ইসলাম একটি বিস্তৃত জীবনব্যবস্থা। পাশ্চাত্যের জ্ঞানতাত্ত্বিক মডেল ও সভ্যতার প্রভাব আধুনিক বিশ্বে জ্ঞান, চিন্তা এবং জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। ঔপনিবেশিক আন্দোলন, প্রযুক্তিগত উন্নতি ও বিশ্বায়নের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের ধারণা, জীবনধারা এবং ব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে শুধু মুসলিমদের জন্য নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য চিন্তা, জ্ঞান, কাজ, জীবন ও সমাজে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
এই প্রভাবের একটি বড় দিক হলো পাশ্চাত্যের ধর্মীয় ধারণা অন্যান্য ধর্মের ওপর চাপিয়ে দেওয়া। এর ফলে ধর্মকে কেবল ব্যক্তিগত একটি অবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে এবং এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সভ্যতাগত ভূমিকা উপেক্ষিত হয়েছে।
ঔপনিবেশিক আন্দোলন, প্রযুক্তিগত উন্নতি ও বিশ্বায়নের মাধ্যমে পাশ্চাত্যের ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ায় শুধু মুসলিমদের নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য জীবন ও সমাজে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে।
পাশ্চাত্যের জ্ঞানতাত্ত্বিক মডেল ধর্মকে কেবল ব্যক্তিগত একটি বিশ্বাসগত অবস্থা বা আধ্যাত্মিক অনুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। বিষয়টি এমন যে আধুনিক মানুষ চাইলে কোনো ধর্মের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারে, এর কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে পারে এবং আবেগগতভাবে এর প্রতি সংযুক্ত থাকতে পারে বটে। কিন্তু এই ধর্ম তার চিন্তা, জ্ঞান, কাজ, জীবনধারা বা সাংস্কৃতিক-সভ্যতাগত কাঠামো গঠনে খুব কমই ভূমিকা রাখে।
পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও ধর্মতাত্ত্বিকেরা ধর্মের সংজ্ঞা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিলেও, তাঁদের অধিকাংশই কেবল খ্রিষ্টধর্মের মডেলের ওপর ভিত্তি করে ধর্মকে ব্যাখ্যা করেছেন। ম্যাক্সিম রডিনসন এ বিষয়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন, পাশ্চাত্যের মানুষ স্বভাবতই অন্য সব ধর্মকে খ্রিষ্টধর্মের মডেলের ভিত্তিতে বিচার করে। (বুখুশ, তারিখুল আদিয়ান , পৃষ্ঠা ১৮)
এই দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মের বিস্তৃত ভূমিকাকে সংকুচিত করে ফেলেছে।
ধর্মকে কেবল বিশ্বাসগত অবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না, যেমন জ্ঞানকে শুধু প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যায় না। তাহা আবদুর রহমান বলেন, ধর্মকে এভাবে সংকীর্ণ করা যায় না; দুটি নীতির জন্য—প্রথমত, ‘জীবনের শাখাগুলোর বহুত্ববাদী নীতি’ এবং দ্বিতীয়ত, ‘শাখার পরিপূর্ণতার নীতি’।
জীবনের শাখাগুলোর বহুত্ববাদী নীতি বলে, ধর্ম মানুষের মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেয়: ‘আমি কীভাবে জীবনযাপন করব?’ ধর্মের মূল লক্ষ্য হলো মানুষকে পবিত্র জীবনের পথ দেখানো। কিন্তু এই পবিত্র জীবন একটি মাত্র শাখার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি একাধিক শাখার সমন্বয়ে গঠিত।
পাশ্চাত্যের মানুষ স্বভাবতই অন্য সব ধর্মকে খ্রিষ্টধর্মের মডেলের ভিত্তিতে বিচার করে।ম্যাক্সিম রডিনসন, তারিখুল আদিয়ান, পৃষ্ঠা ১৮
এই শাখাগুলোকে তিনটি প্রধান অংশে ভাগ করা যায়:
১. ইমানের শাখা: এর মধ্যে সব ধরনের বিশ্বাস ও আকিদা অন্তর্ভুক্ত।
২. জ্ঞানের শাখা: এর মধ্যে সব ধরনের জ্ঞান ও মারিফাত অন্তর্ভুক্ত।
৩. কর্মের শাখা: এর মধ্যে সব ধরনের কাজ ও আমল অন্তর্ভুক্ত।
পবিত্র জীবন এই তিন শাখার সমন্বয়ের ওপর নির্ভর করে। কেবল আলাদা আলাদা করে ইমান, জ্ঞান বা কর্মের মাধ্যমে জীবনে পূর্ণতা অর্জন বা মুক্তি সম্ভব নয়। এমনকি এই তিনটির মধ্যে দুটি শাখা একত্র হলেও তা যথেষ্ট নয়। বরং ইমান, জ্ঞান ও কর্ম এই তিনটির সমন্বয়ে একজন মানুষ তার জীবনকে পূর্ণতা দিতে পারে। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘যে পুরুষ বা নারী সৎকর্ম করে ও সে মুমিন, আমি তাকে অবশ্যই পবিত্র জীবন দান করব এবং তাদেরকে তাদের উত্তম কাজের প্রতিদান দেব।’ (সুরা নাহল, আয়াত: ৯৭)
আবার বলা হয়েছে, ‘বলো, আমার নামাজ, আমার কোরবানি, আমার জীবন ও আমার মৃত্যু সবকিছু বিশ্বজগতের রব আল্লাহ মহানের জন্য।’ (সুরা আনআম, আয়াত: ১৬২)
এই আয়াতগুলো ইসলামের বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গির প্রমাণ দেয়, যা জীবনের সব দিককে একটি সমন্বিত ঐক্যের মধ্যে নিয়ে আসে।
তাহা আবদুর রহমান আরও বলেন, জীবনের প্রতিটি শাখার নিজস্ব পূর্ণতার লক্ষ্য থাকা উচিত। কিন্তু এই পূর্ণতা কেবল তখনই অর্জিত হয়, যখন একটি শাখা অন্য শাখাগুলোর সঙ্গে সমন্বিত হয়। প্রতিটি শাখার নিজস্ব চাহিদা ও সম্পর্ক রয়েছে, যা অন্য শাখাগুলোর সাহায্য ছাড়া পূরণ করা যায় না। ইমানের শাখা মানুষের বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করে, যা জীবন, সৃষ্টি ও অদৃশ্য সম্পর্কে তার বোঝাপড়াকে প্রভাবিত করে। এই বিশ্বাস তার হৃদয়, আত্মা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজকে প্রভাবিত করে। কিন্তু এই বিশ্বাস ও কর্ম জ্ঞানের শাখার ওপর নির্ভরশীল।
জ্ঞানের শাখা শুধু প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি শরিয়া, মানুষ, সমাজ ও প্রকৃতির জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর উৎস কেবল দৃশ্যমান জগৎ নয়, বরং অদৃশ্য জগৎও।
জ্ঞানের শাখা শুধু প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি শরিয়া, মানুষ, সমাজ ও প্রকৃতির জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করে। এর উৎস কেবল দৃশ্যমান জগৎ নয়, বরং অদৃশ্য জগৎও। এর পদ্ধতি শুধু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ওপর নির্ভর করে না, বরং বুদ্ধি, ওহি, বোঝাপড়া ও ব্যাখ্যার ওপরও নির্ভর করে। এই জ্ঞান সঠিক বিশ্বাস ও সৎকর্মের পথ দেখায়। (তাহা আবদুর রহমান, কাইফা নুফাক্কির ফি আস-সিলাহ বাইনাদ দিন ওয়াল ইলম , পৃষ্ঠা ৪০)
ইসলাম কেবল ইমানের একটি অবস্থার নাম নয়। এটি জীবনের সব শাখা—ইমান, জ্ঞান ও কর্মকে একটি সমন্বিত ঐক্যের মধ্য নিয়ে আসে। পাশ্চাত্যের ধর্মের মডেল ধর্মকে ব্যক্তিগত আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করলেও ইসলাম জীবনের সব দিককে আলোকিত করে। এটি মানুষের অস্তিত্বগত প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং তাকে পবিত্র জীবনের পথ দেখায়। ইসলামের এই বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের জীবনের সব শাখাকে সমন্বিত করতে ও আল্লাহ মহানের অর্পিত আমানত পালন করতে উৎসাহিত করে।
সূত্র: ইসলাম অনলাইন ডট নেট