মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচার আমল

মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা থেকে বাঁচার আমল

অ্যাঙ্কজাইটি বা দুশ্চিন্তা বলতে অনিশ্চয়তা কিংবা আতঙ্ক থেকে সৃষ্ট অতিরিক্ত ভয়কে বোঝায়, যা মানুষের মন ও মস্তিষ্কের মধ্যে এক ধরনের উচ্চচাপ সৃষ্টি করে। দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিতে কখনো কখনো আমাদের দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হতে হয়।

অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়মিত দুশ্চিন্তার সঙ্গে যোগ হয় তীব্র মাথাব্যথা, পেশি বেদনা ও আতঙ্ক ব্যাধিসহ অন্যান্য শারীরিক সমস্যা।

ইসলাম বলে- একমাত্র আল্লাহই আমাদের সকল দুশ্চিন্তা, হতাশা ও কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করতে পারেন। তিনিই হচ্ছেন সব নিরাময়ের উৎস। এ পৃথিবীতে যা কিছু ঘটে তার সবটাই আল্লাহর ইশারায় ঘটে।

সুতরাং সর্বাবস্থায় তার সাহায্য কামনা করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। তবে দুশ্চিন্তাপীড়িত হলে প্রয়োজনে অবশ্যই চিকিৎসার আশ্রয় নিতে হবে।

দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রথম হলো ইমান ও তাকওয়াকে মজবুত করতে হবে। যার ইমান যত দুর্বল সে তত তাড়াতাড়ি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আর যার ইমান শক্তিশালী দুশ্চিন্তা তাকে কম স্পর্শ করে। যত সমস্যাই হোক আল্লাহতায়ালা আমার সমস্যা দেখবেন— এ বিশ্বাস রাখতে হবে।

আল্লাহতায়ালা আছেন, তার ওপর আমার ভরসা থাকবে। আমার এ সমস্যার একটা সমাধান হবেই হবে ইনশাআল্লাহ। আর কিছু না হোক আখেরাত আমার সামনে আছে। এ জন্য ইমানদার ডিপ্রেশড হয়ে ভেঙে পড়বে এটা তার জন্য সাজে না। এ জন্য ইমান মজবুত করলে আমরা পেরেশানি থেকে মুক্তি পাব।

ধৈর্য ধারণ করা

জীবনে যখন খারাপ সময় আসবে, তখন ধৈর্য ধারণ করুন। বিশ্বাস রাখুন, আপনার সঙ্গে রব আছেন, কষ্টের পরে তিনিই স্বস্তি দিবেন। আর এটাও মনে রাখবেন, বিপদে ধৈর্য ধারণকারীদের জন্য আল্লাহ তাআলা পরকালে মহাপুরস্কার রেখেছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি অবশ্যই তোমাদের পরীক্ষা করব সামান্য ভয় ও ক্ষুধা এবং জান-মাল ও ফসলের কিছুটা ক্ষতি দিয়ে; আর তুমি ধৈর্যশীলদের সুসংবাদ দাও- যাদের ওপর কোনো মসিবত এলে বলে, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’- নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর আর অবশ্যই আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব।' -সুরা বাকারা (২) : ১৫৫-১৫৬

তাকদিরের ওপর ছেড়ে দেওয়া

ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন, তাকদিরের ওপর ছেড়ে দিন। সমস্যার সমাধান একমাত্র রবই করতে পারে এই বিশ্বাস রাখুন। দেখবেন, দুশ্চিন্তা কখনোই আপনাকে কাবু করতে পারবে না, হতাশা আদৌ আপনার মনোবল দুর্বল করতে পারবে না।

আল্লাহ তাআলা বলেন, আল্লাহ তোমাদের ক্লেশ দিলে তিনি ছাড়া তা মোচনকারী আর কেউ নেই। আর আল্লাহ যদি তোমার মঙ্গল চান, তাহলে তাঁর অনুগ্রহ রদ করার কেউ নেই...। ’ (সুরা : ইউনুস, আয়াত : ১০৭)

বিপদে আল্লাহকে ডাকা

আল্লাহ ছাড়া কেউ বিপদ থেকে মুক্তি দিতে পারে না। তাই বিপদাপদ, চিন্তা- পেরেশানির সময় বেশি বেশি দোয়া করা উচিত, বিশেষত, দুশ্চিন্তা ও মানসিক অস্থিরতা থেকে নাজাতের উদ্দেশ্যে হাদিসে বেশ কিছু দোয়া শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। ওই দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়ুন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি এমন একটি দোয়া সম্পর্কে অবগত আছি, কোনো বিপদগ্রস্ত লোক তা পাঠ করলে আল্লাহ তাআলা তার সেই বিপদ দূর করে দেন। সেটি হচ্ছে আমার ভাই ইউনুস (আ.)-এর দোয়া। দোয়াটি হলো—‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জ্বলিমীন। ’

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি ছাড়া কোনো সত্য উপাস্য নেই; আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি। নিঃসন্দেহে আমি জালিমদের অন্তর্ভুক্ত। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৫০৫)

চিন্তায় পরিবর্তন আনা

দুনিয়ার চাকচিক্য আর অঢেল বিত্ত বৈভবের কথা না ভেবে চিন্তার মোড় ঘুরিয়ে নিজের চেয়ে নিম্ন আয়ের মানুষদের অবস্থার দিকে তাকান। ভাবুন, আল্লাহ আপনাকে তার থেকে কতোটা ভালো রেখেছেন।

খাব্বাব (রা.) বলেন, আমরা আল্লাহর রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে অভিযোগ করলাম এ অবস্থায় যে, তিনি কাবাঘরের ছায়ায় একটি চাদরে ঠেস দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। আমরা বললাম, আপনি কি আমাদের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইবেন না? আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করবেন না?

জবাবে তিনি বলেন, ‘তোমাদের জানা উচিত, তোমাদের আগের মুমিন লোকেদের এই অবস্থা ছিল যে একজন মানুষকে ধরে আনা হতো, তার জন্য গর্ত খুঁড়ে তাকে তার মধ্যে পুঁতে রাখা হতো। অতঃপর তার মাথার ওপর করাত চালিয়ে তাকে দুই খণ্ড করে দেওয়া হতো এবং দেহের গোশতের নিচে হাড় পর্যন্ত লোহার চিরুনি চালিয়ে শাস্তি দেওয়া হতো। কিন্তু এই কঠোর পরীক্ষা তাকে তার দ্বিন থেকে ফেরাতে পারত না। (বুখারি, হাদিস : ৩৬১৬)

ইস্তেগফার করা

চিন্তা পেরেশানি অনেক সময় আর্থিক সঙ্কটের কারণে হয়ে থাকে। এজন্য নিয়মিত ইস্তেগফার করলে আর্থিক টানাপোড়েনসহ সব সঙ্কট আল্লাহ তাআলা দূর করে দিবেন এবং দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি দিবেন।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিয়মিত ইস্তেগফার করবে আল্লাহ তার সব সংকট থেকে উত্তরণের পথ বের করে দেবেন, সব দুশ্চিন্তা মিটিয়ে দেবেন এবং অকল্পনীয় উৎস থেকে তার রিজিকের সংস্থান করে দেবেন। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ১৫২০)

সুধারণা পোষণ করা

আল্লাহর ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করুন। তার ওপর ভরসা রাখুন। আশা রাখুন যে, তিনি আপনাকে আপনার দুরবস্থা থেকে নাজাত দেবেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর যে আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করে, আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। ’ (সুরা : তালাক, আয়াত : ৩)

অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আমি আমার বান্দার ধারণা অনুসারে তার সাথে আচরণ করি। সে যদি আমার ব্যাপারে ভালো ধারণা করে তবে তার জন্যই, আর সে যদি আমার ব্যাপারে খারাপ ধারণা করে তবে তাও তার জন্য। (সুনানে আহমদ, ৯০৭২)

মুসলমান হিসেবে আমরা জানি, এ পার্থিব জীবন একটি পরীক্ষামাত্র। আমরা বিশ্বাস করি- জীবনে চলার পথে কখনো কখনো আমাদেরকে চিন্তায় পড়তে হয়, ভাবতে হয়; তবে আমরা সবসময় চেষ্টা করি আমাদের এ চিন্তা যেনো আধিক্যের কারণে কখনো দুশ্চিন্তায় পরিণত না হয়। আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকার সর্বোত্তম উপায় হলো আল্লাহতায়ালার কাছে সাহায্য চাওয়া।

দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার দোয়া-

اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْهَمِّ وَالْحَزَنِ، وَالْعَجْزِ وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ وَالْجُبْنِ، وَ أَعُوذُ بِكَ مِنَ ضَلَعِ الدَّيْنِ، وَغَلَبَةِ الرِّجَالِ

উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউযু বিকা মিনাল হাম্মি ওয়াল হাযানি, ওয়া আউযু বিকা মিনাল বুখলি ওয়াল জুবনি, ওয়া আউযু বিকা মিন দ্বালা’য়িদ্দাইনি ওয়া গালাবাতির রিজাল।’ (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)

অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে আপনার আশ্রয় চাই, অপারগতা ও অলসতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে আপনার আশ্রয় চাই আর ঋণের ভার ও মানুষদের দমন-পীড়ন থেকেও আপনার আশ্রয় চাই।