ছবি : সংগৃহীত

চীনের হুই মুসলিমদের সম্পর্কে কতটুকু জানেন?

চীনের মুসলিমদের কথা উঠলেই সাধারণত শিনজিয়াংয়ের উইঘুরদের প্রসঙ্গ আসে। কিন্তু চীনে সবচেয়ে বড় মুসলিম জাতিগোষ্ঠী আসলে হুই মুসলিমরা। তারা তুলনামূলকভাবে বেশি ধর্মীয় স্বাধীনতা ভোগ করেন। উইঘুরদের তুলনায় হুই মুসলিমরা বেশ খোলামেলাভাবে ইবাদত করতে পারেন এবং অনেক এলাকায় তাদের ধর্মীয় চর্চাও বাড়ছে। এ সফলতার পেছনে রয়েছে শতাব্দীব্যাপী আত্মীকরণ—সংখ্যাগরিষ্ঠ হানদের সঙ্গে মিশে থেকেও নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরি ও প্রতিষ্ঠাকরণ ।

তাদের ইতিহাস, জীবনধারা ও অবদান নিয়ে কয়েকটি তথ্য—

১. চীনের সবচেয়ে বড় মুসলিম গোষ্ঠী

চীনে প্রায় ১০টি মুসলিম জাতিগোষ্ঠী রয়েছে। এর মধ্যে হুই মুসলিমরা সবচেয়ে বড়। বর্তমানে দেশটিতে প্রায় ১ কোটি ৫ লাখের মতো হুই মুসলিম বাস করে।

২. তাদের মাতৃভাষা ম্যান্ডারিন

চীনের হুই মুসলিমদের শিকড় তুর্কি বা মঙ্গোলীয় নয়, বরং তারা চীনা মুসলিম। শতাব্দী ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হান চীনা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে তারা এখন পুরোপুরি চীনা মুসলিম পরিচয়ে পরিচিত।

৩. সপ্তম শতকে চীনে আগমন

হুই মুসলিমদের পূর্বপুরুষরা মূলত মধ্য এশিয়া ও পারস্যের বণিক, সৈনিক, কারুশিল্পী ও আলেম ছিলেন। মিং সাম্রাজ্যের আমলে তাদের স্বীকৃত মুসলিম জাতিগোষ্ঠী হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

তাদের পূর্বপুরুষরা সিল্ক রোড ধরে ১২০০ বছরের বেশি আগে চীনে আসেন। হানদের সঙ্গে বিয়েশাদি করে তারা চীনের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন। ম্যান্ডারিনকে মাতৃভাষা বানিয়ে নেন, স্থানীয় রীতি অনুসারে নিজেদের ধর্মীয় প্রথাও সাজিয়ে নেন। শিয়ানের বিখ্যাত মসজিদে চীনা স্থাপত্যের ছোঁয়া তার স্পষ্ট ও অন্যতম নিদর্শন।

৪. চীনের পশ্চিমাঞ্চলে বেশি বসবাস

অধিকাংশ হুই মুসলিম চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশ ও স্বশাসিত অঞ্চলে থাকেন—যেমন শিনজিয়াং, নিংশিয়া, গানসু, চিংহাই, হেনান, হেবেই, শানডং ও ইউনান। তবে জীবিকা ও কর্মক্ষেত্রের সুবাদে অনেকে বেইজিংয়ের মতো বড় শহরেও আছেন।

৫. ইসলামি শিক্ষা ও বিজ্ঞানে বড় অবদান

হুই মুসলিমরা শুধু সংখ্যা নয়, অবদানেও এগিয়ে। কোরআনের চীনা অনুবাদক মুহাম্মদ মা জিয়ান, কুইং আমলের আলেম লিউ ঝি, বিখ্যাত মার্শাল আর্টিস্ট ওয়াং জি-পিং এবং সুফি নেতা মা ইউয়ানঝ্যাং—সবাই হুই মুসলিমদের গর্ব।

৬. চীনের অর্থনীতিতে প্রভাব

হুই মুসলিমরা বড় শহর যেমন বেইজিং বা সাংহাইয়ে হানদের মতোই জীবনযাপন করছেন। তবে উত্তর ও পশ্চিমের নিংশিয়া, গানসু, চিংহাই ইত্যাদি প্রদেশে এখনো ঘনবসতিপূর্ণ হুই সম্প্রদায় আছে। ঐতিহ্যগতভাবে তারা ব্যবসায়ী ও বণিক—এখনও তারা অর্থনৈতিকভাবে সফল।

ক্যালিফোর্নিয়ার পোমোনা কলেজের অধ্যাপক ও হুই বিশেষজ্ঞ ড্রু গ্ল্যাডনি বলেন, ‘১৯৫০ সালের তুলনায় এখন চীনে দ্বিগুণ মসজিদ রয়েছে, যার বেশিরভাগই হুই মুসলিমদের।’ তার মতে, হিজাব পরা হুই নারীর সংখ্যা এবং হজে যাওয়া হুইদের সংখ্যাও বেড়েছে।

এই পরিবর্তনের কারণ হলো অন্যান্য মুসলিমদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়া, বিদেশফেরত আলেমদের প্রভাব এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্য। উদাহরণ হিসেবে নিংশিয়ার রাজধানী ইয়িনচুয়ানে গড়ে তোলা হচ্ছে ৩৭০ কোটি ডলারের ‘ওয়ার্ল্ড মুসলিম সিটি’ থিম পার্ক, রাস্তার সাইনবোর্ডেও যোগ হয়েছে আরবি অক্ষর।

৭. রাজনীতি ও স্বাধীন রাষ্ট্রের দাবি নেই হুইদের

হুই মুসলিমরা আলাদা মাতৃভূমি দাবি করে না, তাদের প্রথম ভাষাও ম্যান্ডারিন। তাই স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা নেই, যা হানদের সঙ্গে তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে সাহায্য করেছে।

অন্যদিকে শিনজিয়াংয়ের উইঘুর মুসলিমরা স্বাধীনতা চাওয়ায় দমন-পীড়নের মুখে পড়ছে—রোজা রাখা থেকে শুরু করে নামাজ ও ভ্রমণেও তাদের বাধা দেওয়া হচ্ছে, পাসপোর্ট জমা দিতে হচ্ছে।

৮. হুইদের ওপর দমন-পীড়ন

তবে সব সময়ই হুই-হান সম্পর্ক মসৃণ ছিল না। ১৮৬০-৭০-এর দশকে ‘দুংগান বিদ্রোহে’ হুইরা হানদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় অন্যান্য ধর্মীয় ও নৃগোষ্ঠীর মতো তারাও দমন-পীড়নের শিকার হন। ১৯৭৫ সালে শাদিয়ান শহরে হুইদের এক আন্দোলন রক্তক্ষয়ীভাবে দমন করে পিপলস লিবারেশন আর্মি।

হুই মুসলিমদের ওপর কড়াকড়ি ও নিয়ন্ত্রণের শঙ্কা

ফ্রস্টবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের হুই আলেম হাইয়ুন মা ডয়চে ভেলেকে বলেন, চীনা সরকার হুইদের প্রতি সৌহার্দ্য সম্পর্ক বজায় রেখেছে ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে, ধর্মীয় সহনশীলতার কারণে নয়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিংশিয়ার মতো প্রদেশে হুইদের পাসপোর্ট পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে, ধর্মীয় শিক্ষায়ও কড়াকড়ি এসেছে। তার মতে, সরকারের বাড়তি জাতীয়তাবাদ ও নিয়ন্ত্রণ হুইদের জন্যও হুমকি হয়ে উঠতে পারে।

সূত্র : মুসলিম ভাইব, ডয়চেভেলে

এনটি