সাহাবি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস নির্মিত চীনের প্রথম মসজিদ

সাহাবি সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস নির্মিত চীনের প্রথম মসজিদ

প্রাচ্যের প্রাচীনতম বন্দরনগরী গুয়াংঝৌ আজকের চীনের বাণিজ্যিক রাজধানী। বন্দরঘেঁষা ব্যস্ত এ শহরের কোলাহলে দাঁড়িয়ে আছে এক ইতিহাসের সাক্ষী, এক আধ্যাত্মিক নিদর্শন হুয়াইশেং মসজিদ।

শুধু প্রার্থনার স্থান নয়, এটি এক জীবন্ত দলিল, যেখানে মিলেমিশে গেছে ইসলামি সভ্যতা, প্রাচীন চীনা ঐতিহ্য আর সমুদ্রপথে বিস্তৃত দাওয়াতের অনন্য কাহিনি। চীনের মুসলমানদের কাছে এ মসজিদ ‘হুয়াইশেং’ নামে পরিচিত, যার অর্থ ‘জ্ঞানী মানুষকে স্মরণ।’

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.)কে স্মরণ করেই এর নামকরণ। আবার এর আরেক নাম ‘লাইট হাউস মসজিদ’। কারণ, এক সময় এ মসজিদের সুউচ্চ মিনার নৌযাত্রীদের জন্য ছিল বাতিঘরের মতো দিকনির্দেশনার আলো।

পুরোনো দলিল ও মৌখিক ইতিহাস জানায়, ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দে নবীর চাচা হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) ইসলামের দাওয়াতের অংশ হিসাবে চীনে আগমন করেন। সে সময় ইসলামের খিলাফত ছিল খোলাফায়ে রাশেদিনের হাতে, আর চীন শাসিত হচ্ছিল শক্তিশালী তাং রাজবংশের অধীনে। তিনি সম্রাটের অনুমতিতে যে মসজিদ নির্মাণ করেন, তাই আজকের হুয়াইশেং মসজিদ। প্রায় ১৩৯০ বছরের পুরোনো এ স্থাপনাই ইসলামের আগমনের প্রথম স্বাক্ষর হয়ে আছে চীনের বুকে।

২ হাজার ৯৬৬ বর্গমিটার আয়তনের এ মসজিদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় নিদর্শন হলো মিনারটি। ১১৮ ফুট উচ্চতার সরু এক টাওয়ার, যা দেখতে একেবারেই সিলিন্ডারের মতো। পাথর ও চুন-সুরকির নিপুণ কারুকাজে গড়া এ আলোক বুরুজ শুধু চীনের মধ্যে নয়, সমগ্র ইসলামি স্থাপত্যেই এক অনন্য সংযোজন। এর ভেতরের সরু সিঁড়িপথ বেয়ে উঠলে আজও বোঝা যায়, এক সময় এটি কীভাবে ঝুজিয়াং নদীপথের নাবিকদের জন্য দিকনির্দেশনা ছিল।

হুয়াইশেং মসজিদ শুধু গড়ে ওঠেনি, বারবার ধ্বংসও হয়েছে। ১৩৫০ সালে একবার বড় ধরনের সংস্কার হয়। পরে ১৬৯৫ সালে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মসজিদটি ধ্বংস হয়ে গেলে নতুন করে নির্মাণ করা হয়। তারপর থেকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এটি অটল দাঁড়িয়ে আছে, যেমন দাঁড়িয়ে থাকে বিশ্বাসের দুর্গ।

আজ চীনে ৩০ হাজারেরও বেশি মসজিদ রয়েছে। তাদের অনেকেই গম্বুজ ও মিনার শোভিত আধুনিক রূপ নিয়েছে। কিন্তু হুয়াইশেং মসজিদ এখনো তার প্রাচীন সৌন্দর্য ধরে রেখেছে। এটি শুধু ইবাদতের স্থান নয়; বরং গুয়াংঝৌর মুসলমানদের জীবনে এক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, যেখানে মিলিত হয় ধর্ম, ঐতিহ্য আর ইতিহাসের স্রোতধারা।

হুয়াইশেং মসজিদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ইসলাম কখনো তরবারির ধার দিয়ে নয়, বরং আলো, জ্ঞান ও সভ্যতার দাওয়াত নিয়েই দূর প্রাচ্যে পৌঁছেছিল। বাতিঘরের মতো এ মসজিদ আজও আলোকিত করে রাখে ইতিহাসের পথ, যেখানে ভ্রমণকারী শুধু স্থাপত্য নয়, খুঁজে পান বিশ্বাসের দীপ্তি ও মানবতার চিরন্তন বন্ধন।