আজকের শিশু-কিশোরদের জন্যও মহানবী মুহাম্মদ (সা.) সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ। শিশুদের চরিত্র গঠন ও জীবন গড়ার ক্ষেত্রে তাঁর জীবনই সর্বশ্রেষ্ঠ উপমা। তাঁর জীবনজুড়ে ছিল শিশুদের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা। শিশুরাও তাঁর সান্নিধ্যে এসে নুরে উদ্ভাসিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সুরা আহযাব, আয়াত: ২১)
শিশুরা আল্লাহর দেওয়া নিয়ামত ও বরকত। নবীজি (সা.) শিশুদের প্রজাপতি ও ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘শিশুরা জান্নাতের প্রজাপতি।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১,৯১০)
প্রজাপতির মতো শিশুরাও তাদের নিষ্কলুষ মন ও সৌন্দর্য দিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করে। তিনি আরও বলেন, ‘শিশুরা আল্লাহর ফুল।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস: ১৯১২)
নবীজি (সা.) শিশুদের প্রতি অসীম মমত্ববোধ পোষণ করতেন। তিনি বলেন, ‘যে ছোটদের আদর করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমাদের নয়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩১৮)
নবীজি কখনো শিশুদের কঠোর কথা বলতেন না বা চোখ রাঙাতেন না। শিশুদের দেখলে তিনি আনন্দে উদ্বেল হতেন, কোলে তুলে নিতেন এবং মজার মজার কথা বলে তাদের আনন্দ দিতেন। তাঁর এই আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয়।
নবীজি কখনো শিশুদের ওপর রাগ করতেন না, কঠোর কথা বলতেন না বা চোখ রাঙাতেন না। শিশুদের দেখলে তিনি আনন্দে উদ্বেল হতেন, তাদের বুকে জড়িয়ে ধরতেন, কোলে তুলে নিতেন এবং মজার মজার কথা বলে তাদের আনন্দ দিতেন। তাঁর এই আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত শিক্ষণীয়।
একদিন নবীজি (সা.) তাঁর নাতি হাসান (রা.)-কে আদর করে চুমু খাচ্ছিলেন। এ দৃশ্য দেখে আকরা ইবনে হারিস বললেন, ‘আমার ১০টি সন্তান আছে; কিন্তু আমি কখনো তাদের এভাবে আদর করি না।’ নবীজি বললেন, ‘যদি আল্লাহ তোমার অন্তর থেকে মমতা তুলে নিয়ে থাকেন, তবে আমি কী করতে পারি?’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৯৯৭)
নবীজি আরও বলেন, ‘যে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করে না, সে আমার উম্মত নয়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,০০২)
নবীজি (সা.) জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব শিশুর প্রতি সমান ভালোবাসা প্রদর্শন করতেন। মুসলিম শিশুদের যেমন আদর করতেন, তেমনি অমুসলিম শিশুদেরও সমান স্নেহ করতেন। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক শিশু ফিতরাতের (ইসলামের স্বভাবের) ওপর জন্মগ্রহণ করে। তার মাতা–পিতা তাকে ইহুদি, খ্রিষ্টান বা অগ্নিপূজক বানায়।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ১,৩৫৮; সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৬৫৮)
একবার এক বেদুইন নবীজিকে শিশুদের সঙ্গে আনন্দ করতে দেখে বললেন, ‘শিশুদের সঙ্গে এমন আনন্দ করা আমার পছন্দ নয়।’ নবীজি দুঃখ পেয়ে বললেন: ‘যার হৃদয়ে মায়া নেই, আল্লাহ তার প্রতি দয়া দিন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩১৬)
যে ছোটদের আদর করে না এবং বড়দের সম্মান করে না, সে আমাদের নয়।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২,৩১৮
নবীজি (সা.) এতিম শিশুদের প্রতি বিশেষ মমতা দেখাতেন। তিনি বলেন, ‘আমি ও এতিমের প্রতিপালনকারী জান্নাতে এমনভাবে থাকব।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৫,৩০৪)
তিনি তর্জনী ও মধ্যমা আঙুলের মধ্যে সামান্য ফাঁক রেখে এ কথা বলেন, যা এতিমের প্রতি তাঁর নৈকট্যের ইঙ্গিত দেয়। ইসলামে এতিমের সম্পদ ভক্ষণকে কবিরা গুনাহ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।
নবীজি (সা.) শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করতে ভালোবাসতেন। তিনি বলতেন, ‘দেখো, কে আমার কাছে আগে পৌঁছাতে পারে!’
শিশুরা তাঁর কোলে, কাঁধে বা গলায় ঝুলে পড়ত। তিনি অপরিচিত শিশুদেরও সমান আদর করতেন। একবার হযরত আনাস (রা.)-এর ছোট ভাইয়ের পোষা পাখি মারা যায়। নবীজি তাকে আদর করে বললেন, ‘হে আবু উমায়র, তোমার পাখির ছানাটির কী হলো?’ (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬,১২৯)
শিশুটি তাঁর কথায় হেসে ফেলে। এ ঘটনা নবীজির শিশুদের মন বোঝার অসাধারণ ক্ষমতার প্রমাণ।
একবার উম্মে কায়েস বিনতে মুহসিন (রা.) তাঁর শিশুপুত্রকে নিয়ে নবীজির কাছে আসেন। শিশু তাঁর কোলে প্রস্রাব করে ফেলে। নবীজি বিন্দুমাত্র বিরক্ত না হয়ে মুচকি হেসে পানি দিয়ে কাপড় পরিষ্কার করেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২২৩)
অন্য এক ঘটনায়, এক শিশু মায়ের দেওয়া আঙুর নিজে খেয়ে ফেলে। নবীজি তাকে আদর করে বললেন, ‘কী হে, মায়ের দেওয়া আঙুরগুলো কোথায় হারিয়ে গেল?’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ৪,৯৯১)
নবীজি (সা.) শিশুদের শিক্ষা ও মর্যাদার প্রতি গুরুত্ব দিতেন। তিনি বলেন, ‘তোমরা শিশুদের স্নেহ করো এবং তাদের প্রতি দয়ালু হও।’ (মিশকাত আল-মাসাবিহ, হাদিস: ৬,১৫০)
নবীজি (সা.) শিশুদের সঠিক নামে ডাকতেন এবং তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত করতেন। তিনি বলেন, ‘সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান-খয়রাতের চেয়ে উত্তম।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৬২৮)
‘সন্তানকে সদাচার শিক্ষা দেওয়া দান-খয়রাতের চেয়ে উত্তম।সহিহ মুসলিম, হাদিস: ১,৬২৮
নবীজির আগমনে শিশুরা আনন্দে উদ্বেল হতো। আবু নাঈম বর্ণনা করেন, ‘নবীজির কাফেলা দেখে আমরা খেলাধুলা ভুলে তাঁর দিকে ছুটে যেতাম। তিনি ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও আমাদের জন্য থামতেন, আমাদের আদর করতেন। আমি লাজুক ছিলাম, কিন্তু তিনি হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন। তাঁর স্নেহ আমার জীবনে অবিস্মরণীয়।’ (ইমাম আহমদ, মুসনাদ , ৫/২৭৮, দারুল কুতুব, কায়রো, ১৯৯৫)
শিশুদের প্রতি নবীজির (সা.) স্নেহ, মমতা ও আদর্শ শিক্ষক ও অভিভাবকদের জন্য অনুকরণীয়। তিনি শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশে গুরুত্ব দিয়েছেন, তাদের নিরাপত্তা ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি শিশু হত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, ‘তোমরা তোমাদের সন্তানদের গোপনে ধ্বংস করবে না।’ (সুনান আবু দাউদ, হাদিস: ২,৮৭৮)
শিক্ষক সমাজ যদি নবী (সা.)-এর এই আদর্শ অনুসরণ করে শিশুদের প্রতি ভালোবাসা ও সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদান করে, তবে প্রতিটি শিশু সোনার মতো উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে।
মো. কামরুজ্জামান: ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ), প্রাইমারি টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, রাজশাহী