মিথিলার বয়স মাত্র তিন বছর। আধো আধো শব্দে মিষ্টি স্বরে কথা বলত। দাদি আনজুআরা বেগমের অতিপ্রিয় ছিল সে। মিথিলার যে কোনো আবদার নিমিষেই পূরণ করতেন তিনি। বৃহস্পতিবার দুপুরে দাদির কাছে মাছ খেতে চেয়েছিল সে। কিন্তু এটিই যে, তার শেষ চাওয়া জানতেন না আনজুআরা। বাজার থেকে মাছ আনিয়ে রান্নার পর আদরের নাতনিকে ডাকতে গিয়ে দেখেন-সে, তার ভাই ও বাবা-মা সবাই তাদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন।
রাজশাহীর পবা উপজেলার বামনশিকড় গ্রামে শুক্রবার একই পরিবারের চার লাশ উদ্ধারের পর পরিবারটিতে আহাজারি থামছে না। শনিবার সরেজমিন দেখা যায়, কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দাদি আনজুআরা। শোকে পাথর দাদা রুস্তম আলী। ঘরের এক কোণে উদাস বসে আছেন। অন্য স্বজনরাও এখানে ওখানে বসে নীরবে চোখের পানি ফেলছেন।
আনজুআরা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, দাদু আমার মাছ খেতে খুব পছন্দ করত। বৃহস্পতিবার দুপুরে আমাকে মাছ রান্না করে দিতে বলেছিল। কিন্তু বাড়িতে মাছ ছিল না। শুক্রবার সকাল ৬টার দিকে আধা কিলোমিটার দূরের বাজার থেকে তেলাপিয়া মাছ আনিয়ে ছিলাম। ৭টার মধ্যে রান্না শেষ হয়ে যায়। অন্যদিন মিথিলা খুব সকালে উঠলেও সেদিন না ওঠায় ডাকাডাকি করছিলাম। কিন্তু মিথিলা বা তার বাবা-মা কেউই সাড়া দেয়নি। পরে দেখি সবাই লাশ। আদরের নাতিটার মাছ খাওয়ার ইচ্ছা পূরণ করতে পারিনি। বলেই আবার কাঁদতে থাকেন তিনি।
বামনশিকড় মধ্যপাড়া গ্রামের কৃষক হাসান আলী বলেন, মিনারুল খুব ভদ্র ছেলে ছিল। কারও সঙ্গে খুব বেশি মিশত না। মাথা নিচু করে চলত। প্রচুর কাজ করত। তিনি বলেন, কিস্তির টাকা না দিলে এনজিওর লোকেরা মিনারুলের বাড়িতে এসে বসে থাকতেন। যতক্ষণ টাকা না দিতেন ততক্ষণ উঠতেন না। এতে মিনারুল খুব বিব্রত হতো।
এদিকে একই পরিবারের চারজনের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। একটি হত্যা মামলা, অন্যটি অপমৃত্যুর। শুক্রবার রাতে মহানগরীর মতিহার থানায় মামলা দুটি করা হয়। মতিহার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল মালেক বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, মিনারুল ইসলামের আত্মহত্যার ঘটনায় তার বাবা রুস্তম আলী অপমৃত্যুর মামলা করেন। আর মিনারুলের স্ত্রী মনিরা খাতুন, ছেলে মাহিম ও মেয়ে মিথিলাকে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগে হত্যা মামলাটি করেন মনিরার মা শিউলী বেগম। ওসি বলেন, মামলা দুটিতে আসামি হিসাবে কারও নাম উল্লেখ নেই।
চার লাশ দাফন : শনিবার দুপুরের পর রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে চারটি লাশ স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরমধ্যে মিনারুল এবং তার ছেলে মাহিমের লাশ তার বাবা রুস্তম আলী ও বড় ভাই রুহুল আমিনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। আর মনিরা ও তার মেয়ে মিথিলার লাশ মনিরার বাবা আব্দুস সালাম ও মা শিউলি বেগমকে দেওয়া হয়। তারা লাশ দুটি তাদের বাড়ি রাজশাহী মহানগরীর তালাইমারিতে নিয়ে সেখানে দাফন করেন।
পারিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শায়েদ আলী মোর্শেদ বলেন, মিনারুলের শ্বশুর ও শাশুড়ি মনিরা ও মিথিলার লাশ তাদের নিজ এলাকায় দাফনের জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করেন। এ কারণে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে লাশ দুটি তাদের দেওয়া হয়েছে।
এদিকে মিনারুল ও তার ছেলে মাহিমের লাশ বামনশিকড় গ্রামে পৌঁছলে সেখানে শোকের ছায়া নামে। তাদের শেষবারের মতো দেখতে মানুষের ঢল নামে। পরে জানাজা শেষে তাদের লাশ বামনশিকড় দক্ষিণপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।