রফিক মুহাম্মদ
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এক অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্যের দেশ পাকিস্তান। এ দেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থাপনার নিপুণ কারুকার্য এবং সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাত। এখানকার মনোমুগ্ধকর পর্বতমালা, সবুজ উপত্যকা, প্রাচীন ঐতিহ্যের সুনিপুণ স্থাপানা এবং নির্জন মরুভূমি ভ্রমণপ্রেমীদের জন্য এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা এনে দেয়। পাকিস্তান একটি অত্যন্ত সুন্দর আধুনিক রাষ্ট্র। এর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যি বিমোহিত করে। এটি বিশ্বের অন্যতম জনবহুল একটি দেশ। দেশটি দেখতে যেমন মনোরম, দেশের মানুষের ব্যহারও ঠিক তেমনি সুন্দর। পাকিস্তান নিয়ে অনেকেই অনেক ধরনের নেতিবাচক মন্তব্য করেন। তবে এটা পশ্চিমা মিডিয়া বা ভারতীয় মিডিয়ার অপপ্রচার থেকেই তাদের এমন ধারণার তৈরি হয়েছে। পাকিস্তানে গিয়ে, সে দেশ দেখার পর, সে দেশের মানুষের সাথে কথা বলা বা মেশার পর কোন নেতিবাচক ধারণা কেউ পোষণ করতে পারবেন বলে আমি মনে করি না। পাকিস্তানে নয় দিনের সফর শেষ করে এসে আমার এমনটি মনে হয়েছে। পাকিস্তানের মানুষ এত ভালো ব্যবহার করবেন, এটা ভাবতেই পারিনি। যেরকম খাবার-দাবার, আতিথেয়তা, উদারতা পেয়েছি, সেটা অসাধারণ ও স্মরণীয়।
গত ১২ ফেব্রয়ারি থেকে ২০ ফেব্রয়ারি পর্যন্ত আমাদের ১০ জন সাংবাদিকের একটি টিমের ছিল পাকিস্তান সফরকাল। এই নয়টা দিন সত্যি মনে রাখার মতো। আমরা ঢাকা থেকে ব্যাংকক হয়ে যখন ইসলামাবাদের কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বিমান বন্দরে পৌঁছলাম তখন স্থানীয় সময় রাত সাড়ে দশটা। খুব শীত না হলেও তখনো শীতের দাপট বেশ ভালোই ছিল। এরমধ্যে বিমান বন্দরে আমাদেরকে ফুলেল অভ্যর্থনা জানালেন পাকিস্তানের তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক্সট্রা পাবলিসিটি ইউং এর ডেপুটি পরিচালক মুজিব কাদের এবং সহকারী পরিচালক আমিনা ইকবাল। ইসলামাবাদ যে ক’দিন ছিলাম এ দু’জন ছিলেন আমাদের গাইড। তারা সর্বক্ষণ আমাদের সাথে থেকে আমাদেরকে যে আতিথেয়তা দিয়েছেন তা অকল্পনীয়, তা কখনো ভোলার নয়।
‘পাকিস্তান’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো পবিত্র স্থান। এর ইসলামাবাদ, রাওয়াল পিন্ডি, মারি, পাঞ্জাব, লাহোর এ কয়টা শহর ঘুরে পাকিস্তানকে একটি পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র দেশ বলে মনে হয়েছে। আল্লামা ইকবালের কবিতার ‘গুলিস্তাঁ’তেই যেন বিচরণ করেছি। এসব শহরের প্রতিটি রাস্তা যেমন মসৃণ তেমনি পরিস্কার-রিচ্ছন্ন। রাস্তার কোথাও কোন ময়লা আবর্জনা থাকা তো দূরের কথা কোন গাছের পাতা পর্যন্ত পড়ে থাকতে দেখিনি। ইসলামাবাদ শহরের প্রতিটি রাস্তার পাশেই গাছগাছালি ভরা। অনেক পার্ক রয়েছে। এ ছাড়া পুরো শহরটাই মার্গাল্লা পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত। শহরের রাস্তা থেকে যে দিকেই তাকানো যায় সে দিকেই সবুজ পাহাড় আর সুনীল আকাশের এক অপরূপ মিতালী চোখে পড়ে। তখন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জনপ্রিয় গানের কলি গুনগুন করে গাইতে ইচ্ছে করে ‘আকাশে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমায় ওই’।
ইসলামাবাদ পাকিস্তানের রাজধানী। এটি পাকিস্তানের নবম বৃহত্তম শহর। এ রাজধানী শহরটি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে তৈরী করা হয়েছে। এ শহরটিকে ঘিরে আছে সবুজ ঘেরা মার্গাল্লা পাহাড়। রাস্তার পাশ দিয়ে সবুজে ঘেরা উঁচু উঁচু পাহাড় দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। এর রাস্তাঘাট এত সুন্দর ও পরিল্পিত যে কোথাও কোন যানজট নেই। শহরটি দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্র হওয়ায়, এখানে অনেক সরকারি ভবন এবং দূতাবাস রয়েছে। আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেটি কনস্টিটিউশন এভিনিউয়ের কাছে। এ রাস্তায় রয়েছে ইসলামাবাদ হাইকোর্ট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সুপ্রিম কোর্ট অব পাকিস্তান, পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ভবন, প্রেসিডেন্টের বাসভবন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এ ছাড়া ইসলামাবাদের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে ফয়সাল মসজিদ, ডামান-এ-কোহ এবং মর্গাল্লা পাহাড়ের পদদেশে মারি শহর। ইসলামাবাদে আমরা পৌঁছেছিলাম বুধবার দিবাগত রাতে। এর একদিন পরই শুক্রবার অর্থাৎ জুমাবার। তাই আমাদের গাইড ইসলামাবাদ পিআইবির উপপরিচালক মুজিব কাদের বৃহস্পতিবার সকালেই আমাদের জানালেন যে আগামীকাল শুক্রবার আমরা ইসলামাবাদের ঐতিহাসিক ফয়সাল মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করবো। কিন্তু পরদিন শুক্রবারে ফয়সাল মসজিদে আমরা জুমার নামাজ আদায় করতে পারিনি। নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে আমাদেরকে শহরের এক প্রান্তে অন্য একটি মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করতে হয়েছে। তবে দু’দিন পর আমরা ফয়সাল মসজিদ পরিদর্শনে যাই।
ফয়সাল মসজিদ পাকিস্তানের বৃহত্তম মসজিদ। মসজিদটি ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তুর্কি স্থপতি ভেদাত ডালোকে এর ডিজাইন করেন। মসজিদটি দেখতে অনেকটা মরুভূমির বেদুঈনদের তাঁবুর মতো। সারা পৃথিবীতে এটি ইসলামাবাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সমসাময়িক ইসলামিক স্থাপত্যের অপরূপ নিদর্শন এই মসজিদের ধারণক্ষমতা প্রধান এলাকায় ৭৪ হাজার এবং সংযুক্ত এলাকায় প্রায় ২লক্ষ। এর মিনারের উচ্চতা ৯০ মিটার বা ৩০০ ফুট। এটি নির্মাণ খরচ হয়েছে ১২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ এই মসজিদ নির্মাণে সমর্থন এবং অর্থ সাহায্য প্রদান করেন। তাই এই মসজিদটি বাদশাহ ফয়সালের নামে নামকরণ করা হয়। এই মসজিদটি দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম মসজিদ। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মসজিদটি পৃথিবীর বৃহত্তম মসজিদ ছিলো। পরবর্তীতে মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কায় ‘হাসান-২ মসজিদ’ নির্মাণ হলে ফায়সাল মসজিদ তার অবস্থান হারায়।
পৃথিবীর স্বর্গ হিসাবে পরিচিত কাশ্মীর রয়েছে পাকিস্তানে। এটি দেখার সময় ও সুযোগ আমাদের হয়নি। তবে ইসলামাবাদ শহর থেকে কিছুটা দূরে মার্গাল্লা পাহড়ের পাদদেশে অবস্থিত ছোট্ট মারি শহরের সৌন্দর্য দেখে কাশ্মিরের স্বর্গীয় উদ্যানের অপরূপ রূপের কিছুটা হলেও অনুভব করেছি। সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট সুন্দর এই শহর মারিতে শীতের সময় মাইনাস ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি পর্যন্ত তাপমাত্রা নেমে যায়। তখন বরফ পড়ার দৃশ্যও সেখানে দেখা যায়। তবে আমরা যে দিন মারিতে গিয়েছিলাম সেটা ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারি। সেদিন মারির তাপমাত্রা মাইনাসে যায়নি। দিনের বেলায় ৮ থেকে ১০ ডিগ্রী এবং সন্ধ্যার দিকে সেটা ২ থেকে ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াশের মধ্যে ছিল। তাই বরফ পড়ার দৃশ্য আমরা দেখতে পারিনি। তবে পাহাড় ঘেরা মারির অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এই সুন্দর শহরটিতে আমাদের এক রাত্রি যাপনের কথা ছিল কিন্তু অন্যান্য কর্মসূচি থাকায় সেটাও শেষ পর্যন্ত হয়নি। তবে যতটা সময় সেখান ছিলাম ততক্ষণই প্রাণ ভরে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করেছি। হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার নিদর্শন মোহেনজোদারো ও হরপ্পা পাকিস্তানে অবস্থিত। আমাদের এ সফরে হরপ্পা মোহেনজোদারো দর্শনের সুযোগ হয়নি। তবে ইসলামাবাদের অদূরে অবস্থিত বৌদ্ধ সভ্যতার অন্যতম নির্দশন গৌতম বুদ্ধের ঐতিহাসিক শিক্ষাকেন্দ্র ‘তক্ষশিলা’ ঘুরে দেখেছি। ইসলামাবাদ, রাওয়াল পিন্ডি, মারি এসব শহর ঘুরে এবং রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান শেষ করে পাঁচ দিন পর আমরা গেলাম লাহোরে।
পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক রাজধানী লাহোরে বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত লাহোর দুর্গ এবং অত্যাশ্চর্য বাদশাহী মসজিদ, আর এই মসজিদের পাশে রয়েছে মহাকবি আল্লামা ইকবালের মাজার। প্রাণবন্ত প্রাচীরযুক্ত শহর এবং এর সুন্দর পরিপাটি রাস্তা, ব্যস্ত বাজার এবং ঐতিহাসিক স্থাপত্য সব মিলিয়ে অপরূপ। লাহোরের প্রতিটি রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট ছোট লেক। এসব লেকে প্রবাহিত হচ্ছে স্বচ্ছ পরিষ্কার পানি। সত্যি খুব নয়নাভিরাম। রাস্তার পাশে ফুটপাতে কোন হকার নেই, নেই কোন দোকান পাট। এসব শহরের কোথাও ভিক্ষুকও চোখে পড়েনি। হাইওয়ে রাস্তার মোড়ে রঙ বেরঙের পোশাক পড়ে দু’একজন ভিক্ষুক দেখেছি। তারা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কারো মন চাইলে গাড়ি থামিয়ে তাদের ভিক্ষে দিচ্ছে। এ ধরনের কিছু ফলের ভ্যানগাড়িও রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে ফল বিক্রি করতে দেখেছি। তবে সেগুলো খুবই কম।
আগেই বলেছি পাকিস্তানে থাকা অবস্থায় তাদের আতিথেয়তা আমাদের মুগ্ধ করেছে। লাহোরে যে চারদিন ছিলাম আমাদের দেখাশোনা করেছেন লাহোর পিআইডির ডিজি শাবকাত আব্বাস। অত্যন্ত বিনয়ী এবং অমায়িক একজন মানুষ। তিনি এবং পিআইডর পরিচালক মরিয়মসহ তাদের অফিসের আরও কয়েকজন সারাক্ষণই আমাদের তত্ত্বাবধান করেছেন। লাহোরে আমরা লাহোর ফোর্ট, শালিমার বাগ বা গার্ডেন, বাদশাহী মসজিদ এসবঘুরে দেখেছি এবং তার সংলগ্ন অল্লামা ইকবালের মাজার জিয়াত করেছি।
লাহোরের সৌন্দর্যতিলক বলে খ্যাত বাদশাহী মসজিদ। এর পাশেই আল্লামা ইকবালের মাজার। মোগল স্থাপত্বের এক অসাধারণ নিদর্শন এগুলো। বাদশাহী মসজিদে বেলা বারটার দিকে আমরা পৌঁছাই। মসজিদের সামনে বিশাল খোলা জায়গা দেশে অবাক হই। এরপর ভিতরে ঢুকে দুই রাকাত শুকরানা নামাজ আদায় করি। মসজিদের কারুকার্য এবং এর ইকোসিস্টেম দেখে অবাক ও মুগ্ধ হই। মসজিদ থেকে বের হয়ে আল্লাম ইকবালের মাজার প্রাঙ্গণে যাই। কিন্তু ভিতরে ঢোকার অনুমতি নেই। তখন খাদেম সাহেবকে বলি ‘আমরা বাংলাদেশ থেকে এদেশের সরকারের আমন্ত্রণে এসেছি’। এরপর আমাদের একজন একজন করে কবর জিয়ারতের সুযোগ দেওয়া হলো। বাদশাহী মসজিদের পাশেই লাহোর ফোর্ট। লাহোর সিটির মধ্যস্থলে প্রায় সর্বত্রই এই ফোর্টের প্রাচীর নযরে পড়ে। আমরা ভেতরে প্রবেশ করে এর সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হই।
ছেলেবেলায় ইতিহাসে অনেকবার শালিমার বাগের নাম পড়েছি। পাঠ্যবইয়ে শালিমার বাগের হাতে আঁকা একটি চমৎকার চিত্র ছিল। এখন মুখোমুখি দর্শনে সেই শালিমার বাগকে অবিশ্বাস্য রকম মনোমুগ্ধকর মনে হয়। কি বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত জলাধার, ফোয়ারা, ঝর্ণাধারা আর হাম্মামখানা! কেবল রাজকীয় কারবার বললে ভুল হয়, বরং আধুনিক প্রযুক্তি আবিষ্কারের কয়েক শত বছর পূর্বেও তৎকালীন স্থাপত্যশিল্পীদের মন ও মনন কত আধুনিক ছিল এবং তাদের কলাকৌশল যে কত নিখুঁত ছিল, তার প্রামাণ্য চিত্র যেন এই গার্ডেন। তাজমহলের পর এটি মুঘল আমলের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন শৈল্পিক স্থাপনা হিসাবে স্বীকৃত। প্রায় ৫০ একর বা দেড়শ বিঘা ভূমি জুড়ে বিস্তৃত গার্ডেনটি ৩টি পৃথক বর্গাকার সমভূমিতে বিভক্ত। যার প্রতিটি স্তর একটি অপরটির চেয়ে কয়েক মিটার উঁচু। ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া গার্ডেনের প্রবেশমুখে দাঁড়ানো মাত্র দর্শকের চোখে এক পশলা প্রশান্তি আর বিস্ময়াবিষ্ট মুগ্ধতা দোলা দিয়ে যায়। আমরাও অভিভূত হয়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।
পাকিস্তান একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র। এর ৯৫ শতাংশ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। এদেশের সংস্কৃতি খুবই সমৃদ্ধ। হরপ্পা- মহেঞ্চোদারো পাকিস্তানে অবস্থিত। বৌদ্ধ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ নির্দশন রয়েছে তক্ষশিলায়। তক্ষশিলায় গিয়ে আমরা সেই ঐতিহাসিক বিভিন্ন শিলালিপি দেখেছি। পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র হলেও সেখানকার নারীরা খুবই আধুনিক এবং উচ্চ শিক্ষিত। রাষ্ট্র পরিচালনা থেকে শুরু করে সমাজের সর্বস্তরে নারীরা অত্যন্ত স্বাধীন ও নিরাপত্তার সাথে কাজ করছে। পাকিস্তানে নারীরা অবহেলিত এবং নির্যাতিত এমন অপপ্রচার ভারতপন্থি বিভিন্ন মিডিয়াতে করা হয়। কিন্তু আমরা দেখেছি ভারতের বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের মেয়েরা তাদের কর্মক্ষেত্রে অনেকটাই স্বাধীন এবং নিরাপদ। ভারত কিংবা বাংলাদেশে দূরপাল্লার বাস বা নাইট কোচে মহিলা গাইড থাকবে এটা কল্পনাও করা যায় না। অথচ পাকিস্তানে নাইট কোচে মহিলা গাইড অত্যন্ত সাবলীলভাবে কাজ করছে। আমরা ইসলামাবাদ থেকে লাহোরে সড়ক পথে গিয়েছি। ‘ফয়সাল মোভার্স’ নামের যে বাসটি ইসলামাবাদ থেকে বেলা ৫টায় ছেড়েছে সেটা রাত ১১টায় লাহোরে পৌঁছে। এই বাসে মহিলা গাইড ছিলেন আমিনা। তার সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, প্রায় ৪ বছর যাবৎ তিনি এ চাকরি করছেন। এখানে তার কোন সমস্য হয় না। বাসের ড্রাইভার তাকে বোনের মতই সম্মান করেন। শুধু বাসে নয় বিভিন্ন সেক্টরে পাকিস্তানি মেয়েরা অত্যন্ত স্বাধীনভাবে কাজ করছেন। পাকিস্তানের মিডিয়াতেও মেয়েদের রয়েছে অবাধ বিচরণ। আমরা পাকিস্তানের সবচেয়ে প্রাচীন ও জনপ্রিয় পত্রিকা ‘ডন’ পরিদর্শন করেছি, বেসরকারি টিভি চ্যানেল দুনিয়া টিভি, রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল, রেডিও অফিস, বেসরকারি অনলাইন ‘ইউ নিউজ’ এগুলো পরিদর্শনে গিয়ে মেয়েদের কর্মব্যস্ততা দেখে মুগ্ধ হয়েছি।
ইউ নিউজে কর্মরত নারী সাংবাদিকরা আমাদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া গ্রহণ করেছে। তারা প্রত্যেকেই খুবই মেধাবী। এ ছাড়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব আমরিন জান, পররাষ্ট্র সচিব আমনা বালুচ, ইপিআই-এর ডিজি রাইসা আদিল, সহকারী পরিচালক আমিনা ইকলাব, লাহোরে পিআইডির কর্মকর্তা মরিয়মসহ আরও অনেকেই তাদের কর্মস্থলে দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। লাহোর হলো পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাজধানী এবং করাচির পর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এই শহরটি অমৃতসরের সীমান্তের নিকটে অবস্থিত এবং এখানে রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক স্থান, যেমন লাহোর দুর্গ, বাদশাহী মসজিদ, আল্লামা ইকবালের মাজার এবং শালিমার বাগ। লাহোরের খাবারও বিশেষভাবে প্রসিদ্ধ, বিশেষ করে তার বিরিয়ানি এবং কাবাব। লাহোরের ঐতিহাসিক স্থানের পাশাপাশি সেখানকার আর্ট কলেজ পরিদর্শন করেছি। সেটা খুবই চমৎকার। লাহোরের বিভিন্ন মার্কেটে মহিলাদের স্বচ্ছন্দে কাজ করতে দেখেছি।
বিশেষ করে ইসলামাবাদ রিচার্স ইনস্টিটিউট (আইপিআরআই) এর সাথে মতবিনিময় ছিল খুবই চমৎকার। সেখানকার শিক্ষার্থী মেয়েরা বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব নিয়ে তাদের যে প্রতিক্রিয়া তা আমাদের মুগ্ধ করেছে। তারা জুলাই বিপ্লবকে অনুপ্রেরণা হিসাবে দেখছে। তারা বাংলাদেশ পাকিস্তানের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় দেখতে চায়। পাকিস্তানের জনগণের সাথে বাংলাদেশের জনগণের সুসম্পর্ক তৈরীতে আগ্রহী।
সবশেষে কবি আল্লামা ইকবালের কবিতা থেকে বলতে চাই ‘দিল-এ-বিনা ভি কর খুদা সে তালাব আঁখ কা নূর দিল কা নূর না’ অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার কাছে হৃদয়কে আলোকিত করার জন্য প্রর্থনা করো, যেখানে চোখ এবং হৃদয়ের দৃষ্টি আলাদা জিনিস’। সত্যি তাই পাকিস্তানের রূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে শুধু মাত্র দু’চোখের দৃষ্টি দিয়ে দেখলেই হবে না, হৃদয়ের দৃষ্টি দিয়ে তা উপভোগ করতে হবে। একবার ঘুরে দেখুন পাকিস্তান, সত্যি মন ভরে যাবে, মন ছুঁয়ে যাবে।