সন্দ্বীপের ঐতিহ্য দর্শনে গিয়ে দিনভর কী কী দেখলেন এলিজা
তিন নম্বর সতর্কসংকেত চলছিল বলে ফেরি চলাচল বন্ধ। সীতাকুণ্ডের কুমিরা নৌঘাট থেকে তাই স্পিডবোটে উঠে পড়লাম। সঙ্গে আছেন পর্বতারোহী তাহুরা সুলতানা। সন্দ্বীপ চ্যানেলে ৪০ মিনিট চলার পর গুপ্তছড়া ঘাটে পৌঁছালাম। এ ঘাটের পরই একটি বাজারমতো জায়গা। সেখান থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় উঠে পড়ি।
সন্দ্বীপ এককালে কম খরচে মজবুত ও সুন্দর জাহাজ নির্মাণের জন্য খ্যাত ছিল। ইউরোপের বিভিন্ন এলাকায় এই জাহাজ রপ্তানিও হতো। জাহাজ নির্মাণকারী কারিগরদের কোনো বংশধরের খোঁজ পাওয়া যায় কি না, তারই চেষ্টায় সিএনজিতে ছুটে চলা। উপজেলা কার্যালয়, বাজার পার হয়ে একটি বাঁধের সামনে এসে থামলেন চালক। বাঁধের ওপর পথ আর ওপাশে যত দূর দৃষ্টি যায় বিশাল চর। মাঝেমধ্যে নারকেলগাছ। সিএনজি থেকে নেমে জোড়ে শ্বাস নিলাম। আহা, দিলাল রাজার সন্দ্বীপ।
নতুন এই চর এলাকা আগে ছিল সন্দ্বীপ টাউন। অথচ শত শত বছরে গড়ে ওঠা দুই কিলোমিটার বিস্তৃত এই জনপদ ছিল কোলাহলমুখর। ১৯০২ সালের মাদ্রাসা, ১৯৩৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সন্দ্বীপ হাইস্কুল, সরকারি হাজী এ বি কলেজ, দোকানপাট, সরকারি-বেসরকারি অফিস, ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালত, আবু তোরাব চৌধুরীর দিঘি। পড়ন্ত বিকেলে এই দিঘি ঘিরে বসত বিনোদন আড্ডা। ১৯৯১ সালের জলোচ্ছ্বাসে সব ভেসে গেছে। বিস্তীর্ণ ভূমি ছাড়া এখন আর কিছুই নেই।
নদীভাঙনের কবলে পড়ে সন্দ্বীপের প্রায় তিন ভাগের দুই ভাগ জায়গা অনেক আগেই বিলীন হয়ে গেছে, তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে পুরোনো সন্দ্বীপ টাউনসহ অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা। সেটি নতুন জায়গায় স্থানান্তরের পর আবারও ভেস্তে গিয়ে এখন তৃতীয় জায়গায় অবস্থান করছে সন্দ্বীপ টাউন।
এসব স্মৃতিচারণা করছিলেন ৬০ বছর বয়সী আবদুল আহাদ। বাঁধের পাড়েই তাঁর ছোট দোকান। আমরা চা খেতে খেতে গল্প শুনছিলাম। কিন্তু জাহাজ কারিগরদের পুরোনো আবাসস্থলের কথা তিনিও বলতে পারলেন না।
রহমতপুর বাঁধের পাশ দিয়ে সিএনজিচালক এবার আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন ফুলবিবি সাহেবানী মসজিদের কাছে। বাঁধের পথ পার হওয়ার পর একটি সরু পাথরের পথ ধরলাম। সিএনজিচালক বারবার বলছেন, পুরোনো মসজিদের অস্তিত্ব নেই। সেখানে চর পড়েছে, বিরানভূমি। তারপরও বললাম, পুরোনো জায়গাটিই আমি দেখতে চাই।
সন্দ্বীপের খ্যাতনামা জমিদার মুরাদ চৌধুরীর সহধর্মিণী ফুলবিবির আর্থিক সাহায্যে নির্মিত হয়েছিল এই মসজিদ। মসজিদটির নির্মাণকাল নিয়ে নানা মত থাকলেও অধিকাংশ ইতিহাসবিদ মনে করেন, ১৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। আমার মনে ক্ষীণ আশা, মসজিদের একটি দেয়াল কিংবা কটি ইটের দেখাও যদি পাই।
আমাদের কালাপানিয়া এলাকায় নিয়ে এলেন সিএনজিচালক। একটি চর দেখিয়ে বললেন, এখানেই ছিল পুরোনো মসজিদ। সামনে এলেই বিরাট প্রান্তর। ছোট ছোট ঝাউগাছ, মাঝেমধ্যে নারকেলগাছ। চরে ভেড়া চরছে। চাষাবাদও হচ্ছে। কিন্তু কোনো স্থাপনা নেই। প্রচণ্ড রোদ মাথায় করে হাঁটছি। আচমকা এক গ্রামবাসী জানতে চাইলেন, আমরা কী খুঁজছি? সাহেবানী মসজিদের কথা বলতেই তিনি বললেন, ‘এখানেই ছিল, কিন্তু একেবারে বিলুপ্ত।’ নিজে থেকেই আবার বললেন, ‘আমি যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে আমার ঘর ছিল, ভাঙনে চলে গেছে। সেই স্থানেই আমি চাষাবাদ করছি।’
ওই গ্রামবাসীর সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কথা বললাম। তিনি আরও তথ্য দিলেন, এখানে একই রকম দেখতে দুটি মসজিদ ছিল। সাহেবানী মসজিদ আর বিবি মরিয়ম মসজিদ। এগুলোর স্থাপত্যশৈলীও ছিল একরকম। অনেকে বলত, দুই বোনের দুটি মসজিদ। অনেক বইয়ে বিবি মরিয়মকে দিলাল রাজার কন্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই তথ্যের সত্যতা আমার জানা নেই। সাহেবানী মসজিদের নামে তুলাতুলি এলাকায় নতুন একটি মসজিদ গড়া হয়েছে। এই মসজিদের পাশেই দুলাল নামের এক ব্যক্তির কাছে পুরোনো মসজিদের ছবি আছে বলে জানলাম।
আমাদের এবার তুলাতুলির ফুলবিবি সাহেবানী মসজিদে নিয়ে গেলেন সিএনজিচালক। সাদামাটা একতলা একটি মসজিদ। পাশেই একটি দিঘি। মুসল্লিরা গোসল করছেন। সড়ক থেকে মসজিদের ছবি তুলছি। স্বাভাবিকভাবেই উৎসাহী গ্রামবাসী জানতে চাইলেন, আমরা কোথা থেকে এসেছি, কেন এসেছি? কারণ ব্যাখ্যা করলাম। মসজিদ সম্পর্কে সবাই নিজের জানা তথ্য আমাদের বললেন। আমি দুলাল সাহেবকে খুঁজছি, এমন সময় এক পথচারী জানালেন, তাঁর কাছে পুরোনো ছবি রয়েছে। দুই মিনিট অপেক্ষা করতেই তিনি ল্যামিনেট করা ফুলবিবি সাহেবানী মসজিদের ছবি দেখালেন। মোগল স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই মসজিদ এখন শুধুই স্মৃতি।
আবহাওয়া ও ভৌগোলিক কারণে সন্দ্বীপের পান, ডাব, মিষ্টি, দইসহ বেশ কিছু জিনিসের বিশেষ খ্যাতি আছে। কিন্তু ঘুরতে ঘুরতে কিছুই তো খাওয়া হলো না। তাই ঘাটে যাওয়ার পথে শিবের হাট এলাকার বাজারে গেলাম। এখানেই বিনয় সাহার মিষ্টির দোকান। সন্দ্বীপে দুজন কারিগরের মিষ্টি খ্যাতি অর্জন করেছে। একজনের নাম প্রিয়লাল মজুমদার ও অন্যজন বিনয়কৃষ্ণ সাহা। প্রিয়লাল মজুমদারের দোকান না থাকলেও বিনয় সাহার মিষ্টি বিতান এখনো রয়েছে। মুখে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মাখনের মতো গলে গেল গরম রসগোল্লা। সবাই বলেন, আগের স্বাদ আর এখন নেই। কিন্তু আগের স্বাদের আমি কী জানি! চারটি মিষ্টি খেয়ে অমৃতের স্বাদ পেলাম। সঙ্গে মহিষের দুধের দইও চেখে দেখলাম।
মিষ্টি খেয়েই গুপ্তছড়া ঘাটের দিকে যাত্রা করলাম।