মুসলিম বিশ্বের প্রধানতম আধ্যাত্মিক পুরুষ বড় পীর শায়খ আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)। তার পূর্ণ নাম আবু মুহাম্মদ মুহিউদ্দিন আবদুল কাদের ইবনে আবু সালেহ মুসা আল-জিলানি। তিনি ১০৭৭ বা ১০৭৮ খ্রিষ্টাব্দে (৪৭০ হিজরি) পারস্যের জিলান প্রদেশের নাঈফ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার নামের শেষে ‘জিলানি’ যোগ হয়েছে তার জন্মস্থান ‘জিলান’ (বা গিলান) প্রদেশের নাম থেকে। অনেকে তাকে গাউসুল আজম (সর্বোচ্চ সাহায্যকারী) উপাধিতেও ডাকেন।
আবদুল কাদের জিলানি (রহ.)-এর জন্ম পারস্যের একটি ধার্মিক পরিবারে। তার পিতা আবু সালেহ ছিলেন একজন পরহেজগার ব্যক্তি এবং তার মা ছিলেন তৎকালীন সমাজের একজন ইবাদতগুজার মহীয়সী নারী। বলা হয়, তিনি গর্ভাবস্থাতেই রোজা রাখতেন এবং তার সন্তান আবদুল কাদের জন্ম থেকেই পবিত্রতা ও সাধুতার পরিচয় বহন করতেন।
তার শিক্ষার প্রতি অগাধ আগ্রহ ছিল। মাত্র আঠারো বছর বয়সে তিনি বাগদাদ গমন করেন জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে। সে সময় বাগদাদ ছিল জ্ঞানের মহানগরী। সেখানে তিনি হাদিস, তাফসির, ফিকহ, যুক্তিবিদ্যা ও অন্যান্য শাস্ত্রে উচ্চতর শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বিশেষভাবে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বালের (রহ.) ফিকহ অনুসরণ করতেন এবং সেই সূত্রেই ‘হাম্বলি মাজহাব’-এর একজন প্রধান আলেমে পরিণত হন।
শুধু একাডেমিক বিদ্যাই নয়, তিনি আত্মশুদ্ধির পথে রওনা দেন। জাহেরি বিদ্যার পাশাপাশি তিনি বতিনি (আধ্যাত্মিক) জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করেন। তিনি দীর্ঘ সময় বাগদাদের বাইরে নির্জন পাহাড়ে ও মরুভূমিতে কাটিয়েছেন ইবাদত ও ধ্যান-জপে। সেই সময় তিনি আত্মিক উৎকর্ষ লাভ করেন এবং বহু অলৌকিক কেরামতির প্রকাশ ঘটে তার মাধ্যমে।
পরবর্তী জীবনে তিনি বাগদাদে ফিরে এসে খুতবা, দাওয়াত ও ইলম বিতরণ শুরু করেন। তার উপদেশমূলক বক্তব্য এবং আল্লাহর প্রেমভরা ভাষণ হাজার হাজার মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেত। আলেম ও জ্ঞানীরা যেমন তার কাছে আসতেন গভীর জ্ঞান লাভের আশায়, তেমনি সাধারণ মানুষও তার কাছে আত্মিক প্রশান্তি ও হেদায়েতের সন্ধান পেতেন। তার মজলিসে একসঙ্গে হাজার হাজার মানুষ অংশগ্রহণ করতেন। বলা হয়, অনেক সময় তার খুতবা শুনে অমুসলিমরাও ইসলাম গ্রহণ করতেন।
আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) সুফি তরিকার একজন মহান পথপ্রদর্শক। তিনি ‘কাদেরিয়া তরিকা’র প্রবর্তক হিসেবে পরিচিত, যা আজও বিশ্বব্যাপী প্রচলিত একটি সুপরিচিত সুফি তরিকা। এই তরিকায় ইবাদত-বন্দেগি, পরহেজগারি, আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ ভরসা এবং মানবকল্যাণমূলক কাজকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। তার শিক্ষাদর্শে আত্মশুদ্ধি, তাওয়াক্কুল (আল্লাহর ওপর নির্ভরতা), জুহদ (জগৎ বিমুখতা), ও ইখলাস (নিষ্কলুষতা) বিশেষভাবে গুরুত্ব পেয়েছে।
আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার কিছু প্রসিদ্ধ রচনার মধ্যে রয়েছে—‘আল-গুনিয়া লি তালিবি তরিকিল হক’, ‘ফতহুর রাব্বানি’, ‘ফুতুহুল গায়ব’, ‘জিলাউল খাতির’ ইত্যাদি। এসব গ্রন্থে তিনি শরিয়ত ও তাসাউফ উভয়ের ব্যাখ্যা দিয়েছেন সহজ, হৃদয়স্পর্শী ভাষায়।
আবদুল কাদের জিলানি (রহ.) ১১৬৬ খ্রিষ্টাব্দে (৫৬১ হিজরি) বাগদাদে ইন্তেকাল করেন। তার কবরস্থানের পাশে এখনো হাজারো ভক্ত ও মুরিদ ভিড় জমায় তার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা জানাতে। তার রেখে যাওয়া শিক্ষা, দাওয়াত ও আধ্যাত্মিক অনুপ্রেরণা আজও বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে আলোকিত করছে। তার নাম আজও উচ্চারিত হয় গভীর শ্রদ্ধা, প্রেম ও ভক্তিতে। আল্লাহ আমাদের তার জীবন থেকে আলো নিয়ে চলার তওফিক দিন।