ফরায়েজি আন্দোলন: উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম জনতার শিকল ভাঙার ডাক

ফরায়েজি আন্দোলন: উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম জনতার শিকল ভাঙার ডাক

ফরায়েজি আন্দোলন বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী বেনিয়া শক্তির বিরুদ্ধে উপমহাদেশে যে কয়েকটি সংগ্রাম সাড়া জাগিয়েছিল ফরায়েজি আন্দোলন তার অন্যতম। এটি শুধু একটি ধর্মীয় পুনর্জাগরণ নয়, বরং একটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা ছিল।

ব্রিটিশ শাসনের প্রভাবে উপমহাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস-আমল, আচার-আচরণে আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল। বিজাতীয় সংস্কৃতির অনেক কিছুই মুসলমানদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছিল। ফলে তারা নিজেদের ধর্মীয় কর্মকাণ্ড থেকেও অনেক ক্ষেত্রে দূরে সরে গিয়েছিল। এমন প্রেক্ষাপটে হাজী শরীয়তুল্লাহ (১৭৮১-১৮৪০) বাংলার মুসলমানদের মাঝে তাদের বিস্মৃত ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করার মাধ্যমে তাদের ইসলামের ফরজ বিধান পালনের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য ১৮১৮ সালে আন্দোলন শুরু করেন।

এ আন্দোলনই ইতিহাসে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ নামে পরিচিত। ফরায়েজি আন্দোলন বাংলার মুসলিম সমাজে একটি ঐতিহাসিক পুনর্জাগরণের নাম। ১৯০০ শতকের শুরুতে এটি বাংলার নিম্নবিত্ত মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনা এবং সামাজিক অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য চালু হয়েছিল। এ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল ইসলামের শুদ্ধরীতি প্রচার এবং কুসংস্কার ও জমিদারি শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। হাজী শরীয়তুল্লাহর নেতৃত্বে শুরু হওয়া এ আন্দোলন বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক নতুন চেতনার সৃষ্টি করে।

ফরায়েজি শব্দটি আরবি ফারায়েজ শব্দ থেকে গৃহীত। ফারায়েজ হলো ফারিজাতুনের বহুবচন। তবে ফার্সি ভাষার অনুসরণে বাংলায় এর উচ্চারণ হয় ফরায়েজ এবং তা থেকে ‘ফরায়েজি’। ইসলাম ধর্মে অবশ্য পালনীয় কয়েকটি কর্ম রয়েছে। এসব অবশ্য পালনীয় কর্তব্য সম্পর্কে যারা আন্দোলন করেছে তাদের ‘ফরায়েজি’ বলা হয়।

তবে ফরায়েজিরা ফারায়েজ শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছে। এরা মহান আল্লাহ ও তার নবীর নির্দেশিত সব ধর্মীয় কর্তব্যকে গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছে। যদিও তারা ইসলামের পাঁচটি মৌলিক বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে বেশি।

আন্দোলনটি পূর্ব বাংলা ও আসামে বিশেষ করে পূর্ব বাংলার গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করে। ১৭৯৯ সালে মক্কায় হজ করতে গিয়ে সেখানে দীর্ঘদিন অবস্থান করে ধর্মীয় শিক্ষায় দীক্ষিত হন শরীয়তুল্লাহ। ১৮১৮ সালে দেশে ফিরে লক্ষ করেন, অনেকেই বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ধর্মীয় রীতিবিরুদ্ধ আচার-অনুষ্ঠান যুক্ত করছে। তিনি এসবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো পালনের ব্যাপারে মুসলমানদের আহ্বান করেন। একইসঙ্গে ‘শিরক’ ও ‘বিদাত’ নিষিদ্ধের ঘোষণা দেন।

ফরায়েজি আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল এ অঞ্চলে ইসলামি জীবনধারার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, কুসংস্কার, বিদআত (ধর্মীয় বিকৃতি) এবং অশুদ্ধ প্রথার বিরুদ্ধে প্রচার, নিম্নবিত্ত মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় শিক্ষা ও চেতনার বিস্তার ও জমিদারদের শোষণের বিরুদ্ধে কৃষকদের রক্ষা।

পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর বাংলার পরিবর্তিত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা ফরায়েজি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। পলাশীতে ক্ষমতা প্রতিপত্তি হারানোর পর মুসলমানদের আভিজাত্য, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পকলা, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে মারাত্মক অবক্ষয় দেখা দেয়। ইসলামিক জ্ঞানে শিক্ষিত হাজী শরীয়তুল্লাহ এসব দেখে মর্মাহত হন। মুসলমানদের এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য ফরায়েজি আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।

১৮০০ শতকের শেষভাগে এবং ১৯০০ শতকের শুরুতে বাংলার মুসলিম সমাজ কঠিন সংকটে পড়ে। ইসলামের শুদ্ধরীতি থেকে বিচ্যুতির ফলে ধর্মীয় কুসংস্কার এবং অন্ধ বিশ্বাস সমাজে ছড়িয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত মুসলমানরা জমিদারদের শোষণের শিকার হচ্ছিল। ব্রিটিশ শাসন বাংলার জমিদারি ব্যবস্থা চালু করে, যা কৃষকদের ওপর কঠোর শোষণ আরোপ করে। ফলে মুসলমানদের সামাজিক মুক্তি পরম আকাঙ্ক্ষিত ছিল।

ওই সময় মুসলমানদের মধ্যে বিদআত এবং ধর্মীয় বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। ফলে পির-ফকিরদের ভ্রান্ত চর্চা ইসলামের মূলনীতি থেকে সমাজকে দূরে সরিয়ে দেয়। ধর্মীয় শিক্ষা ও শুদ্ধতার অভাবে সমাজে অন্ধকার নেমে আসে।

ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসন মুসলমানদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা আরও দুর্বল করে তোলে। জমিদারদের চরম শোষণের কারণে কৃষকরা তাদের জমি ও জীবিকা হারাতে শুরু করে।

ফরায়েজি আন্দোলনের মূলনীতি ও কার্যক্রম

১. ধর্মীয় শুদ্ধি : ইসলামি ফরজ কার‌্যাবলির প্রতি গুরুত্ব দেওয়া। নামাজ, রোজা এবং জাকাতের বাধ্যতামূলক পালন। কুসংস্কার এবং বিদআতের বিরুদ্ধে প্রচার।

২. জমিদারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ : জমিদারদের দ্বারা কৃষকদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কৃষকদের অধিকার রক্ষার জন্য সংগঠিত আন্দোলন।

জমিদারদের অত্যাচার থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ধর্মীয় চেতনা কাজে লাগানো।

৩. সমাজ সংস্কার : মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা। সামাজিক বিভেদ দূর করার চেষ্টা। শিক্ষার প্রতি গুরুত্বারোপ।

৪. সাংগঠনিক কার্যক্রম : স্থানীয় জমায়েতের মাধ্যমে আন্দোলনের বার্তা ছড়ানো। ইমাম ও স্থানীয় নেতাদের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষার বিস্তার।

ফরায়েজি আন্দোলনের কার্যক্রম বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এক নতুন চেতনা সৃষ্টি করে এবং তাদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনে পরিবর্তন আনে।

এ সংস্কার আন্দোলনের দুটি বৈশিষ্ট্য ছিল।

১. মুসলিম কৃষক শ্রেণির মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা অনৈসলামিক বিশ্বাস ও আচারকে সংশোধন করা।

২. তাদের সংস্কার করা ধর্মমতকে কায়েমি স্বার্থান্বেষী জমিদার ও নীলকরদের থেকে রক্ষা করা। এ আন্দোলন মুসলিম কৃষক শ্রেণির মধ্যেই বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।

ফরায়েজি আন্দোলন এমন একটি প্রচেষ্টা ছিল, যা বাংলার মুসলিম সমাজকে কুসংস্কারমুক্ত করতে এবং ইসলামের মূলনীতি মেনে চলার জন্য উৎসাহিত করত। হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজি আন্দোলনকে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসাবে সীমাবদ্ধ রাখলেও তার ছেলে মোহসিন উদ্দিন ওরফে দুদু মিয়া ফরায়েজি আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপদান করেন। দুদুমিয়া মক্কাতে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে আসেন। জমিদারদের সঙ্গে ফরায়েজিদের সংঘর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি শিষ্যদের সমন্বয়ে এটাকে রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন।

ঢাকা অঞ্চলে যখন ফরায়েজি আন্দোলন সংখ্যায় ও শক্তিতে দ্রুত বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন জমিদার ও নীলকররা ফরায়েজি আন্দোলনকে স্তিমিত করতে নানা অত্যাচার-নির্যাতন শুরু করে।

শরীয়তুল্লাহর ইন্তেকালের পর দুদু মিয়ার নেতৃত্বে জনগণ আরও ব্যাপকভাবে সংগঠিত হন এ অত্যাচার-উৎপীড়নের বিরুদ্ধে।

বাংলার মুসলমান সমাজে ফরায়েজি আন্দোলন বহুমুখী প্রভাব ফেলে, যা ধর্মীয়, সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্তরে পরিবর্তন আনে।

১. ধর্মীয় প্রভাব : মুসলমানদের মধ্যে ইসলামের ফরজ কার‌্যাবলির প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি। কুসংস্কার, বিদআত এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে সমাজ মুক্তি পায়।

ইসলামের শুদ্ধ রীতিনীতি অনুসরণে মানুষ উদ্বুদ্ধ হয়।

২. সামাজিক প্রভাব : কৃষক শ্রেণির মধ্যে ঐক্য এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি। জমিদারদের বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা। নিম্নবিত্ত মুসলমানদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি।

৩. রাজনৈতিক প্রভাব : ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী চেতনার উন্মেষ। জমিদারি ব্যবস্থার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ। ভবিষ্যতের বিভিন্ন আন্দোলনে অনুপ্রেরণা প্রদান।

৪. দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব : পরবর্তী মুসলিম সংস্কার আন্দোলনের ভিত্তি স্থাপন। বাংলার মুসলমানদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের সূচনা।

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের সময় দুদু মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য পরে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৮৬২ সালে তিনি মারা যান। পরবর্তী সময়ে তার ছেলে গাজী উদ্দিন হায়দার ১৮৬২-৬৪ আব্দুল গফুর ওরফে নয়া মিয়া ১৮৬৪-৮৩ খান বাহাদুর সাইদ উদ্দিন আহমদ ১৮৮৩-১৯০৩ ফরায়েজিদের ওস্তাদ বা নেতা নির্বাচিত হন। সাইদ উদ্দিন বঙ্গভঙ্গ সমর্থন করেন।

অতঃপর তার ছেলে বাদশা মিয়া ওস্তাদ নির্বাচিত হন। তিনি খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। কিছুকাল তাকে অন্তরীণ রাখা হয়। ১৯৫১ সালে তিনি মারা গেলে ফরায়েজি আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে।

মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন ইসলামের আদর্শের ভিত্তিতে নিয়ন্ত্রিত করা ফরায়েজি আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল। ধর্মীয় সংস্কারের পাশাপাশি তারা মুসলমানদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখান এবং তাদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। প্রভাবশালী জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে এ অসম সাহসী ফরায়েজি নেতাদের সংগ্রাম বাংলার ইতিহাসে এক রোমাঞ্চকর অধ্যায়।

ফরায়েজি আন্দোলন ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলেও, নেতারা প্রথমদিকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও তাদের অনুসারীদের স্বার্থে এবং বাধ্য হয়ে অনেক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে কুণ্ঠিত হননি। সর্বোপরি শিরিক বিদআত থেকে মুসলমানদের দূরে রেখে ইসলামি আদর্শে উজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে ফরায়েজি আন্দোলনের ব্যাপক অবদান রয়েছে।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে ফরায়েজি আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা

১. ধর্মীয় চেতনার গুরুত্ব : সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় শুদ্ধতা বজায় রাখতে ফরায়েজি আন্দোলনের শিক্ষা আজও প্রাসঙ্গিক। ২. সামাজিক ঐক্যের প্রয়োজন : ফরায়েজি আন্দোলনের মতো ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা আধুনিক সমাজের বিভেদ এবং শোষণের বিরুদ্ধে কার্যকর হতে পারে।

৩. অধিকার আদায়ের জন্য প্রেরণা : এ আন্দোলন অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সাহস এবং ঐক্যের একটি চমৎকার উদাহরণ।

ফরায়েজি আন্দোলন বাংলার ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এটি শুধু একটি ধর্মীয় পুনর্জাগরণ নয়, বরং একটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের সূচনা। ফরায়েজি আন্দোলন শুধু অতীতের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি আজকের সমাজের জন্যও একটি শিক্ষা এবং প্রেরণার উৎস।

লেখক: গবেষক আলেম ও গণমাধ্যমকর্মী