বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.): ইসলাম প্রতিষ্ঠার সংগ্রামী জীবন
মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মানব ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তিনি আল্লাহর শেষ রাসূল হিসেবে সমগ্র মানবজাতির জন্য দয়া ও রহমতের প্রতীক হয়ে আসেন।
তাঁর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় মুসলিম উম্মাহর জন্য আদর্শ। ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি অসীম কষ্ট সহ্য করেছেন, জীবনের দীর্ঘ সময় সংগ্রামে অতিবাহিত করেছেন।
শৈশব ও কৈশোর জীবন
হযরত মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে, মক্কার কুরাইশ বংশে। তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ জন্মের পূর্বেই ইন্তেকাল করেন এবং মাতা আমিনা ছয় বছর বয়সে তাঁকে এতিম রেখে চলে যান। এরপর দাদা আব্দুল মুত্তালিব এবং পরে চাচা আবু তালিব তাঁর লালন-পালন করেন।
ছোটবেলা থেকেই তিনি সত্যবাদিতা, আমানতদারি ও ন্যায়পরায়ণতার জন্য পরিচিত ছিলেন। মক্কার লোকেরা তাঁকে “আল-আমিন” (বিশ্বস্ত) উপাধি দেন।
নবুওয়াত প্রাপ্তি
৪০ বছর বয়সে হেরা গুহায় ইবাদতের সময় তিনি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম ওহি লাভ করেন। ফেরেশতা জিবরাইল (আ.) এসে তাঁকে কোরআনের প্রথম আয়াত শিখিয়ে দেন। এর পর থেকেই শুরু হয় নবুওয়াতের যুগ এবং মানুষের মাঝে তাওহিদের দাওয়াত।
মক্কার ১৩ বছরের সংগ্রাম
নবুওয়াত প্রাপ্তির পর তিনি প্রথমে গোপনে এবং পরে প্রকাশ্যে মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান করতে থাকেন। কিন্তু মক্কার কুরাইশ মুশরিকরা তাঁর এই দাওয়াতকে গ্রহণ করেনি। বরং তাঁকে এবং তাঁর সাহাবিদের উপর চালাতে থাকে ভয়াবহ নির্যাতন।
সাহাবিদের গরম বালুতে শুইয়ে দেওয়া হতো, হযরত বিলাল (রা.)-এর গলায় দড়ি দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হতো, নবী করিম (সা.)-এর মাথায় উটের নাড়া রাখা হতো যখন তিনি সিজদায় থাকতেন, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবরোধ করা হয়েছিল (শেবে আবু তালিবে তিন বছর ক্ষুধার কষ্ট)। এত নির্যাতনের মধ্যেও তিনি ধৈর্য হারাননি, বরং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে দাওয়াত চালিয়ে যান।
মদিনায় হিজরত ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা
নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকলে আল্লাহর নির্দেশে তিনি মদিনায় হিজরত করেন। ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত এই হিজরত ইসলামি ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। মদিনায় গিয়ে তিনি প্রথম ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে মুসলমান, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের নিয়ে মদিনা সনদ প্রণয়ন করেন, যা ছিল পৃথিবীর প্রথম লিখিত সংবিধান।
ইসলাম রক্ষার যুদ্ধ
মদিনায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর মক্কার কুরাইশরা বারবার মুসলমানদের আক্রমণ করে। মহানবী (সা.) বাধ্য হয়ে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
বদর যুদ্ধ (২ হিজরি): মুসলমানদের প্রথম বিজয়। সংখ্যায় কম (৩১৩ জন) হওয়া সত্ত্বেও মুসলমানরা বিজয় লাভ করেন।
উহুদ যুদ্ধ (৩ হিজরি): মুসলমানদের জন্য এক বড় পরীক্ষা। নবী করিম (সা.) নিজেই আহত হন।
খন্দক যুদ্ধ (৫ হিজরি): মদিনাকে রক্ষা করার জন্য খন্দক খনন করে মুসলমানরা বড় ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেন।
হুদাইবিয়ার সন্ধি (৬ হিজরি): ইসলামের জন্য এক কৌশলগত বিজয়, যার ফলে অনেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন।
মোটামুটি ৮ বছর ধরে মদিনায় থেকে তিনি ইসলাম রক্ষায় একাধিক যুদ্ধ করেছেন। তবে তিনি কখনো আগ্রাসী যুদ্ধ শুরু করেননি; বরং আত্মরক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছেন।
ইহুদিদের ষড়যন্ত্র ও নির্যাতন
মদিনায় কিছু ইহুদি গোত্র বারবার চুক্তিভঙ্গ করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল। কেউ কেউ মুনাফিকদের সাথে যোগসাজশ করে যুদ্ধ উসকে দিত। নবী করিম (সা.) অত্যন্ত ন্যায়সংগতভাবে তাদের মোকাবিলা করেন এবং মদিনায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
মক্কা বিজয় ও মহান ক্ষমা
৮ হিজরিতে মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে মক্কা বিজয় করেন। এ সময় নবী করিম (সা.) তাঁর শত্রুদেরও ক্ষমা করে দেন। তিনি ঘোষণা করেন—“আজ তোমাদের জন্য কোনো ভর্ৎসনা নেই। যাও, তোমরা মুক্ত।”এটি মানব ইতিহাসের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বিদায় হজ ও শেষ উপদেশ
১০ হিজরিতে তিনি বিদায় হজ পালন করেন এবং আরাফাতের ময়দানে ঐতিহাসিক খুতবা প্রদান করেন। সেখানে তিনি মানবাধিকার, নারী অধিকার, সমতা ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেন। এরপর ৬৩ বছর বয়সে ১১ হিজরিতে তিনি ইন্তেকাল করেন।
ইসলাম প্রতিষ্ঠায় তাঁর কষ্ট ও ত্যাগ
নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে হিজরত করতে হয়েছে, শত্রুদের নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, একাধিক যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের কষ্ট ভোগ করেছেন, প্রিয়জনদের শহীদ হতে দেখেছেন।
কিন্তু কোনো কষ্টই তাঁকে দাওয়াত ও ইসলাম প্রচার থেকে বিরত করতে পারেনি। তাঁর ধৈর্য, দয়া এবং ক্ষমাশীলতা মানবজাতির জন্য চিরন্তন শিক্ষা।
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন সংগ্রামী ও অনুকরণীয়। তিনি কেবল মুসলিম জাতির নয়, সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত। তাঁর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে মুসলিম উম্মাহ যদি আল্লাহর পথে ফিরে আসে, তবে দুনিয়ায় শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
এইচআর/ইএইচ