প্রাঙ্গণ শিল্পালয়’ এ উৎসবের আয়োজন করে। এ উৎসবে সহযোগিতা করে এস এম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশন ও অটার ফিশিং কমিউনিটি বাংলাদেশ।

গত শুক্রবার সুলতানের জীবন নিয়ে আলোচনা সভার মধ্য দিয়ে এ উৎসবের শুরু, আর শেষ হয় গতকাল সন্ধ্যায়। শিল্পচর্চা, প্রদর্শনী, আলোচনা সভা আর চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ভোঁদড়পল্লিতে প্রথমবারের মতো সুলতান উৎসবের আয়োজন করা হলো।

চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ভোঁদড়পল্লির শতাধিক শিশু। তাদের মধ্যে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা বিশ্বাস বলে, ‘শিল্পী সুলতানের জন্মদিন উপলক্ষে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এখানে আমি সুলতানের একটি ছবি এঁকেছি। আমার খুব ভালো লাগছে।’

গ্রামবাংলার চিরচেনা এক দৃশ্য এঁকেছে শিক্ষার্থী লেখা বিশ্বাস। সে বলে, ‘আমার সঙ্গে আরও অনেকে এসেছে ছবি আঁকতে। আমার ছবিতে একটি গ্রামের ছবি এঁকেছি। ছবিতে কয়েকটি ঘরবাড়ি রয়েছে। তাঁর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। সেখানে চলছে নৌকা। আকাশে পাখি উড়ছে। আমরা সবাই মিলে খুবই আনন্দ করছি।’

চিত্রাঙ্কনের সময় শিশুদের পাশে থেকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন তাঁদের প্রশিক্ষক চিত্রশিল্পী ডিডি মল্লিক। তিনি বরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের শিষ্য। গুরু সুলতানের শিক্ষা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘চারদেয়ালের মধ্যে থেকে মনে করে কিংবা অনুমান করে ছবি আঁকা যায় না। আমি চাই ছেলেমেয়েকে প্রকৃতির মাঝে নিয়ে আসতে। যাতে ফুল-পাতা সে ছুঁয়ে দেখতে পারে। তাহলে তার শেখাটা ভালো হয়। সে আরও সুন্দর করে ছবিটা ফুটিয়ে তুলতে পারে৷ এ কারণেই নদীর পাড়ে খোলা পরিবেশে এ আয়োজন।’

আয়োজক সংগঠন সূত্রে জানা যায়, ভোঁদড় দিয়ে মাছ শিকার করা জেলেদের এই পল্লির শিশুরা বেশির ভাগ সময়ই নানা সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকে। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক চর্চার ক্ষেত্রেও তারা অবহেলিত। তাই তাদের কথা ভেবে ৯ মাস আগে ওই পল্লিতে ‘চারু প্রাঙ্গণ শিল্পালয়’ নামে একটি শিল্প সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন চলচ্চিত্র নির্মাতা সামছুল ইসলাম (স্বপন)। এর পর থেকে বিনা পারিশ্রমিকে ওই সংগঠনের পক্ষ থেকে ভোঁদড়পল্লির শিশুদের চিত্রাঙ্কন শেখানো হচ্ছে।

সামছুল ইসলাম বলেন, ‘দুই দিনব্যাপী এ উৎসব করার উদ্দেশ্য শিশুদের সঙ্গে বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের পরিচয় করানো, যাতে সুলতানের চিত্রকর্ম দেখে শিশুরা অনুপ্রাণিত হতে পারে, নিজ অঞ্চল ও সংস্কৃতি সম্পর্কে শিশুরা জানতে পারে।’

গতকাল বিকেলে শিশুদের আঁকা ছবিগুলো প্রদর্শিত হয় পাশের গোয়াইলবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বারান্দায়। আশপাশের বিভিন্ন বয়সী মানুষ তা দেখতে ভিড় করেন। সন্ধ্যার দিকে বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পরে শিশুদের সামনে বড় পর্দায় প্রদর্শিত হয় সুলতানের জীবন ও কর্ম নিয়ে তারেক মাসুদ নির্মিত চলচ্চিত্র ‘আদম সুরত’।

দুই দিনের এই উৎসবে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এস এম সুলতান শিশু চারু ও কারুকলা ফাউন্ডেশনের সভাপতি শেখ হানিফ, অ্যাপেক্সের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের প্রধান আরিফুর রহমান খান, নড়াইল আবদুল হাই সিটি কলেজের সহকারী অধ্যাপক সসীম কুমার সরকার, এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালার কিউরেটর তন্দ্রা মুখার্জি, নড়াইল বিআরটিএর মোটরযান পরিদর্শক ফরহাদ হোসেন ও ব্র্যাকের জেলা সমন্বয়ক জাহিদুল ইসলাম। এ ছাড়া চারু প্রাঙ্গণ শিল্পালয়ের সভাপতি কল্যাণ কুমার বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক সুকান্ত কুমার বিশ্বাস, সদস্য বিশাল বিশ্বাস প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

অতিথিরা প্রত্যন্ত একটি জেলেপল্লিতে এমন আয়োজনের প্রশংসা করেন এবং শিশুদের আঁকা ছবি দেখে মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। শেখ হানিফ বলেন, ‘জেলেপল্লির শিশুরা এত ভালো ছবি আঁকে, এটা আমার কাছে খুবই অবাক লাগছে। আগামী দিনে অনেক ভালো কিছু এই জনপদ থেকে বের হবে।’