আল্লাহর কুদরত নিয়ে চিন্তা-গবেষণার গুরুত্ব

আল্লাহর কুদরত নিয়ে চিন্তা-গবেষণার গুরুত্ব

আমাদের চারপাশের সৃষ্টিজগৎ মহান আল্লাহর কুদরতের প্রমাণ। আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা বা সাধনা করলে ইমান মজবুত হয়, তার সন্তুষ্টিও অর্জন করা যায়। আল্লাহকে স্মরণ করতে সৃষ্টির ভাবনায় অনেক অজানা বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা যায় এবং অঢেল পুণ্যও অর্জন হয়। আল্লাহর এই বিশাল সৃষ্টি-ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে অসংখ্য সৃষ্টি থেকে আমরা হরেকরকম উপকার পাই। খাদ্য সংগ্রহ করে যেমন আমরা জীবন বাঁচাই, তেমনি এর মাঝে বিদ্যমান হাজারো নিদর্শন থেকে আমরা শিক্ষালাভ করতে পারি, যা আমাদের জান্নাতের পথে পাথেয় হিসেবে থাকবে। আল্লাহর অলি-আউলিয়ারা আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে ধ্যানমগ্ন হতেন। এমনকি আমাদের প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান করতেন। আর আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করতে আল্লাহ নিজেই বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আসমান ও জমিন সৃষ্টিতে এবং রাত ও দিনের আবর্তনে নিদর্শন রয়েছে বোধসম্পন্ন লোকদের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং চিন্তা-গবেষণা করে আসমান ও জমিন সৃষ্টির বিষয়ে, তারা বলে—পরওয়ারদিগার! এসব আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি। সব পবিত্রতা আপনারই, আমাদের আপনি দোজখের শাস্তি থেকে বাঁচান।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৯০-১৯১)।

রাত পেরিয়ে যখন দিন আসে তখন সূর্যের আলোয় সৃষ্টিরাজি অবলোকন করা যায়। বাড়ির পাশে, বনে, অরণ্যে আচ্ছাদিত আছে অগণিত সৃষ্টি, যা নিয়ে ভাবলে, চিন্তা করলে নিশ্চয়ই আল্লাহর কথা স্মরণ হবে। ইমান বৃদ্ধি পাবে। দিনের শেষে নিকষ কালো অন্ধকার কিংবা চাঁদ আর আকাশভরা তারা নিয়ে হাজির হয় রাত। দিনের ব্যস্ততা থেমে গেলে রাতে অসীম আকাশের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায়। মৃদু আলো বিলানো তারকারাজি, চাঁদের দিকে নজর দিয়ে এ সৃষ্টির স্রষ্টাকে অন্বেষণ করলে হৃদয়ে উদ্ভাসিত হবে পরওয়ারদিগারের ভাবনা। অন্তরে জাগ্রত হবে খোদার ভয়। যে ভয় এবং প্রেম আমাদের মুত্তাকিদের কাতারেই শামিল করবে। আল্লাহতায়ালা অন্যত্র বলেন, ‘নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে মুমিনদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।’ (সুরা জাসিয়া)

দুই চোখের দৃষ্টি যেখানে পড়ে সেখানেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আল্লাহর কোনো না কোনো সৃষ্টি। যেখানে আমাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। কল্পনার রাজ্যে মন্দকে স্থান না দিয়ে এ সৃষ্টি নিয়ে অল্প কল্পনা করলে অধিক পুণ্য মিলবে এবং মহান রবের নির্দেশনা মানতেও অন্তরে তীব্র আকাঙ্ক্ষার জোয়ার বইবে। অবসরে আমরা দুনিয়ার আড্ডায় নিমজ্জিত না হয়ে চারপাশের সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করলে অন্তরে তৃপ্তি আসবে এবং অসংখ্য সওয়াবও পাওয়া যাবে। চোখ-কান থাকা সত্ত্বেও যদি আল্লাহ পাকের সৃষ্টির অপার মহিমা, রহস্য দেখেও এড়িয়ে যাওয়া হয়, শুনেও না শোনার ভান করা হয়, তবে কোরআনে বর্ণিত চতুষ্পদ জন্তু ও মানুষের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘আমি সৃষ্টি করেছি দোজখের জন্য বহু জিন ও মানুষ। তাদের অন্তর রয়েছে, তার দ্বারা বিবেচনা করে না, তাদের চোখ রয়েছে, তার দ্বারা দেখে না, আর তাদের কান রয়েছে, তার দ্বারা শোনে না। তারা চতুষ্পদ জন্তুর মতো, বরং তাদের চেয়েও নিকৃষ্টতর। তারাই হলো গাফেল, শৈথিল্যপরায়ণ।’ (সুরা আরাফ: ১৭৯)।

আমাদের ইন্দ্রিয়শক্তি, মেধা-মননশীলতা সবকিছু দিয়েই আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। অন্তরে রবের স্মরণ ও দ্বীনি চিন্তার চর্চা না থাকলে সেই মস্তিষ্ক হবে শয়তানের আখড়া। বৃদ্ধি পাবে আল্লাহতায়ালার সঙ্গে দূরত্ব। নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু সৃষ্টি আছে, সবকিছু জ্ঞানীদের জন্য আল্লাহর নিদর্শন। গাছপালা-তরুলতা, পাহাড়-পর্বত এবং সমুদ্রের বিশাল জলরাশির নিচে যে বৈচিত্র্যময় সৃষ্টিজগৎ আছে; সেটা নিয়েও মুমিনদের ভাবতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘তবে কি তারা লক্ষ করে না উটের প্রতি, কীভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে? এবং আকাশের প্রতি, কীভাবে তাকে উঁচু করা হয়েছে? এবং পাহাড়গুলোর প্রতি, কীভাবে তাকে প্রথিত করা হয়েছে? এবং ভূমির প্রতি, কীভাবে তা সমতলে বিছানো হয়েছে?’ (সুরা গাশিয়া: ১৭-২০)।

বিশাল সৃষ্টির জীববৈচিত্র্য, নান্দনিকতা, নিপুণতা, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তাভাবনা করলে ইমানদার ব্যক্তির ইমান বহুগুণ শক্তিশালী হয়, সতেজ হয়। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃজনে এবং দিন-রাতের পরিবর্তনে সুস্পষ্ট নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য। যারা দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে আল্লাহর জিকির করে এবং নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃজন নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। (তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বীকার করতে বাধ্য হয়) হে আমার প্রতিপালক! আপনি এগুলো বৃথা সৃষ্টি করেননি। আপনি (বৃথা সৃষ্টি করার দোষ থেকে) পবিত্রতম। (সুরা আলে ইমরান: ১৯১-১৯২)। হজরত আতা, হজরত ইবনে ওমর ও হজরত উবায়েদ ইবনে উমায়ের (রা.) একদিন হজরত আয়েশা (রা.)-এর কাছে নিবেদন করলেন, আমরা আপনার কাছে জানতে এসেছি, নবীজির কোন কাজটি আপনার কাছে বেশি বিস্ময়কর মনে হয়েছিল? হজরত আয়েশা (রা.) কেঁদে ফেললেন এবং বললেন, তার সব কাজ আমার কাছে অদ্ভুত মনে হতো। তবে একটি ঘটনা শোনো। এক রাতে তিনি আমার ঘরে এসে আমার সঙ্গে শয়ন করলেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে বললেন, ‘হে আয়েশা! আমি আমার রবের ইবাদত করতে চাই। আমাকে যেতে দাও।’ আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি আপনার একান্ত কাছে থাকতে চাই। আবার এও চাই যে, আপনি মহান আল্লাহর ইবাদত করবেন। তিনি বিছানা থেকে উঠে পবিত্র হয়ে নামাজে দাঁড়ালেন। তিনি কাঁদতে শুরু করলেন। কাঁদতে কাঁদতে তার দাঁড়ি ভিজে গেল, মাটি ভিজে গেল। তিনি কাঁদতে থাকলেন। ফজরের সময় বেলাল ডাকতে এসে যখন দেখল, তিনি এভাবে কাঁদছেন, তখন সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! মহান আল্লাহ আপনার আগের ও পরের সব গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। এর পরেও আপনি এত কাঁদছেন কেন? তিনি উত্তরে বললেন, ‘আমি কেঁদে কেঁদে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করব না কেন? আজ রাতে আমার ওপর এ আয়াত (নিশ্চয়ই নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃজনে এবং...) অবতীর্ণ হয়েছে। ওই ব্যক্তি বড়ই দুর্ভাগা, যে ব্যক্তি এ আয়াত পাঠ করে অথচ আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করে না।’ (ইবনে হিব্বান: ৬২০)।

শায়খ সোলায়মান দারানি বলেন, বাড়ি থেকে বের হলে যে জিনিসের ওপরই আমার চোখ পড়ে, আমি দেখি, তাতে আমার জন্য আল্লাহর একটি নিয়ামত রয়েছে। হজরত হাসান বসরি (রহ.) মন্তব্য করেছেন, আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে এক ঘণ্টা পরিমাণ চিন্তাভাবনা করা সারা রাত ইবাদত করার চেয়েও উত্তম। সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনার প্রতি উদ্দীপ্ত করার জন্য মহান আল্লাহতায়ালা মহাগ্রন্থ কোরআনে কারিমের অসংখ্য জায়গায় মানুষের প্রতি সৃষ্টিবিষয়ক বিভিন্ন প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। যেমন, ‘তারা কি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল নিয়ে ভাবে না?’ (সুরা আরাফ: ১৮৫)। আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘আমি কি পৃথিবীকে বাসযোগ্য করিনি? পাহাড়গুলোকে পেরেকস্বরূপ করিনি?’ (সুরা নাবা: ৬-১৬)। আরও বর্ণিত হয়েছে, ‘কোন জিনিস দ্বারা মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে? ...মানুষ তার খাদ্য নিয়ে ভেবে দেখুক?’ (সুরা আবাসা: ১৮-৩২)। আরও বর্ণিত হয়ছে, ‘আল্লাহর অশেষ দয়ার নির্দেশনাবলির প্রতি লক্ষ করুন। তিনি কীভাবে শুষ্ক মাটিকে পুনরায় সঞ্জীবিত করেন।’ (সুরা রুম: ৫০)।

এসব আয়াতের আলোকে উজ্জীবিত হয়ে সাহাবাদের কয়েকজন একত্রিত হলে আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। সৃষ্টির নিপুণতা ও বিস্ময় নিয়ে আলোচনা করতেন। মতবিনিময় করতেন। একদিন নবীজি কয়েকজন সাহাবিকে এরূপ চিন্তাভাবনা ও আলোচনা করতে দেখে বললেন, ‘আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা করো। কিন্তু আল্লাহকে নিয়ে চিন্তা করো না।’ (কানজুল উম্মাল: ৫৭০৮)।

প্রতিটি সৃষ্টি রহস্য এবং কুদরতে ঘেরা, যা নিয়ে চিন্তা-ফিকির করলে আসলেই আল্লাহর প্রেমে হৃদয় ভরে যায়। জ্ঞানের স্বল্পতা কিংবা শয়তানের কুমন্ত্রণায় মস্তিষ্কে অনেক উদ্ভট প্রশ্নের অবতারণা হতে পারে। কিন্তু সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে আল্লাহর সৃষ্টিজগতের দিকে। যেখান থেকে আমরা সাবলীল উত্তর পেতে পারব এবং অন্তরে খোদাভীতি জাগ্রত হবে। তবেই আমরা সব অস্থিরতা পরিত্যাগ করে একাগ্রচিত্তে আল্লাহতায়ালার ইবাদতে মশগুল থাকতে পারবে, যা আখিরাতের অনন্ত জীবনের অমূল্য সম্পদ। মহান আল্লাহ তার অসীম কুদরত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা এবং এর মাধ্যমে ইমান বৃদ্ধি ও পুণ্য অর্জনের তওফিক দিন।

লেখক: ইমাম ও খতিব