মাথায় রুমাল দেওয়া কি সুন্নত না আরবীয় সংস্কৃতি?

মাথায় রুমাল দেওয়া কি সুন্নত না আরবীয় সংস্কৃতি?

আজকের আরব সমাজে মাথার ওপর সাদা কিংবা লাল-সাদা খোপ খোপ রঙের রুমাল প্রায় অপরিহার্য পোশাক। রাজপ্রাসাদ থেকে বাজার, মসজিদ থেকে অফিস—সবখানেই এই রুমাল যেন এক অনিবার্য সাজ।

অনেক মুসলমান দূর থেকে দেখে মনে করেন, নিশ্চয়ই এটি নবী করিমের সুন্নত। কিন্তু ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য দলিল বলছে, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। স্পষ্ট করে বলা প্রয়োজন, এই রুমাল কোনো সুন্নত নয়, বরং একটি মতবাদের প্রভাবে গড়ে ওঠা একটি আরবীয় সংস্কৃতি।

নবী করিম (সা.) মাথা ঢেকে রাখতেন। তিনি কখনো টুপি, কখনো পাগড়ি ব্যবহার করতেন।

হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) মক্কা বিজয়ের দিন কালো পাগড়ি পরে প্রবেশ করেছিলেন। (মুসলিম-১৩৫৮)

আরেক হাদিসে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) খুতবা দিয়েছেন কালো পাগড়ি মাথায় দিয়ে।( তিরমিজি ১৭৩৬)

ইবনে উমরের (রা.) বর্ণনায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) কালো পাগড়ি পরেছিলেন এবং তার দুই প্রান্তের একটি কাঁধে ঝুলিয়ে রেখেছিলেন।( আবু দাউদ ৪০৭৯)

তাই টুপি ও পাগড়ি নিঃসন্দেহে সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু টুপির ওপর আলাদা রুমাল ফেলে রাখার কোনো দলিল নেই।

আজকের আরবরা যে রুমাল পরে, তার শিকড় নবীর যুগে নয়। মরুভূমির প্রখর রোদ আর ধুলিঝড় থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আরবরা বহু আগে থেকেই কাপড় ব্যবহার করত, কিন্তু তা ছিল স্রেফ প্রয়োজনীয়তা।

আজকের লাল-সাদা বা সাদা রুমাল জনপ্রিয় হয় অষ্টাদশ শতকে, নাজদ অঞ্চলে ওহাবি আন্দোলনের পর। মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওহাবের নেতৃত্বে যে মতবাদ বিস্তার লাভ করে, তার সঙ্গে রাজনৈতিক শক্তির উত্থান জড়িয়ে যায়। সৌদি শাসন প্রতিষ্ঠার পর এই রুমাল হয়ে ওঠে তাদের পরিচয়ের প্রতীক। ধীরে ধীরে আরব জাতীয়তাবাদ ও সামাজিক প্রভাবের কারণে এটি সারা উপসাগরীয় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

অতএব, আজকের আরবদের মাথার রুমাল নবীর সুন্নত নয়, এটি ওহাবি প্রভাবিত সংস্কৃতি। যারা এটিকে সুন্নত বলে দাবি করেন, তারা ইতিহাস ও হাদিস উভয়কেই অস্বীকার করেন। নবীর সুন্নত হলো টুপি ও পাগড়ি, যার স্পষ্ট প্রমাণ হাদিসে আছে। অন্যদিকে লাল-সাদা বা সাদা রুমাল নিছক আরবদের সাংস্কৃতিক পোশাক।

আমাদের সমাজে বিভ্রান্তির মূল এখানেই। আরবরা যেহেতু পরে, তাই অনেকেই মনে করেন এটি ধর্মীয় আমল। অথচ ইসলাম কোনো জাতিগত রীতিকে ধর্মে পরিণত করতে বলেনি। সুন্নত হলো নবীর জীবনাচরণ, আর সংস্কৃতি হলো ভৌগোলিক ও সামাজিক বাস্তবতা। এ দুইয়ের পার্থক্য না বোঝার কারণে মানুষ ভুল পথে হাঁটে।

ইসলামের মূল শিক্ষা হলো সরলতা, মর্যাদা ও বিনয়। পোশাকের উদ্দেশ্য হলো দেহ আচ্ছাদন ও পবিত্রতা। নবীর অনুসরণ মানে কেবল বাহ্যিক সাজ নয়, বরং তার চেতনা ধারণ করা। তাই টুপি ও পাগড়ি সুন্নতের অংশ, কিন্তু রুমাল নয়।

মুসলমানদের দায়িত্ব হলো সুন্নতকে আঁকড়ে ধরা এবং সংস্কৃতিকে সংস্কৃতি হিসেবেই দেখা। ধর্মের নামে সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দিলে বিভ্রান্তি বাড়বে, অথচ সুন্নতের মর্যাদা রক্ষাই আমাদের আসল কর্তব্য।

তথ্যসূত্র: আল-মাকরিজি, আল-খিতাত, খণ্ড ২, মাদাওয়ি আল-রাশিদ, সৌদি আরবের ইতিহাস (কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১০)

লেখক: শিক্ষার্থী, আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়, কায়রো, মিশর।