ফজরের নামাজ কাজা না করার সহজ উপায়
আমাদের মধ্যে কে আছে যে গত এক মাস বা এক বছরে একবারও ফজরের নামাজ কাজা করেনি? পরীক্ষার ক্লান্তি, অফিসের কাজে দেরি করে ঘরে ফেরা বা গভীর ঘুমের কারণে সময়মতো না ওঠা—এমন কোনো না কোনো অজুহাত আমাদের থাকেই। কিন্তু এ সামান্য ঘুমের কাছে হেরে গিয়ে আমরা দিনের সবচেয়ে বরকতময় সময়টি হারিয়ে ফেলি। ফজরের নামাজ সবচেয়ে বেশি কাজা হলেও এর মাহাত্ম্য অতুলনীয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘শপথ ফজরের।’ (সুরা ফজর, আয়াত: ১)
অন্যত্র বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই ফজরের নামাজের কোরআন পাঠ (ফেরেশতাগণের) সরাসরি সাক্ষ্য হয়।’ (সুরা ইসরা, আয়াত: ৭৮)
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করল, সে মহান আল্লাহর জিম্মায় চলে গেল।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬৫৭)
ফজর শুধু দিনের শুরু নয়; বরং মহান আল্লাহর নিরাপত্তার চুক্তিতে প্রবেশের বিশেষ সুযোগ। তাই আসুন, ফজর কাজা না করার কিছু সহজ ও কার্যকর কৌশল জেনে নিই।
সামান্য ঘুমের কাছে হেরে গিয়ে আমরা দিনের সবচেয়ে বরকতময় সময়টি হারিয়ে ফেলি। ফজরের নামাজ সবচেয়ে বেশি কাজা হলেও এর মাহাত্ম্য অতুলনীয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞান অনুসারে, একটি পূর্ণ স্লিপ সাইকেল বা নিদ্রাচক্রের গড় সময় ৯০ থেকে ১২০ মিনিট। সুস্থ থাকতে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় চার–ছয়টি স্লিপ সাইকেল সম্পন্ন করা প্রয়োজন, অর্থাৎ কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা ঘুম। (হুবারম্যান, অ্যান্ড্রু, স্লিপ অ্যান্ড সার্কাডিয়ান রিদমস , স্ট্যানফোর্ড মেডিসিন, ২০২০)
যদি রাত ১০টার মধ্যে ঘুমাতে যান, তবে ভোর চার-পাঁচটায় জেগে ফজর আদায় করা সহজ হবে। মহানবী (সা.) ইশার নামাজের পর দ্রুত ঘুমাতে যেতেন এবং ফজরের জন্য সময়মতো জাগতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১১৬৫)
অ্যালার্ম সেট করা ফজরের জন্য সময়মতো ওঠার সহজ উপায়, কিন্তু অনেকে অ্যালার্ম বন্ধ করে আবার ঘুমিয়ে পড়েন। এ সমস্যার সমাধানে মনোবিজ্ঞানী মেল রবিন্স প্রস্তাব করেছেন ‘ফাইভ সেকেন্ডস রুল’। ( দ্য ফাইভ সেকেন্ডস রুল , নিউইয়র্ক: স্যাভরি বুকস, ২০১৭, পৃ. ১৫)। কৌশলটি হলো—
অ্যালার্ম বাজতেই ৫–৪–৩–২–১ গুনতে শুরু করুন।
গুনতে গুনতে বিছানা ছাড়ুন।
দাঁড়িয়ে গেলে অলসতা কেটে যাবে।
এটি একটি ‘অ্যাকটিভেশন টেকনিক’, যা সিদ্ধান্তহীনতা থেকে তাৎক্ষণিক কাজে নিয়ে যায়।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘মহান আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি দয়া করেন, যে রাতে উঠে নামাজ পড়ে এবং স্ত্রীকে জাগায়। যদি স্ত্রী না ওঠে তবে মুখে পানি ছিটিয়ে দেয়।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ১,৩০৮)
যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করল, সে মহান আল্লাহর জিম্মায় চলে গেল।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬৫৭
পরিবার বা বন্ধু একে অপরকে ফজরের জন্য জাগানো শুধু কৌশল নয়, একটি সুন্নাহ। এটি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমও হতে পারে।
নিয়মিত ঘুমের সময়: রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান (ক্বাদি, ইয়াসির, দোয়া ফর দ্য ডে অ্যান্ড নাইট, লেস্টার: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০১০, পৃ. ৬৭)।
অ্যালার্ম ও ফাইভ সেকেন্ডস রুল: অ্যালার্ম বাজার সঙ্গে সঙ্গে পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে উঠে পড়ুন।
পরিবার বা বন্ধুর সহায়তা: পরিবারের কাউকে বা বন্ধুকে জাগানোর দায়িত্ব দিন।
হালকা খাবার: রাতে ভারী খাবার এড়িয়ে হালকা খান।
ঘুমের পরিবেশ: ঘরের আলো, তাপমাত্রা ও বিছানা আরামদায়ক রাখুন।
আন্তরিক নিয়ত: ফজরের জন্য মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন।
পাক-পবিত্রতা: রাতে গোসল ফরজ হলে তৎক্ষণাৎ গোসল করে নিন, যাতে অলসতায় ফজর কাজা না হয়।
নিজেকে পুরস্কৃত করা: নামাজ আদায়ের পর ছোট্ট পুরস্কার (যেমন পছন্দের খাবার) নির্ধারণ করুন।
ভোরের নিস্তব্ধ সময়ে, যখন দুনিয়া ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন মহান আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর প্রশান্তি অতুলনীয়।
ভোরের নিস্তব্ধ সময়ে, যখন দুনিয়া ঘুমে আচ্ছন্ন, তখন মহান আল্লাহর সামনে দাঁড়ানোর প্রশান্তি অতুলনীয়। ফজর শুধু শৃঙ্খলার পাঠ নয়; বরং মহান আল্লাহর নিয়ামতের একটি বিশেষ অংশ। মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘যারা অন্ধকারে মসজিদে যায়, তাদের কিয়ামতের দিন পূর্ণ আলো দেওয়া হবে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ৬৫৭)
দুনিয়ায় অন্ধকারে টর্চলাইট খুঁজি, আর আখিরাতে পূর্ণ আলোর প্রতিশ্রুতি! এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি কী হতে পারে? ফজর শুধু দিনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে না, আখিরাতকে আলোয় ভরিয়ে দেয়। ফজর কাজা হলে আমরা একটি নামাজ নয়, একটি বিশাল নিয়ামত হারাই।
ফজরের নামাজ কাজা না করতে আমাদের আধুনিক কৌশল, যেমন ফাইভ সেকেন্ডস রুল, সুন্নাহ অনুযায়ী সময়মতো ঘুম, পরিবারের সহযোগিতা ও আন্তরিক নিয়ত গ্রহণ করতে হবে। নিয়মিত ফজর আমাদের জীবনকে শৃঙ্খলাপূর্ণ, আত্মাকে প্রশান্ত ও আখিরাতে মহান আল্লাহর নুরের প্রতিশ্রুতি বয়ে আনবে। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে সময়মতো ফজর আদায়ের তাওফিক দান করুন। আমিন।