১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনে সহিংসতার খবর পরেরদিন ৪ সেপ্টেম্বর ছবিসহ প্রকাশ করে দৈনিক পূর্বদেশছবি: দৈনিক পূর্বদেশ থেকে নেওয়া

ডাকসুর যে নির্বাচনে ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়েছিল

ক্যালেন্ডারের পাতায় ১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। দিনটি ছিল সোমবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে হল সংসদ ও ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণ হয়। বিকেল ৫টার পর শুরু হয় ভোট গণনা। সূর্য ডুবে সন্ধ্যা নামে, শুরু হয় ফিসফাস, চারদিকে চাপা উত্তেজনা। ওই সময় ছেলেদের বেশ কয়েকটি হলে ‘ইলেকট্রিসিটি’ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সুযোগে গাড়িতে করে গুলি করতে করতে হলে ঢোকে সন্ত্রাসীরা। হাতে তাদের রিভলভার, স্টেনগানসহ নানা অস্ত্রশস্ত্র। মুহূর্তে ঢুকে যায় ভোট গণনার রুমে। চিৎকার করে সবাইকে অস্ত্র তাক করে গণনা থামতে বলে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে চলে যায় তারা।

দেশের অবস্থা তখন কেমন ছিল ?

১৯৭৩ সালে দেশে নানামুখী সংকট চলছিল। তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা। দেশজুড়ে গোপন দলগুলোর চোরাগোপ্তা হামলা, রক্ষী বাহিনীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ও খুন এবং চোরাকারবারি হরহামেষাই হচ্ছিল। দিনে–দুপুরে আওয়ামী লীগের এমপিরা সর্বহারা ও দুষ্কৃতিকারীরদের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছিলেন। বলা যায়, সদ্য স্বাধীন দেশ নৈরাজ্যে নিমজ্জিত ছিল।

ওই সময় বাজারব্যবস্থা কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর হাতে চলে যায়। অস্বাভাবিকভাবে বাড়ে নিত্য পণ্যের দাম। ফলে, স্বল্পমূল্যে খাদ্যসামগ্রী কিনতে সাধারণ মানুষের জন্য সরকার ‘রেশন কার্ড’ চালু করে। কিন্তু এক শ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কারণে অবৈধ ব্যবসায়ীদের হাতে প্রচুর ‘ভুয়া রেশন কার্ড’ চলে যায়। সেই প্রেক্ষাপটে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৭৩ সালের ১৩ জুন ভুয়া রেশন কার্ড উদ্ধার অভিযান শুরু করে। সংগঠন দুটির মধ্যে তখন সমঝোতা তৈরি হয়। তবে কালোবাজারিরা এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন অবৈধ রেশনকার্ড উদ্ধারে সফল হতে পারেনি।

ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যুগপৎ কর্মসূচি

যৌথ আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৭৩ সালের ২১ জুলাই ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা–কর্মীরা একসঙ্গে পূর্ব জার্মানির বার্লিনে যুব উৎসবে যোগ দিতে যান। সেখানে আসা ভিয়েতনামের ছেলে মেয়েরা ‘হো হো হোচিমিন: রেড রেড রেড স্যালুট’ (হো হো হোচিমিন: লাল লাল লাল সালাম) স্লোগান দিলে, সবার কাছে প্রশংসিত হয়। ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা দেশে ফিরে ওই শ্লোগানের আদলে ‘শেখ শেখ শেখ মুজিব: লও লও লও সালাম’ স্লোগান চালু করেন। (বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, বঙ্গবন্ধুর সময়কাল–ড. মোহাম্মদ হাননান, পৃষ্ঠা: ৩৬)

ডাকসু নির্বাচনের পটভূমি

ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) ও ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে যৌথ প্যানেল দিলে রাজনৈতিক মহল এটি ভালোভাবে নেয়নি। অন্যদিকে, তাত্ত্বিক সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’–এর প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল আলম খান দাদাভাইয়ের আশীর্বাদপুষ্ট জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল–জাসদ তখন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলে পরিণত হয়। দলটি দ্রুত বঙ্গবন্ধু সরকারের ‘পলিটিক্যাল এনিমি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। জাসদের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ (আসম আব্দুর রবপন্থী) জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ফলে প্রচুর মেধাবী ছেলে–মেয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে দিক্ষিত হওয়ার লক্ষ্যে জাসদ ছাত্রলীগে যোগ দিচ্ছিল।

১৯৭২ সালের ২০ মে ডাকসু নির্বাচনে জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মাহবুব জামান। (দৈনিক সংবাদ, ২২ মে ১৯৭২)। গত ২৯ আগস্ট টেলিফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে তখন দুর্ভিক্ষ, বন্যাসহ নানামুখী সংকট চলছিল। এটি মোকাবিলায় ছাত্র ইউনিয়ন যৌথভাবে ছাত্রলীগের সঙ্গে কাজ করে। ফলে, তাদের সঙ্গে আমাদের ভালো একটা বোঝাপড়া হয়। তাই ১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বরে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ যৌথ প্যানেল দিয়েছিল।’

ডাকসু নির্বাচন ১৯৭৩

ধারণা করা হয়–জাসদ ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা ঠেকাতে ছাত্রলীগ (মুজিববাদী) ও ছাত্র ইউনিয়ন ডাকসুতে যৌথ প্যানেল দেয়। ছাত্রলীগকে প্রায় অর্ধেক আসন ছাত্র ইউনিয়নকে ছেড়ে দিতে হয়। এতে ছাত্রলীগে সংকট বাড়ে এবং একটি অংশ ভোটের ক্যাম্পেইনে ‘নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

এদিকে, সরকারবিরোধী আন্দোলনের কারণে জাসদ ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। তবে, সরকারবিরোধী ভূমিকা থেকে বন্ধু প্রতীম সংগঠনে পরিণত হওয়ায়,ছাত্র ইউনিয়নের জনপ্রিয়তা কমে যায়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ প্যানেলে ভিপি পদে নূহ–উল–আলম লেনিন (ছাত্র ইউনিয়ন) ও জিএস পদে ইসমত কাদির গামা (মুজিববাদী ছাত্রলীগ) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অন্যদিকে, জাসদ ছাত্রলীগের প্যানেলের ভিপি ও জিএস পদে প্রার্থী হন যথাক্রমে আ ফ ম মাহবুবুল হক ও জহুরুল ইসলাম।

ডাকসু নির্বাচনের পরেরদিন পত্রিকায় সহিংসতার খবর

নির্বাচনের পরেরদিন ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩ দৈনিক ইত্তেফাক ‘বক্স আইটেম’ আকারে নিউজ করে। শিরোনাম ছিল–‘ডাকসু নির্বাচনে গোলাগুলি: ব্যালট বাক্স ছিনতাই।’

ইত্তেফাকের খবরে বলা হয়– ‘গতকাল ডাকসু ও হল ইউনিট সমূহের নির্বাচনে ভোটদান পর্ব নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হইলেও সন্ধ্যার পর ভোট গণনাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের ব্যবহারে শঙ্কিত হইয়া ওঠে। রোকেয়া হল ও সামসুন্নাহার হল ব্যতীত অন্যান্য হলের অধিকাংশ ব্যালট বাক্স অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করা হয়। তবে ডাকসু নির্বাচনের ব্যালট বাক্সগুলি ভোট গ্রহণের পর পরই কড়া প্রহরাধীনে কলাভবনে আনয়ন করার ফলে ব্যালট বাক্সগুলি অপহৃত হয় নাই। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, ডাকসুর ভোট গণনা স্থগিত রাখা হইয়াছে।’

তাদের খবরে জানা যায়, ‘গতকালের এই অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও রব সমর্থিত ছাত্রলীগ পরস্পর পরস্পরকে দায়ী করিয়াছে। রাত্রি সাড়ে বারোটায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় গোলাগুলি চলিতেছে এবং চরম উত্তেজনা বিরাজ করিতেছে। সাধারণ ছাত্র–ছাত্রীরা গোলাগুলি শুরু হওয়ার পরই হল ছাড়িতে শুরু করে।’

ইত্তেফাক জানায়, ‘শামসুন্নাহার হলের নির্বাচনে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ (ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন) ১২ টি আসনের মধ্যে সহ–সভানেত্রী ও সাধারণ সম্পাদিকা পদসহ ৮টি পদে জয়লাভ করিয়াছে। অপর আসনগুলি লাভ করিয়াছে রব সমর্থিত ছাত্রলীগ।’

এদিকে, দৈনিক পূর্বদেশ ডাকসুর গোলযোগপূর্ণ নির্বাচন নিয়ে ছবিসহ বিশাল নিউজ করে। তাদের শিরোনাম ছিল– ‘ডাকসুর শান্তিপূর্ণ নির্বাচন: সন্ধ্যায় গোলাগুলির মুখে ত্রাসের সঞ্চার।’

পূর্বদেশের খবরে বলা হয়–‘শান্তিপূর্ণভাবে ডাকসু নির্বাচনের ভোট গ্রহণ সমাপ্ত হবার পর সন্ধ্যার দিকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে প্রচণ্ড গুলিবর্ষণ শুরু হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের ভোট গণনা বন্ধ রাখা হয়। ভোট গণনা শুরু হবার কিছুক্ষণ পর সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিভিন্ন হলে গোলাগুলি শুরু হয়। কয়েকটি হলে এ সময় আলো নিভে যায়। এ সুযোগে কয়েকটি হল থেকে ব্যালট ছিনতাই হয়ে যায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

পূর্বদেশ নিউজের মধ্যে সাব হেড দিয়ে জানায়, ‘আলো নিভিয়ে ব্যালট ছিনতাই: উক্ত হলে যখন ভোট গণনা চলছিল তখন হঠাৎ করে সব আলো নিভে যায়। তারপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের মুখে ব্যালট কাগজ ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয়। এই ব্যালট ছিনতাই কারা করেছে নির্ভরযোগ্য সূত্রে তাদের কোন পরিচয় জানা যায়নি।’

শেখ ফজলুল হক মনি সম্পাদিত বাংলার বাণী ছবিসহ নির্বাচন ভন্ডুলের খবর প্রচার করে। তাদের হেডলাইন ছিল–‘ডাকসু নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছিল: রাতে সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছে।’

এদিকে, ৪ সেপ্টেম্বর জাসদের মুখপত্র গণকণ্ঠ পত্রিকাজুড়ে ভোট সন্ত্রাস নিয়ে অনেকগুলো নিউজ করে। ৪ সেপ্টেম্বর পত্রিকাটির শিরোনাম ছিল– ‘বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গেন বর্বরতার নজিরবিহীন ইতিহাস সৃষ্টি। অস্ত্রের ভাষায় ব্যালটের রায় বানচাল।’

কবি আল–মাহমুদ সম্পাদিত গণকণ্ঠ পত্রিকা বাংলাদেশ ছাত্রলীগের (রবপন্থী) দুইজন সদস্য আহত হওয়ার ছবি প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ‘গতকাল (সোমবার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদ সমূহের নির্বাচন ছিল। সকাল থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ছোটখোটো দু’একটা ঘটনা বাদে মোটামুটি শান্তিময় ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু বিকেল ৩টা তথাকথিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের গুন্ডারা প্রথমবারের মতো হামলা চালায় ছাত্রলীগের দুর্গ বলে পরিচিত শহীদুল্লা হলে। শহীদুল্লা হলের হামলায় আহত হন ২ জন লীগ কর্মী। তাদের একজন হচ্ছেন এ হলের ছাত্র জনাব মকসুদ। তার কাছ থেকে সরকারের সর্বময় ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তিটির সুযোগ্য পুত্র ঢাকা–এ ৬৩৮৭ নম্বরের একটি কাওয়াসাকি ৯০ সিসি হোন্ডা ছিনিয়ে নেয়। অন্য একজন আহত ব্যক্তি হচ্ছেন জনাব তবারক হোসেন। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, উক্ত ঘটনার পরপরই শহীদুল্লা হলের ছাত্ররা হল ত্যাগ করতে থাকেন এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে এলাকাটি একটি জনমানবহীন প্রেতপুরীতে পরিণত হয়।’

গণকণ্ঠ জানায়, ‘সন্ধ্যা সাতটায় গুন্ডারা প্রথমবারের মতো সলিমুল্লাহ হরের ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে। তারা প্রথমত বাতি নিভিয়ে ফেলে ও কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ অনুসারে– গুলি ছুড়তে ছুড়তে গান পয়েন্টে ব্যালটবাক্স ছিনতাই করে। একই কায়দায় মুজিববাদী দস্যুরা সূর্যসেন হল, মহসিন হল, শহীদুল্লা হল, ফজলুল হক হল, জহুরুল হক হল ও রোকেয়া হলের ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে। গুন্ডারা সামসুন্নাহার হলেও ঢুকে। কিন্তু ততক্ষণে ভোটগণনা শেষ। দোষ স্খলন ও জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার জন্য তাদের বিজয়ের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জগন্নাথ হলের ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে।’

গবেষকের চোখে ডাকসু নির্বাচন:

লেখক ও গবেষক ড. মোহাম্মদ হাননান ‘বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বঙ্গবন্ধুর সময়কাল’ বইয়ে (পৃষ্ঠা –৩৬–৩৭) লিখেছেন,‘ নির্বাচনের দিন শেষবেলায় ছাত্রলীগ আগাম অনুমান করে ডাকসুতে জাসদ ছাত্রলীগ জয়লাভ করতে যাচ্ছে, এই আশঙ্কায় কতিপয় অস্ত্রধারী শহীদুল্লাহ হল ও অন্য কয়েকটি হল থেকে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করে নিয়ে যায়। গণতান্ত্রিকভাবে জাসদ ছাত্রলীগের কাছে মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথভাবে পরাজয় ঘটলে রাজনৈতিকভাবে যে বিপর্যয় ঘটত, তারচেয়ে অধিক বিপর্যয় ঘটে নির্বাচনের ফলাফল ছিনতাইয়ের ঘটনায়। সমগ্র দেশ এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে এবং ছাত্র আন্দোলন এক অজানা সংকটে নিপতিত হয়। ছাত্ররাজনীতির গবেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে ডাকসু নির্বাচনের এই কলঙ্ক কখনোই মুছে ফেলা যাবে না।’

সাবেক ছাত্রনেতারা কী বলছেন ?

ডাকসু নির্বাচনের সময় জাসদ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না। ৩ সেপ্টেম্বর ভোটের দিন সকাল ১০ টার পরে কিছু বহিরাগত শহীদুল্লাহ হলে ভোটের বাক্সে সিল মারছে–এমন খবর পেয়ে ছুটে যান। তারা মান্নাকে হলের কমনরুমে কিছুক্ষণ আটকে রাখে। সবার হাতে স্টেনগান ও রিভলভার ছিল। তাকে আটক রাখার খবরে জাসদ ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা শহীদুল্লাহ হলে ছুটে গেলে, অস্ত্রধারীরা পালিয়ে যায়।

মাহমুদুর রহমান মান্না গত ৩১ আগস্ট প্রথম আলোকে বলেন, ‘৭৩ এর ডাকসু নির্বাচন ‘হাইজ্যাক’ হয়েছিল। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের পরাজয় হবে এমন আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। তাই মুজিববাদী ছাত্রলীগের গুন্ডারা দিনের বেলায় হলে গিয়ে জাল ভোট যেমন দিয়েছিল, তেমনি সন্ধ্যায় ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছিল।’

মান্না বলেন, ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী। আর নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক ওদুদুর রহমান। তারা দুজনেই ডাকসু নির্বাচনে সন্ত্রাস ঠেকাতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন ।

নির্বাচনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ভিপি প্রার্থী ছিলেন নূহ–উল–আলম লেনিন (ছাত্র ইউনিয়ন)। গত ২৯ আগস্ট প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সামসুন্নাহার হলে ছাত্র ইউনিয়ন বিজয়ী হয়েছিল। সন্ধ্যায় সূর্যসেন হলে ব্যালট বাক্স হাইজ্যাকের খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলাম কিন্তু সন্ত্রাসীরা অস্ত্রসহ থাকায় তাদের ঠেকাতে পারিনি।’

নূহ–উল–আলম লেনিন বলেন, ‘হলগুলোতে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনায় কারো না কারো তো ইন্ধন ছিল। তা না হলে একটা সুন্দর নির্বাচন ভন্ডুল হয় কীভাবে? আমার ধারণা ছাত্রলীগের কিছু কর্মী হয়ত এটা করে থাকতে পারেন।’

ডাকসুর ভিপি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের ভুল স্বীকার

১৯৭২ সালের ২০ মে অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ভিপি হয়েছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। গত ২৯ আগস্ট প্রথম আলোকে তিনি বলেন,‘১৯৭৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আমি একটা অপরাধ করেছিলাম। সিপিবি নেতাদের পরামর্শে গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে বলেছিলাম–হলে অস্ত্র নিয়ে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনায় জাসদ ছাত্রলীগ জড়িত। সেদিন আমি মিথ্যা বলেছিলাম। মূলত জাসদ ছাত্রলীগ ব্যালট বাক্স হাইজ্যাকের সঙ্গে জড়িত ছিল না। সেটা আমার রাজনৈতিক জীবনের একটা বড় ভুল ছিল। আমি অনেক বছর পর বিবৃতি দিয়ে ওই ঘটনার জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছি।’

প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে ডাকসু নির্বাচন

৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন গণকণ্ঠ পত্রিকার সাংবাদিক মহিউদ্দিন আহমদ। থাকতেন মহসিন হলে। ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় হলের অডিটরিয়ামে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ভোট গণনা দেখেছেন।

গত ৩১ আগস্ট প্রথম আলোর কাছে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ওই দিন সন্ধ্যায় ভোট গোনার সময় মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা–কর্মীরা বহিরাগত সন্ত্রাসী নিয়ে গুলি করতে করতে মহসিন হলে ঢুকে ব্যালট বাক্স লুট করে। অন্যান্য হলেও একই কায়দায় তারা ভোট ডাকাতি করে, যাতে জাসদ ছাত্রলীগ জিততে না পারে।

মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘দিনে ভোট শান্তিপূর্ণ হয়েছিল। কিন্তু বিকেলে ভোট গোনার সময় যখন দেখা গেলো জাসদ ছাত্রলীগের মাহবুব–জহুর প্যানেল বিজয়ী হতে যাচ্ছে, তখন মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সন্ত্রাসীরা কলাভবনে ঢুকে ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নেয়।’

পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিতর্কিত ওই নির্বাচনকে বাতিল ঘোষণা করে। ফলে ১৯৭২ সালের ডাকসু নির্বাচনের বিজয়ী প্যানেল (সেলিম–মাহবুব নেতৃত্বাধীন) পরবর্তী নির্বাচন না হওয়া (১৯৭৬ সালের মাঝামাঝি) পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।

শিক্ষক ও গবেষক মোরশেদ শফিউল হাসান ১৯৭৩ সালে মহসিন হলের ছাত্র ছিলেন। তিনি সংবাদের বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার ছিলেন। ৩ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনের খবর সংগ্রহ করতে সন্ধ্যায় সংবাদের সহ–সম্পাদক জিএম ইয়াকুবকে সঙ্গে নিয়ে জহুরুল হক হলে যান। সেখান থেকে যান এস এম হলে। এসএম হলের লনে পৌঁছতেই কয়েক রাউন্ড গুলির শব্দ শুনতে পান। হঠাৎই বাতি নিভে সমস্ত এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়। দু-তিনজন যুবক ছুটে এসে তাদের ধমকের সুরে জানতে চান তারা কারা, ওখানে কী করছেন? সাংবাদিক পরিচয় দিতে সেই যুবকেরা মোরশেদ শফিউল হাসান ও জিএম ইয়াকুবকে সেখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন।

পরে মোরশেদ শফিউল হাসান ও জিএম ইয়াকুব যান জগন্নাথ হলে। সেখানে প্রোভোস্ট রুমে ভোটের ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখন হৈচৈয়ের মধ্যে শুনতে পান কারা যেন ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। পরে সেখানে তারা রিকশা নিয়ে বংশালে সংবাদের অফিসে যান।

মোরশেদ শফিউল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অফিসে যাওয়ার পর সিনিয়র সাংবাদিকরা আমাদের ছেঁকে ধরেন। এম আর বাদল, হাসান আলী, তোজাম্মল আলী এবং বেবি মওদুদসহ অনেকে উত্তেজিত হয়ে জানতে চান– বিশ্ববিদ্যালয়ে কী ঘটেছে? আমরা বলেছি– ব্যালট বাক্স ছিনতাই হয়েছে। কারা ছিনতাই করেছে– এমন প্রশ্নের জবাবে জাসদ ছাত্রলীগের ছেলেদের কথা বলি। এ সময় সেখানে হাজির হন সংবাদের বার্তা সম্পাদক সন্তোষ গুপ্ত। তিনি আমাকে সেখান থেকে আলাদা করে ভেতরে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন, সত্যি করে বলেন তো, কারা ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছে? জবাবে আমি জাসদ ছাত্রলীগের নাম বলায় তিনি বলেন, ‘অসম্ভব, সরকারি দলের সমর্থন ছাড়া এ কাজ অন্য কেউ করতেই পারে না।’

ওই দিন আমাকে কোনো নিউজ করতে বলা হয় নাই। পরের দিন সংবাদে ডাকসু নির্বাচনে জাসদ ছাত্রলীগকে ‘দায়ী’ করে লিড নিউজ ছাপা হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘জাসদ ছাত্রলীগের পক্ষে ক্যাম্পাসে একটা ‘গণজোয়ার’ তৈরি হয়েছিল। ব্যালট বাক্স ছিনতাই না হলে, মাহবুব–জহুর প্যানেল নিশ্চিতভাবে বিজয়ী হতো বলে আমার ধারণা।’