চার দেওয়ালের মাঝে বন্দি-ছন্দহীন জীবন। যেখানে নেই কোনো আপনজন, নেই স্বপ্ন। মনের গহিনে জমে থাকা অব্যক্ত বেদনা যেন সুর হয়ে ভেসে আসে তাদের কণ্ঠে। কিন্তু সেই সুরের মর্ম কেউ বোঝে না। তাদের এই দুঃখগাথাকে সমাজ বিনোদন হিসাবেই গ্রহণ করে। দেশের একমাত্র বিশেষায়িত পাবনা মানসিক হাসপাতালে এভাবেই বছরের পর বছর কেটে যাচ্ছে মানসিক রোগীদের। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এই হাসপাতালের করুণ উপাখ্যান। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা নিয়েও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না রোগীরা। এর কারণ পরিবার, আত্মীয়স্বজন ও সমাজের অবহেলা-অসহযোগিতা।
এদিকে নানা সংকটে জর্জরিত হাসপাতালটি। রোগীদের আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। জরাজীর্ণ ভবন, অনেক যন্ত্রপাতি নষ্ট। রয়েছে জনবল সংকট এবং যানবাহন ও যাতায়াতের সমস্যা।
হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মাসুদ রানা যুগান্তরকে বলেন, মানসিক রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সাপোর্ট পান না; বরং তাদের অবহেলা করা হয়। এতে তারা আবারও ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তিনি বলেন, মানসিক রোগীদের পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সবদিকে পুনর্বাসন করতে হবে।
রোগীরা পুরোপুরি সুস্থ হতে পারছেন না : রোগীরা কিছুটা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফেরার পর আবার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছেন। ফলে তাকে আবারও আনতে হচ্ছে হাসপাতালে। এদের মধ্যে কেউ পুনরায় ভর্তি হচ্ছেন আর কেউ বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে ফিরছেন। প্রতিদিন বহির্বিভাগে ১৫০ থেকে ২০০ রোগী আসেন এবং তাদের অধিকাংশই পুরোনো রোগী। অনেক রোগী আছেন, যারা ৫ থেকে ৫০ বছর পর্যন্ত মানসিক রোগ বয়ে বেড়াচ্ছেন।
হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী নিয়ে আসা কয়েকজন স্বজন জানান, হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের ওষুধ খাওয়ালে কিছুদিন ভালো থাকেন। পরে আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এদিকে ভুল ঠিকানায় রোগীদের ভর্তি করার অভিযোগও রয়েছে। ভর্তির পর ওই রোগীর সঙ্গে স্বজনরা আর যোগাযোগ করেন না বা দেখতে আসেন না। এ কারণে কমপক্ষে ২৩ জন রোগী সুস্থ হয়েও বাড়িতে ফিরতে পারেননি। হাসপাতালের কর্মীরা রোগীকে নিয়ে ভুল ঠিকানায় গিয়ে ফিরে আসেন। তারা স্বজনদের শোকে এবং নিজের ছন্দহারা জীবনে হতাশাগ্রস্ত হয়ে আবারও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
পুরোনো যন্ত্রপাতি ও যানবাহন সমস্যা : হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে এখানে কিছু চিকিৎসা যন্ত্রপাতি দিয়েছিল সরকার। এর মধ্যে একটি টিইইজি, একটি ইসিটি, একটি অটোকেভ ও একটি ইসিজি মেশিন চালু করা সম্ভব হয়নি। একটি মাত্র অ্যাম্বুলেন্স কোনোমতে চালু রাখা হয়েছে। মাঝে মধ্যেই এটি নষ্ট থাকে। চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিবহণের জন্য কোনো যানবাহন নেই। হাসপাতালের পরিচালকের জন্য পুরোনো একটি জিপ থাকলেও প্রায়ই নষ্ট হয়ে পড়ে থাকে। হাসপাতালসংলগ্ন সংযোগ সড়কটি জরাজীর্ণ। প্রায় ৬০ বছর আগে নির্মিত ভবনগুলোর ইলেকট্রিক ও পানি লাইনগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। রোগীদের আধুনিক ও উন্নত চিকিৎসার জন্য কর্মরত চিকিৎসকদের উচ্চতর প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হলেও তার কোনো ব্যবস্থা নেই। কর্মরত চিকিৎসক/কর্মকর্তা/তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের বসবাসযোগ্য কোনো কোয়ার্টার নেই। যেসব আবাসিক কোয়ার্টার ও ডরমেটরি নির্মিত হয়েছিল তা রক্ষণাবেক্ষণ এবং সংস্কারের অভাবে সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে।
জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে রোগীদের বসবাস : ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালের ১৪টি ওয়ার্ডে রোগীদের রাখা হয়। এর মধ্যে ৭টি ওয়ার্ডের অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। সরেজমিন দেখা যায়, এগুলোর মেরামত কাজ বন্ধ। এসব ওয়ার্ডের ছাদের পলেস্তারা খুলে খুলে পড়ছে। অনেক স্থানে ছাদের রড বের হয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে কোথাও কোথাও পানি পড়ে। দ্রুত মেরামত করা না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কার কথা জানান কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
শয্যা ও জনবল : ৫০০ শয্যার এ হাসপাতালে মাত্র ২০০ শয্যার জনবল অনুমোদন রয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। এর মধ্যে প্রথম শ্রেণির চিকিৎসক মাত্র ৩১ জন, ৯টি পদ শূন্য। প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা পদায়ন রয়েছে ৭ জন, শূন্য ৪টি। দ্বিতীয় শ্রেণির ৩১৬ জনের মধ্যে শূন্য ৭টি। তৃতীয় শ্রেণির ১১৯ জনের মধ্যে ২৩টি ও ৪র্থ শ্রেণির ১৭০ জনের মধ্যে ১০৯টি পদ শূন্য রয়েছে।
কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশেষায়িত এই হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট পদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং এর জন্য মাত্র ২টি পদ মঞ্জুরি থাকলেও ১৯৭৩ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত ওই দুটি পদ শূন্য রয়েছে। ৫ম গ্রেডের এই পদের মনোরোগ চিকিৎসকরাও নিজের ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে এখানে আসতে চান না। তৃতীয় গ্রেডের পরিচালক পদেও কেউ আসতে চান না।
এদিকে গত আড়াই বছরে হাসপাতালে কমপক্ষে ২৫ জন রোগী মারা গেছেন। এদের মধ্যে ২০২৩ সালে ১০ জন, ২০২৪ সালে ১০ এবং ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত মারা গেছেন ১০ জন।
বিনোদন ও দালাল সমাচার : হাসপাতালে আগে একটি সিনেমা হল ছিল। সেখানে রোাগীদের নিয়মিত সিনেমা দেখানো হতো। গানবাজনাসহ নানা বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। এখন শুধু টেবিল টেনিস খেলার ব্যবস্থা রয়েছে। হাসপাতালে আছে দালালচক্রের দৌরাত্ম্য। আশপাশে নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে গড়ে তোলা হয়েছে অবৈধ মানসিক হাসপাতাল ও ক্লিনিক। দালালরা এসব ক্লিনিকে রোগীদের ভাগিয়ে নিয়ে ভর্তি করে।
পাবনা মানসিক হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাফকাত ওয়াহিদ বলেন, রোগীদের মানসিক রোগ ছাড়াও হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত অবস্থায় ভর্তি করা হয়। কিন্তু এখানে চিকিৎসা হয় শুধু মানসিক রোগের। কাজেই রোগীরা আনেক সময় ওইসব রোগে মারা যান। তিনি বলেন, একটি বড় প্রকল্পের ডিপিপি একনেকে তোলার অপেক্ষায় রয়েছে। এটি হলে হাসপাতালের শয্যা বৃদ্ধিসহ এর সেবা আন্তর্জাতিক মানের হবে।