শিল্পী এস এম সুলতানের ১০১তম জন্মবার্ষিকী আজ
মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে তার বর্ণিল ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতেন বরেণ্য শিল্পী এস এম সুলতান। কৃষকের বিপুল শক্তিকে যিনি মহাকালের আর্কাইভে রেখে গেলেন এবং দেখিয়ে গেলেন দরিদ্র কৃষক দুর্বল নয়। সেই বৈষম্যবিরোধী সাম্য ও সুন্দরের স্বমিশ্রিত শিল্পভাষার মহান চিত্রশিল্পী সুলতানের আজ জন্মবার্ষিকী।
১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট এ দিনে নড়াইলের মাছিমদিয়ায় মেছের আলী ও মাজু বিবির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন মাটি ও মানুষের চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান।
জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে নড়াইলের জেলা প্রশাসন ও এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- শিল্পীর রুহের মাগফিরাত কামনায় পবিত্র কোরআনখানি, চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতা, শিল্পীর প্রতিকৃতিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, মাজার জিয়ারত ও দোয়া মাহফিল।
এ ছাড়া শনিবার (৯ আগস্ট) থেকে জন্মশতবর্ষে সুলতান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উদ্যাপন কমিটির আয়োজনে ঢাকার বেঙ্গল ফাউন্ডেশনে শুরু হয়েছে ‘আমরা পরাজিত হলে এস এম সুলতানের স্বপ্ন আড়ালেই থেকে যাবে’ শিরোনামে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করা হয়েছে।
শিল্প সাহিত্য জগতের অনন্য নাম এস এম সুলতান। পুরো নাম শেখ মোহাম্মদ সুলতান। যদিও শৈশবে তার বাবা নাম রেখেছিলেন লাল মিয়া। বাবা শেখ মোহাম্মদ মেসের আলী ছিলেন একজন রাজমিস্ত্রি। কিন্তু সুলতানের কাছে তার বাবা ছিলেন একজন শিল্পী। তৎকালীন জমিদার বাড়ির অনেক নকশা সুলতানের বাবার করা। সুলতান সেসব কাজ দেখেছেন একদম কাছ থেকে, যা তাকে পরবর্তীকালে শিল্পী হতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
স্কুলে ভর্তি হলেও স্কুলের বাঁধাধরা নিয়মে পড়ালেখা তার ভালো লাগত না। সময় কাটতো প্রকৃতিকে অনুভব করে। কখনো ক্লাসে বসে আবার কখনো চিত্রা নদীর পাড়ে বসে স্কেচ করতেন। স্কুলের শিক্ষক রঙ্গলাল ব্যাপারটি খেয়াল করলেন। সুলতানের খাতা দেখে বুঝতে পারলেন তার মধ্যে এক শিল্পী বাস করছে। তিনি সুলতানের ভেতরের সেই সত্তাকে গড়ে তুলতে চাইলেন। তিনি সুলতানকে তার নিজের বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে রঙ্গলাল সুলতানকে তার সব জ্ঞান উজাড় করে দিলেন। সেই শুরু।
১৯৫০ সালে ইউরোপ সফরের সময় যৌথ প্রদর্শনীতে তার ছবি সমকালীন বিশ্ববিখ্যাত চিত্রশিল্পী পাবলো পিকাসো, ডুফি, সালভাদর দালি, পল ক্লি, মানেট, মাতিসের ছবির সঙ্গে প্রদর্শিত হয়। সুলতানই একমাত্র এশিয়ান শিল্পী যার ছবি এসব শিল্পীর ছবির সঙ্গে একত্রে প্রদর্শিত হয়েছে।
শিল্পী এস এম সুলতান ছিলেন মাটি ও মানুষের শিল্পী। তার শিল্পকর্মের বিষয় ছিল বাংলার কৃষক, জেলে, তাঁতি, কামার ও কুমারের জীবন-যাপন এবং তাদের সংগ্রামী জীবনের ছবি। তিনি ভালো বাঁশি বাজাতে পারতেন। পুষতেন সাপ, ভল্লুক, বানর, খরগোশ, মদনটাক, ময়না, গিনিপিক, মুনিয়া, ষাঁড়সহ বিভিন্ন প্রাণী।
সৃষ্টিশীল এই শিল্পী নড়াইলের পুরুলিয়ায় ১৯৫৫-৫৬ সালে ‘নন্দন কানন ফাইন আর্ট এন্ড স্কুল, ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকে যশোর এম.এম কলেজের একটি পুরোনো হোস্টেলে একাডেমি অব ফাইন আর্ট স্কুল, ১৯৭৮ সালের দিকে জন্মস্থান নড়াইলের মাছিমদিয়ায় ফাইন আর্ট স্কুল এবং ১৯৮৭ সালে নড়াইলের কুরিগ্রামে “শিশুস্বর্গ” নামে শিশু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। তিনি শিশুদের খুব ভালোবাসতেন। তাদের জন্য তৈরি করেন বড় বজরা (ইঞ্জিনচালিত নৌকা)। তার আশা ছিল শিশুদের সাথে প্রকৃতিকে পরিচয় ঘটিয়ে দিতে এই বজরায় করে চিত্রা নদীতে শিশুদের নিয়ে ছবি আঁকবেন। কয়েকবার তিনি শিশুদের নিয়ে চিত্রা নদীতে ঘুরে ছবি আঁকানো শিখিয়েছেন।
১৯৯৩ সালের ১০ আগস্ট শিল্পী নিজ উদ্যোগে চিত্রাঙ্কন, নৃত্য ও সংগীত শিক্ষার জন্য ‘লাল বাউল সম্প্রদায়’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে তোলেন। ২০০৩ সালে শহরের কুড়িগ্রামে সরকার শিল্পীর নামে সুলতান কমপ্লেক্স গড়ে তুলেছে। ২০০৯ সালে শিল্পীর ভক্তরা সুলতানের বাগান বাড়ি শহরের পশ্চিম মাছিমদিয়ায় ‘এস এম সুলতান বেঙ্গল চারুকলা মহাবিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
চিত্রশিল্পের খ্যাতি হিসেবে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ম্যান অব দ্য ইয়ার’, নিউইয়র্কের বায়োগ্রাফিক্যাল সেন্টার থেকে ‘ম্যান অব অ্যাচিভমেন্ট’ এবং এশিয়া উইক পত্রিকা থেকে ‘ম্যান অব এশিয়া’ পুরস্কার পেয়েছেন। এছাড়া ১৯৮২ সালে একুশে পদকসহ ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট স্বীকৃতি এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সংসদ সম্মাননা।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মারা যান তিনি। ‘মাটি ও মানুষের চিত্রশিল্পী’ এস এম সুলতানকে জন্মভূমি নড়াইল শহরের কুড়িগ্রাম এলাকায় সংগ্রহশালা চত্বরে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।